ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

হালতি বিল : যে জলে আকাশ নেমেছে

সাইফুর রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হালতি বিল : যে জলে আকাশ নেমেছে

প্রকৃতির ছোঁয়া মানুষের মনকে বড় করে তোলে। আকাশ আর সমুদ্রের কাছেই মানুষ বিশালতা শেখে। আর প্রকৃতিমনা মানুষের কাছে সমুদ্র সবসময়ই পছন্দের একটি জায়গা।

সমুদ্রের ঢেউ খেলানো জলরাশি ও মুক্ত বাতাস কে না ভালোবাসে? সাথে যদি থাকে একটি ভাসমান নৌকা আর কিছু বন্ধুবান্ধব তাহলে তো কথাই নেই। মনে হবে যেন স্বর্গের রাজ্যে একটি ফুটন্ত গোলাপে প্রজাপতি বসে তার সৌন্দর্য উপভোগ করছে।

চোখ জুড়ানো সেই রকম একটি স্থান হচ্ছে নাটোর। এটি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত কবি জীবনানন্দ দাসের বনলতা সেন খ্যাত এক ঐতিহাসিক স্থান। এ অঞ্চলে কোনো সমুদ্র নেই ঠিকই। কিন্তু প্রকৃতি হয়তো তাদের সমুদ্রের স্বাদ মেটাতেই এ অঞ্চল জুড়ে দিয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় চলন বিল। আরো দিয়েছে নাটোরের উত্তরে পাটুলে অবস্থিত হালতি বিল। এটি শুধু বর্ষাকালে পানিতে থৈ থৈ করে এবং গড়ে ওঠে একটি মৌসুমী পর্যটন এলাকা। তাই বর্ষাকালে অনেকে ভালোবেসে এ বিলকে মিনি কক্সবাজার নামে ডাকেন।

অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল মিনি কক্সবাজারটি দেখার। পরীক্ষা শেষ, তাই আর দেরি না করে চলে গেলাম সেই কাঙ্ক্ষিত মিনি কক্সবাজারে।

সকাল ৮টায় রওনা দিতে হবে। তাই আগের দিন একটু তাড়াতাড়িই ঘুমালাম। এলার্ম দিয়েছিলাম সকাল ৬ টায়, কিন্তু এতটা উৎসুক ছিলাম যে ঘুম ভাঙলো ৫ টায়।  ‍পূর্ব নির্ধারিত স্থান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসস্টান্ডে গিয়ে দেখি নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সবাই হাজির, যাদের কিনা সকাল ৮/৯ টার আগে ঘুমই ভাঙ্গে না। এবার যাবার পালা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে উঠলাম। বাস যাবে বানেশ্বর পর্যন্ত, সেখান থেকে অন্য কোনো যানবাহনে যাওয়ার ইচ্ছে আমাদের। আমরা ছিলাম দশজন।

ইতোমধ্যে বাস চলতে শুরু করেছে। আহা! কী আনন্দ ভেসে উঠছে একেকজনের চেহারায়! গাড়ি চলছে তার আপন গতিতে। রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়কে মনে হয় যেন আমরা একাই চড়ে বেড়াচ্ছি। বাসের পেছনের দরজায় দাঁড়িয়ে শরতের হাওয়া শরীরে মিশিয়ে নিচ্ছিলাম আমি। কিন্তু বন্ধুরা আমাকে সরানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলো। তাদেরও ইচ্ছে শরতের হাওয়া উপভোগ করার। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বানেশ্বর এসে একটি লেগুনা রিজার্ভ করি, গন্তব্য পাটুল। চলতে শুরু করলো লেগুনা। গাড়ির গতির সাথে তাল মিলিয়ে ড্রাইভারের সাথে আমাদের ভাবটা বেশ বেড়ে গেল। আর সেই গতির সাথে তাল মিলিয়ে চলছে কোরাস গান-‘মন চায় মন চায়, যেখানে চোখ যায় সেখানে যাব হারিয়ে......’।

খুব রোদ পড়ছিলো, কিন্তু বাতাস রোদের প্রখরতা বুঝতে দিচ্ছিল না। পুঠিয়া পার হয়ে গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে ধীরে ধীরে যাচ্ছিলাম, এদিকে রাস্তার অবস্থা ভালো না। চারপাশের সবুজ গাছপালার ভিড়ে আমরা মিশে যাচ্ছি। রাস্তার পাশে ছোট ছোট ঘর, দোকানপাট, কৃষি ক্ষেত, বিভিন্ন ফলের বাগান ইত্যাদি প্রাকৃতিক দৃশ্যে মন ছুঁয়ে যাচ্ছে। আবার রাস্তার পাশে কৃষক-কৃষাণী রোদে পাট শুকোতে দিচ্ছে। সে এক মোহনীয় দৃশ্য! মাঝপথে এসে আমরা গরম গরম রসগোল্লা আর সিঙ্গারা দিয়ে সকালের নাস্তা সেরে নেই। এরপর গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত আঁকাবাঁকা একটি নদীর দেখা পাই। নাম না জানা নদের নাম নিয়ে কথা হচ্ছে। তখনি রাস্তার পাশে থাকা সাইনবোর্ডে দেখতে পাই নদের নাম ‘বারনই’। নদের পাশ দিয়ে গাড়ি চলছে। অপ্রশস্ত রাস্তার পাশে লম্বা লম্বা গাছ যেন আমাদের ছায়া দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছে। আর দেখতে দেখতে প্রায় দেড় ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে চলে আসি আমাদের প্রতীক্ষিত স্থান হালতি বিলে। গাড়ি থেকে নামতেই নৌকার মাঝিদের হাকডাক- ‘ও মামা, আমার নৌকায় আসেন, আমার ছাউনি খুব ভালো…’।

যাইহোক, চারটি গ্রাম ঘুরিয়ে দেখানোর চুক্তিতে আমরা ঘাট থেকে একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকা ভাড়া করি। নৌকা তার যাত্রা শুরু করলো। খুব রোদ পড়ছে তখনও। কিন্তু নৌকার গতি যত বাড়ছে বাতাসের প্রবাহ ততই বাড়ছে। চারিদিকে পানি আর পানি। মনে হচ্ছে আকাশ নেমে এসেছে পানিতে। মন চায় ছুটে গিয়ে আকাশ ছুঁই। চারদিকে যেমন বাতাস বইছে ঠিক তেমনিভাবে সকলের মনে আনন্দের ঝড়ও বইছিলো। নৌকা চলছে আপন গতিতে, আর নৌকার ছাউনির উপর বসে কোরাস গানও চলছে সরবে- ‘দে দে পাল তুলে দে, মাঝি হেলা করিস না.......’।

মাঝি বারবার বলছে কয়েকজন ছাউনির ভেতরে চলে আসতে কিন্তু কে শুনে কার কথা। আমরা দেখছিলাম আকাশ আর পানি কি সত্যি সত্যিই একসাথে মিশে আছে? এদিকে চলছে সূর্য ও মেঘের লুকোচুরি। সূর্যকে ঢেকে দিচ্ছে মেঘ, আবার মেঘ ভেদ করে বেরিয়ে আসছে রোদ। এখানে সূর্য ও মেঘের প্রতিযোগিতা যেন জনম জনম ধরে। লুকোচুরি দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম খাজুরিয়া গ্রামে। সেখানে আমরা দুপুরের ভোঁজ সেরে নিবো ভাবছিলাম। নৌকা থেকে নেমে ভ্যানে চড়ে গেলাম খাজুরিয়া বাজারে। কিন্তু ওই কপাল...! গিয়ে দেখি বাজারের দোকানদাররা মিলে কোথায় জানি ঘুরতে গিয়েছে। কথায় আছে, কপালে যদি না থাকে ঘি, ঠকঠকালে হবে কি? অবশেষে আমাদের কপালে জুটলো কয়েকটা কলা, পাউরুটি আর মাত্রাতিরিক্ত কড়া লিকারের তেঁতো চা। তারপরও এসব আমাদের কাছে অমৃত মনে হচ্ছিল। এ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা।

নাস্তাকে মধ্যাহ্ন ভোজের নামে চালিয়ে খাজুরিয়া গ্রাম ত্যাগ করে নৌকায় উঠি। এবার ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করলো। তখন আর রোদের দেখা নেই। মনে হচ্ছে মেঘ এবার সূর্যকে পরাজিত করেছে, বৃষ্টি নামবে। বাতাস তার গতি বাড়াতে শুরু করলো। দূরে যে বৃষ্টি হচ্ছে তা আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কিছু দূর যাওয়ার পর নিজেরাই ভিজতে শুরু করলাম। ভিজতে ভিজতে পানিবন্দি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে গেলাম। পানিতে ঝাঁপ দেয়ার জন্য বেশ উৎসুক ছিলাম। কিন্তু সুযোগটা হয়ে ওঠেনি। এই বিদ্যালয়ের পাশে এসে যেন সুযোগটা পেয়ে গেলাম। ঠেকায় কে, বন্ধুরা মিলে সবাই একসাথে পানিতে ঝাঁপ...।

সাথে থাকা বান্ধবীরা অবশ্য পানিতে নামে নি। তাদের সাথে সাঁতার না জানা দুইজন বন্ধুও ছিল, সেখানে পানি বেশি ছিল না বলে কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের ঠেলে ফেলার দায়িত্ব নিল বান্ধবীরা। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। কিছুক্ষণ সাঁতার কাটার পর আবার নৌকায় ফিরে গেলাম। নৌকা চলছে তীরের উদ্দেশ্যে। তীরের কাছাকাছি গিয়ে আমরা আবার লাফিয়ে পানিতে, দ্বিতীয়বারের মতো গোসল সারলাম।

এবার আমাদের ফেরার পালা। কিছুক্ষণ ছবি তুলে রওনা দিলাম নীড়ের উদ্দেশ্যে। ফেরার পথে উত্তরা গণভবনে গেলাম। সেই সাথে শেষ হলো একটি স্মৃতিময় দিনের।


রাইজিংবিডি/রাবি/১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯/সাইফুর রহমান/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়