ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ভাবছিলাম, গল্পটা এখানেই শেষ

মারুফ হুসাইন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ৬ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভাবছিলাম, গল্পটা এখানেই শেষ

রামপুরা ব্রিজের পাশ থেকে দুটি ভাপা পিঠা কিনেছি৷ একটু ভেঙে মুখে দিয়ে আর খেতে ইচ্ছে করেনি৷ রাস্তা পার হয়ে এক বৃদ্ধ রিকশাওয়ালাকে পিঠা দুটি দিয়ে দিলাম। ভেবেছিলাম, বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা রিকশার উপর আরাম করে বসে পিঠা খাবেন৷ আমি কয়েক কদম সামনে গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, আমার ভাবনা ভুল। তিনি পিঠা খাননি। সিটের নিচে রেখে দিয়েছেন।

মনে প্রশ্ন জাগল, না খেয়ে রেখে দিলেন কেন? নিশ্চই এর পেছনে একটা গল্প আছে৷ আবেগ আছে। ভালোবাসা আছে৷ মায়া আছে।

কিন্তু সে গল্প, আবেগ, ভালোবাসা শোনার মতো সময় তো আমার নেই। আমি নিজের গল্প নিয়েই ব্যস্ত। আমরা শহুরেরা নিজের গল্প নিয়েই ব্যস্ত থাকি৷ অন্যের গল্প শোনার সময় আমাদের হয় না৷

এই শহরের প্রতিটা অলি-গলিতে হাজারটা গল্প ঘুরে বেড়ায়৷ হাসির গল্প, দুঃখের গল্প, ভালোবাসার গল্প। আরো হরেক রকমের গল্প। এই শহরের মানুষের প্রতিটা মুহূর্তই একেকটা গল্প।

কিন্তু এই শহর ব্যস্ততার শহর, স্বার্থপরের শহর৷ সবাই যার যার নিজের গল্প নিয়েই ব্যস্ত। অন্যের গল্প শোনার বা দেখার সময় বা আগ্রহ কোনোটাই কারো হয় না৷ নিজের স্বার্থ ছাড়া এক মুহূর্তও কারো কোথাও দাঁড়ানোর সময় থাকে না।

সেদিন সিটের নিচে পিঠা রেখে দেয়ার মধ্যে রিকশাওয়ালার যে আবেগ, ভালোবাসার গল্প ছিল, তা আমার জানার আগ্রহ তৈরি হয়নি৷ এই স্বার্থপর আর অকৃতজ্ঞের শহরে কারো গল্প শুনেই বা কী লাভ।

আমার এই চিন্তার মতো করে সবাই ভাবে বলেই হয়তো এটি স্বার্থপর আর অকৃতজ্ঞের শহর হয়ে উঠেছে৷ শহরটা এমন হওয়ার পেছনে আমি, আপনি এবং আমরা সবাই দায়ী।

আমি পিঠা আর বৃদ্ধ রিকশাওয়ালার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম৷ তার আবেগটা আমার কাছে তুচ্ছ বলেই হয়তো ভুলে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম, গল্পটা এখানেই শেষ। কিন্তু একদিন বৃদ্ধ নিজেই আমাকে মনে করিয়ে দিলেন।

সেদিন মালিবাগ থেকে বাসায় ফেরার সময় বাসাবো বিশ্বরোডে কোনো অটোরিকশা/বাইক ছিল না৷ অটোওয়ালারা ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে ধর্মঘট করেছে৷ তাই বাসায় ফেরার একমাত্র মাধ্যম ছিল রিকশা। অন্য দিন বাসাবো থেকে আমার এলাকার রিকশা ভাড়া ৩০ টাকা। কখনো কখনো ২৫ টাকাতেও আসা যায়। কিন্তু ন্যায্য ভাড়া ৩০ টাকাই।

আজ আমার পকেটে ২৫ টাকাই ছিল। কিন্তু অটোওয়ালাদের ধর্মঘটের সুযোগ নিয়ে রিকশাওয়ালারাও ৫০ টাকা ভাড়া চাচ্ছে৷ বেশ ক'টা রিকশাকে জিজ্ঞেস করেও হতাশ হলাম৷ কেউ ২৫ টাকায় যাবে না৷ শেষে হতাশ হয়ে যখন বাসার উদ্দেশে হাঁটা দিয়েছি, তখন এক রিকশাওয়ালা এগিয়ে এসে বলল, ‘মামা আজকে কেউ ৫০ টাকার কমে যাইবো না৷’

‘তাইলে আর কী করার! হেঁটেই যেতে হবে।’

‘ওঠেন মামা। ২৫ টাকাই দিয়েন।

আমি রিকশায় উঠে বসলাম। রিকশাওয়ালা প্যাডেল মেরে বলল, ‘মামা! আমারে চিনছেন?’

‘না মামা চিনতে পারি নাই।’

‘ঐদিন যে রামপুরা পিঠা দিছিলেন৷’

‘ওহ, আচ্ছা৷ আপনাকেই দিয়েছিলাম?’

‘হ মামা! ঘরে ছোট দুইটা নাতি-নাতনি আছে। ওগো বাপ নাই। আমারই পালতে হয়৷ প্রতিদিন যা পাই তা খাওন খরচ, জমা আর ঘরের বাজার কইরাই শেষ হইয়া যায়৷ চাইলেও নাতি-নাতনির লাইগা কিছু লইয়া যাইতে পারি না। আপনার পিঠাগুলা ওদের লাইগা নিয়া গেছিলাম৷ ওরা অনেক খুশি হইসে।’

‘আপনাকে পিঠাগুলা সিটের নিচে রাখতে দেখেছিলাম৷ আমার মনেও প্রশ্ন জেগেছিল, না খেয়ে তা রেখে দিচ্ছেন কেন? কিন্তু তাড়া থাকায় আর জিজ্ঞাসা করা হয়নি।’

রিকশাওয়ালা প্যাডেল মারছেন৷ শহরে শীত এসেছে বহু আগেই। তারপরও তার কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে।

আমি এই শহরকে স্বার্থপর আর অকৃতজ্ঞের শহর হিসেবেই জানি। এই শহরের প্রতিটা মানুষকেই আমার কাছে স্বার্থপর মনে হয়৷ এখানে কেউ কারো নয়। সবাই নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। সবাই নিজের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্য নিয়েই প্রবেশ করে৷ তাই নিজের স্বার্থ ছাড়া কেউ কিছুই দেখতে চান না। কেউ কারো জন্য কিছু করলেও নিজের স্বার্থের জন্যই করে৷ আবার যার জন্য করা হয়, সেও অকৃতজ্ঞ হয়ে থাকে।

কিন্তু আমি নিজেকে ভুল ভাবতে বাধ্য হলাম৷ এই শহরের সবাই অকৃতজ্ঞ নয়। কেউ কেউ অল্পতেও অনেক কৃতজ্ঞ হয়ে পড়ে৷ এই বৃদ্ধ রিকশাওয়ালাও তেমনি একজন। অল্পতেই কৃতজ্ঞ হয়ে যায়। আমি রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিতে গেলেই বলল, ‘মামা, আরেকদিন দেখা হইলে দিয়েন৷ আপনার পকেটে তো ২৫ টাকাই আছে। রাইখা দেন৷ এদিকেই তো রিকশা চালাই৷ যেদিন বেশি থাকবো, দেখা হইলে দিয়েন।’

‘আপনাকে কে বলল আমার কাছে ২৫ টাকাই আছে?’

‘আপনারে ক্লান্ত দেখা যাইতেছে। কিন্তু আজকে অটো নাই৷ তারপরও আপনে কাউরেই ২৫ টাকার বেশি ভাড়া কন নাই। তাই মনে হইলো।’

আমি হেসে বললাম, ‘ঠিকই ধরেছেন। কিন্তু আপনি ২৫ টাকা ভাড়া রাখেন।’

‘না, মামা৷ আরেকদিন দেখা হইলে দিয়েন, বলেই প্যাডেল মেরে চলে গেলেন। আমি অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম...

লেখক: শিক্ষার্থী, বিজ্ঞান বিভাগ, কবি নজরুল কলেজ।

 

ঢাকা/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়