ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ভিন্ন এক শিক্ষকের গল্প

সুমাইয়া জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ৭ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভিন্ন এক শিক্ষকের গল্প

আচ্ছা, শিক্ষক হতে কি প্রাতিষ্ঠানিকতা আবশ্যক? শিক্ষক হতে কি শিক্ষার্থীকে অ আ ক খ শেখাতেই হবে? তবে আমার জীবনের প্রিয় শিক্ষক তো প্রাতিষ্ঠানিক নন, আমি তার কাছে স্বরবর্ণ-ব‌্যঞ্জনবর্ণ শিখিনি। তবু আমার এই জীবনে এখন পর্যন্ত পাওয়া শ্রেষ্ঠ শিক্ষক তিনি।

আমি তখন খুব ছোট। আমার বাবা-মা দু’জনেই ছিলেন ব্যস্ত চাকরিজীবী। সেই অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকই আমাকে নিজের পায়ে হাঁটতে শিখিয়েছেন। বাবা-মা যখন অর্থ উপার্জন ও সংসার পরিচালনার জটিল কাজে ব্যস্ত, আমার ওই শিক্ষকই মুখের আধো আধো বুলিকে পরিপূর্ণতা দিয়েছেন। তিনি আর কেউ নন, আমার দাদা।

যখন একটু বড় হলাম, ছোটদের কবিতার বই দখলে আনার চেষ্টা করি, আমার অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকই আমার অনর্থক উচ্চারণগুলোকে অর্থবহ করার চেষ্টা করতেন।

এবার দাদাকে আমার প্রিয় শিক্ষকের তকমা দেয়ার কারণটা বলি। তখন আমি নিজের পায়ে হাঁটতে শিখছি মাত্র। চলতে চলতে হঠাৎ ভারসাম্য হারিয়ে নরম মাটিতে আছড়ে পড়লে আকুল কণ্ঠে দাদা এসে গায়ের ধুলো ঝেড়ে দিতেন না কেবল, দয়ালু কণ্ঠে বলতেন, 'নিজে উঠতে শেখো'। সেই বারবার দাদার কণ্ঠে শোনা ‘নিজে উঠতে শেখো’ থেকে আমার জীবনের সমস্ত সমস্যাকে শক্ত হাতে নিজেই সামলাতে শিখেছি।

রাতে যখন দাদার কাছে রাজা-রানির গল্প শুনতাম, তখন আমার মন ভালো হয়ে যেতো। গল্প শুনতে শুনতেই শিখেছি আকাশের তারা অগণিত এবং জানা-অজানা সব তথ‌্য। ছাত্রজীবন শুরুর আগেই দাদার কাছেই সূর্যের চারদিক দিয়ে পৃথিবীর ঘূর্ণনের রহস্য জেনেছি। গাছেরও যে প্রাণ আছে, সেটাও জেনেছি।

একটা ঘটনা মনে পড়ে। তখন ছাত্রজীবন শুরু করেছি মাত্র। চতুর্থ শ্রেণি পার করে পঞ্চম শ্রেণিতে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এক বিকেলে দাদার সাথে বেড়াতে গেছি বাড়ির পাশের একটি মাঠে। নিউটনের মাথায় আপেল পড়ার গল্প শুনতে শুনতে দাদার হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। গল্পের মধ‌্যে দাদা কাকে দেখে যেনো বেশ আপ্লুত হয়ে উঠলেন। হাসতে হাসতে বেশ কিছুক্ষণ গল্প সেরে পকেট থেকে ২০ টাকার একটি নোট বের করে তাঁকে দিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলেন। আমি তখন বেশ অস্বস্তি বোধ করছি। কারণ, দাদার গল্পের সেই সঙ্গী ছিলেন তৃতীয় লিঙ্গের বয়স্ক একজন মানুষ। মুখ ভার করে জিজ্ঞেস করলাম, দাদু তুমি কেনো ঐ হিজড়ার সাথে এত গল্প করলে? আমার দাদার উত্তর ছিল, ‘মানুষকে মানুষ হিসেবে চিনতে শেখো, শারীরিক বৈশিষ্ট‌্য দিয়ে নয়’। সেই থেকে আমার আশেপাশে যত ভিন্ন লিঙ্গের, ধর্মের বা ভিন্ন বৈশিষ্ট‌্যের মানুষকে দেখি, মনের মধ্যে দাদার প্রতি শ্রদ্ধার মাত্রাটা আরো বেড়ে যায়।

অক্ষরের শিক্ষা না দিলেও দাদা আমাকে দিয়েছেন জীবনের বহু মূল্যবান মানবিক শিক্ষা। একজন উন্নত দৃষ্টিকোণের মানুষ হয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার মন্ত্র আমাকে শিখিয়েছেন দাদা। এখন এই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসেও তাঁর শেখানো শিক্ষার মূল্য বুঝতেছি পদে পদে।

এরপর ধীরে ধীরে আমি বড় হতে লাগলাম। সার্বিক ব্যস্ততা বাড়ার সাথে সাথে দাদার সঙ্গে আমার দূরত্বটা যেনো বাড়তে লাগলো ক্রমশ। এরই মধ্যে দাদার হৃদযন্ত্রটা আড়ি করে বসে দাদার সাথে। দাদা কষ্ট পেতেন, বুঝতে দিতেন না।

আমাকে কাছে পেতে চাইতেন। হয়তো কোনো গল্প শোনাতে চাইতেন। কিন্তু তখন আমি জীবনের দুরন্ত স্রোতে গা ভাসিয়ে এগিয়ে চলেছি। কিছুক্ষণ থমকে থেকে দাদার কাছে গল্প শোনার সময় কই?

দিনটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। ২০১০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখি উঠানে বহু মানুষের সমাগম, থমথমে পরিবেশ, কান্নার রোল। বুকটা ধক করে ওঠলো। দাদার মুখটা সরাসরি সেই শেষ দেখা।

এখন শুধুই মনে হয়, দাদা হয়তো আমাকে জীবনের আরো গুরুত্বপূর্ণ কোনো গল্প শোনাতে চেয়েছিলেন। সে গল্প আমার অজানাই থেকে গেলো।

এরপর পার করলাম ৯ টি বছর। এর মধ্যে কত যে শিক্ষকের ছাত্রী হয়েছি, তার হিসাব নেই। কিন্তু জীবনে প্রতি ক্ষেত্রে যখনই কোনো কঠিন সময়ের মুখোমুখি হই, দাদার শেখানো কথাগুলো কানে বাজতে থাকে বারবার। যেনো সর্বদাই দাদা বলছেন 'ভয় পেয়ো না, ভয়কে জয় করতে শেখো'।

যে যাই বলুক, প্রিয় শিক্ষকের কথা বলতে হলে 'মোমতাজউদ্দিন' নামটা আমার মনে আসবে আমৃত্যু। আজকে এই শিক্ষক দিবসে তাই আমি আমার অন্য শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে 'প্রিয় শিক্ষক' এর জায়গায় দাদাকেই দাঁড় করাবো। কারণ, তাঁর হাত ধরেই গড়ে উঠেছে আমার শিক্ষার ভিত।

শুধু একটাই আফসোস থেকে গেলো। মাঝে মাঝে শুধু মনে হয়, 'দাদা বুঝি কোনো গল্প বলতে চেয়েছিলেন'।

লেখক: শিক্ষার্থী, জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ‌্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।



এসইউবি/সুমাইয়া জামান/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়