ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

শালা-দুলাভাই’র কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র!

শামীম কাদির || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শালা-দুলাভাই’র কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র!

জয়পুরহাট সংবাদদাতা: জয়পুরহাট সরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি শালা-দুলাভাই’র প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

দক্ষ জনগোষ্ঠি গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকারি আনুকল্যে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে প্রতিষ্ঠা লাভ করে জয়পুরহাট কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) । ইলেকট্রিক্যাল, কম্পিউটার, গার্মেন্টস্, ইলেকট্রনিক্স, অটোমেটিভ ও অটোক্যাট -এই ৬টি ট্রেড নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি কার্যক্রম শুরু করে। এই ট্রেড গুলোর মধ্যে একজন রাজস্ব খাতের প্রশিক্ষক ছাড়া অবশিষ্টগুলোতে খন্ডকালীন প্রশিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়।

বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষর দায়িত্বে রয়েছেন প্রকৌশলী দেলোয়ার উদ্দিন আহম্মেদ। তিনি দায়িত্বে আসেন ২০১৯ সালের ১৪ জানুয়ারি। দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠতে থাকে।

সরেজমিনে জানা যায়, ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকা সত্ত্বেও অধ্যক্ষ তার শ্যালক ওয়াসিম মিয়াকে মে-আগস্ট ৩য় ব্যাচের সেইপ (Seip)  কোর্সে প্রশিক্ষণার্থী (রেজিঃ ২২০০০৭৬৬০৬) হিসেবে ভর্তি করান, যা নিয়ম বহির্ভূত। আবার বিআরটিএ কর্তৃক ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ কোর্সের সনদপত্র না থাকা সত্ত্বেও শ্যালককে মে-জুন (২ মাস) মেয়াদী সান্ধ্যকালীন মোটর ড্রাইভিং এর প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। এরপর প্রশিক্ষণার্থীদের সারা বছরের খাবার পরিবেশনসহ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণও এখন অধ্যক্ষর এই ভাগ্যবান শ্যালকের হাতে। অবস্থাটা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, শ্যালকের মাধ্যমে তদবির না করলে কোন কাজই হয় না এই টিটিসিতে।

অধ্যক্ষ তার অনিয়ম ও দুর্নীতিকে ধামাচাপা দিতে স্থানীয় নেতা ও জেলার উধ্র্বতন কর্মকর্তাদের পছন্দমত প্রশিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ দিয়ে প্রকৃত যোগ্যতা সম্পন্ন মেধাবীদের বঞ্চিত করছেন, এমন অভিযোগও রয়েছে।

সম্প্রতি রেজুলেশন বা কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই অধ্যক্ষ তার শ্যালককে দিয়ে প্রতি ফরমের মূল্য ১শ’ টাকা করে প্রায় ২৮৭টি ফরম বিতরণ করেন। এখানে মৌখিক পরীক্ষায় বিআরটিএ ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণের বিধান থাকলেও তা না করে অধ্যক্ষ তার পছন্দমত লোকজনকে দিয়ে পরীক্ষা পরিচালনা করছেন। এছাড়া অধ্যক্ষ মৌখিক পরীক্ষায় অধ্যক্ষের পূর্ণ সময় থাকার কথা থাকলেও তিনি একবার এসেই চলে যান। পরে নিজেই রেজাল্ট শিট তৈরি করে ফেসবুক এবং অফিসের দেওয়ালে লাগিয়ে দেন। এভাবে ২০১৯ সেশনের দুটি শিফটে ৫ম ও ৬ষ্ঠ ব্যাচে মোট ৪০ জন এবং ২০২০ সেশনের জানুয়ারি-এপ্রিল দুটি শিফটে ৪০ জনকে ৭ম ও ৮ম ব্যাচের জন্য অগ্রিম ভর্তির রেজাল্ট দেওয়া হয়েছে।

জয়পুরহাট সদরের হিচমী পশ্চিমপাড়ার আরিফুল ইসলাম, আব্দুর মোমিন, আল-আমিনসহ একাধিক পরীক্ষার্থী জানান, ড্রাইভিংকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে তারা তিনবার পরীক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু সুপারিশের লোক না থাকায় তারা ভর্তির সুযোগ পাননি।

টিটিসির প্রশিক্ষণার্থী আব্দুর রাহিম, শাহ জলিল, রাসেল জানান, তাদের শুধু থিওরি ক্লাস করানোসহ ক্যাম্পাসের ২০০ গজ জায়গায় ড্রাইভিং স্টিয়ারিং ধরা শেখানো হচ্ছে, বাইরে নিয়ে গিয়ে ড্রাইভিং শেখানোর কথা থাকলেও কর্তৃপক্ষ তা করছে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নারী প্রশিক্ষণার্থী অভিযোগ করেন, সরকারিভাবে খাবারের জন্য প্রতি প্রশিক্ষণার্থীর জন্য ৩ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও টিটিসি ক্যাম্পাসের মধ্যে লাগানো পেঁপে ও কলার তরকারিসহ নিম্নমানের খাবার দেওয়া হয়। আবার এই খাবারের দায়িত্বে থাকেন অধ্যক্ষের শ্যালক ও স্ত্রী।

প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের চাকরিরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মচারী জানান, এই অধ্যক্ষ আসার পর কর্মচারীদের উপর বিভিন্নভাবে অন্যায় চলছে। এমনকি তাদের বেতনের টাকা থেকেও তাকে সন্তুষ্ট করতে হয়, খন্ডকালীন প্রশিক্ষক হওয়ায় তারা কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলতে পারেন না।

ইন্সট্রাক্টর (রাজস্ব) জিএস সুলতান আল-আমিন জানান, পূর্বের অধ্যক্ষের কাছ থেকে লিখিতভাবে দায়িত্ব বুঝে না নেওয়ার সুযোগ নিয়ে তিনি অর্থ আত্মসাতও করছেন। দীর্ঘ ৮ মাস ধরে তিনি নিজের ইচ্ছামতো প্রতিষ্ঠানের সকল কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া অধ্যক্ষ ৪০ দিন আগে প্রশিক্ষণার্থীদের বৃত্তির ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা তুলে এনে তার পকেটে রেখেছেন।

তিনি বলেন, ‘অধ্যক্ষের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় বহিরাগত সন্ত্রাসী দিয়ে হুমকি দেওয়া ছাড়াও আমাকে বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। এ ব্যাপারে আমি জেলা প্রশাসক এর কাছে লিখিত ভাবে অভিযোগ দিয়েছি।’

এ ব্যাপারে অধ্যক্ষ প্রকৌশলী দেলোয়ার উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘শ্যালক ওয়াসিমকে ড্রাইভার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং সে ২ মাস মেয়াদি খন্ডকালীন প্রশিক্ষকেরও দায়িত্ব পালন করছে। আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত ।

জয়পুরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, ‘এই কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ জেনেছি, তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

একই কথা বললেন জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিচালক মোঃ নুরুল ইসলাম।



রাইজিংবিডি/জয়পুরহাট/১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯/শামীম কাদির/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়