ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

ব্যবসায়ীর লাশ নিয়ে শহর ঘুরেও মিললো না গোসলের জায়গা

নিজস্ব প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২৩:৩৮, ১৪ জুলাই ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
ব্যবসায়ীর লাশ নিয়ে শহর ঘুরেও মিললো না গোসলের জায়গা

দাফন টিমের সদস্যরা মৃত মোহাম্মদ আলীর লাশের তদারকি করছেন

করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যান খুলনার দৌলতপুর মহেশ্বরপাশা এলাকার মোটরপার্স ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী (৫৮)।

কিন্তু গোসল করিয়েই তাকে এলাকায় নিতে হবে—  এমন ফরমান জারি করেন তারই ঘনিষ্ট বন্ধু বেলায়েত হোসেন।

আর এ ফরমানের পরই ঘটে যত বিপত্তি। অগত্যা মৃতের স্বজনরা লাশ নিয়ে সারা শহর ঘুরে কোথাও তাকে গোসল করানোর মত সামান্য জায়গাটুকু পেলেন না।

পরবর্তীতে বিষয়টি জানাজানি হলে কিছু মানবিক মানুষের উদ্যোগে নিজ এলাকাতেই ব্যবস্থা হয় গোসল ও দাফনের।

মৃত মোহাম্মদ আলী মানিকতলা এলাকার আদনান মোটর্স নামক মোটর পার্সের দোকানের মালিক। তিনি স্থানীয় মানিকতলা জামে মসজিদের ক্যাশিয়ার ছিলেন।

মৃতের স্বজন ও স্বেচ্ছাসেবী দাফন টিমের সদস্যদের সূত্রে জানা গেছে, ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী দাঁত ব্যাথা, এ্যাজমা ও শ্বাসকষ্ঠজনিত কারণে সোমবার (১৩ জুলাই) খুলনা মেডিক‌্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। ওই দিনই রাত সাড়ে ১২টার দিকে তিনি মারা যান।

এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক করণীয় জানতে মৃতের ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম তার ভাইয়ের বন্ধু মানিকতলার বি হোসেন অ‌্যান্ড কোম্পানির মালিক ও মানিকতলা মসজিদ কমিটির সভাপতি বেলায়েত হোসেনকে জানান। তখন বেলায়েত হোসেন তাকে বলেন, ‘হাসপাতাল থেকে বা বাইরে যে কোন জায়গা থেকে যেন তাকে গোসল করিয়ে নেওয়া হয়। তা নাহলে এলাকাবাসী লাশের গোসল করাতে দেবে না। এ কথা শুনে হতবিহবল হয়ে পড়েন সাইফুল। কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। এ সময় তিনি খুলনার উত্তর ডুমুরিয়ার ইমাম-উলামা পরিষদের গঠিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তাকওয়া ফাউন্ডেশনের দাফন টিমের শরণাপন্ন হন এবং তাদের সহযোগিতা চান।

দাফন টিমের প্রধান সমন্বয়কারী হাফেজ মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ‘মৃতের ভাই আমাদের দাফন টিমের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমরা মঙ্গলবার ফজর বাদেই রওনা হই। খুলনা মেডি‌ক‌্যালে যাওয়ার পর মৃতের ভাই বলেন, আমাদের মহল্লায় গোসল করাতে দেবে না। তাই তখনই শহরের বসুপাড়া কবরস্থানের গোসল খানায় লাশ নিয়ে গেলে সেখানকার দায়িত্বে থাকা রেজাউল জানান, এখানে গোসলের ব্যবস্থা নেই। অনেক অনুরোধ করেও কোনো ফল হয়নি। তখন তিনি নিরালা কবরস্থানের কেয়ার টেকারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনিও সাফ জানিয়ে দেন, সেখানে গোসলের কোনো বন্দোবস্ত নেই। একইভাবে তিনি কেসিসি পরিচালিত নগরীর গোয়ালখালী কবরস্থানে যোগাযোগ করেও কোনো ব্যবস্থা হয়নি। সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে মৃতের নিজ এলাকায় লাশ নেওয়ার উদ্যোগ নেন তিনি।’

ওয়াহিদুজ্জামান আরও জানান, লাশ নিয়ে মানিকতলায় যাবার পর কিছু লোক ওখানে গোসল করাতে দিতে নারাজ। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় কিছু ব্যক্তির সঙ্গে তাদের বাগবিতণ্ডা, এমনকি মারমুখি অবস্থা তৈরি হয়। এক পর্যায়ে তিনি জেলা প্রশাসনের অফিসে ফোন করে সহযোগিতা চান। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। পরে স্থানীয় শহীদ জিয়া কলেজ সংলগ্ন দারোগা মসজিদ চত্বরে তাকে গোসল করানো হয়। এছাড়া মানিকতলা মসজিদ চত্বরে জানাজা শেষে স্থানীয় মহেশ্বরপাশা কালিকাবাড়ী কবরস্থানে মৃত মোহাম্মাদ আলী’র দাফন করা হয়।’

মৃতের ভাই সাইফুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বেলায়েত হোসেনের কাছে পরামর্শ নিতে যাওয়াটাই তাদের ভুল হয়েছে। তিনি বাজার কমিটি ও মসজিদ কমিটিসহ বিভিন্ন লোকের নাম বলে তারাও তার ভাইকে এলাকায় গোসল করাতে দেবে না বলেও জানান তিনি। এমনকি হাসপাতালে লাশ রেখে কয়েক ঘণ্টা পালিয়ে থাকলে হাসপাতালের স্টাফরাই গোসল করিয়ে রাখবে বলেও বেলায়েত পরামর্শ দেন তাকে। এ কারণে প্রথমে তিনি ভাইয়ের লাশ নিয়ে এলাকায় যেতে ভয় পান। কিন্তু দাফন টিমের সহযোগিতায় লাশ নিয়ে গেলে এলাকাবাসীই এগিয়ে আসেন। বেলায়েত ও তার লোকজনের অমানবিক আচরণে তিনি মর্মাহত হয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন।

দাফন টিমে উপস্থিত ছিলেন—  সমন্বয়কারী হাফেজ মো. ওয়াহিদুজ্জামান, মাও. শরীফুল ইসলাম, মাও. ইলিয়াস হোসাইন, মো. আব্দুস সোবহান খান, মাও. আল আমীন, হাফেজ আবু রায়হান, মৌলভী আব্দুল হাই, মো. ওয়াক্কাস আলী, মো. ইমাম হাসান, মো. জাহিদুল ইসলাম, মো. আব্দুল হালিম প্রমুখ।

অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে দাফন টিমের প্রধান সমন্বয়কারী হাফেজ মো. ওয়াহিদুজ্জামান জানান, তারা এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত ৫ জন এবং উপসর্গে মৃত ২ জনের লাশ দাফন করেছেন। কিন্তু গোসল করাতে বাধা দানের মত ঘটনার মুখোমুখি হননি। এটা তাদের নতুন অভিজ্ঞতা। 

 

খুলনা/নূরুজ্জামান/বুলাকী

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়