ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

অনন্য বাতিঘর অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাক

জুয়েল মামুন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২২, ১১ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অনন্য বাতিঘর অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাক

পদার্থবিজ্ঞানে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এবং একমাত্র প্রফেসর ইমেরিটাস অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাক। তিনি চাইলেই ইংল্যান্ডে বিলাসী জীবন বেছে নিতে পারতেন। ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেয়েছিলেন। কিন্তু দেশমাতৃকার সেবায় সেই সুযোগ তুচ্ছজ্ঞান করে ফিরে এসেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সেন্টারের যাত্রা শুরু হয়েছে তাঁর হাত ধরে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি।

প্রাজ্ঞজন অরুণ কুমার বসাকের জন্ম, বেড়ে ওঠা পাবনা জেলায়। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। এক বোন আমেরিকার হিউজস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক। ছোট ভাই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ইন্সপেক্টর অব কলেজেস পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। সম্প্রতি তিনি অবসর নিয়েছেন।

অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাকের বাবা ১৯৪৭ সালের আগে ভারতের মালদায় চাকরি করতেন। ১৯৫৪ সালে তাদের সেখানেই চলে যাওয়ার কথা ছিল। সেবছর বঙ্গবন্ধু এবং মাওলানা ভাসানী নির্বাচনী প্রচারণায় পাবনা গিয়ে বক্তৃতা দেন। বক্তৃতায় পাকিস্তান সরকার যে ধর্মের নামে মিথ্যাচার করছে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেন। বক্তব্য শোনার পর তারা দেশ ত্যাগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন।

অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাকের ম্যাট্রিকের ফল আশানুরূপ হয়নি। যদিও থেমে যাওয়ার পাত্র তিনি ছিলেন না। ১৯৫৭ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হন । ১৯৫৯ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় রাজশাহী বোর্ডের সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় হন। তখন অনার্স কোর্স ছিল দুই বছরের। রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৬১ সালে অনার্স শেষ করেন। সেই সময় রাজশাহী কলেজ ছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বা অধীনস্ত অন্য কোনো কলেজে ফিজিক্সে অনার্স ছিল না। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএসসি পড়তে শুরু করেন। অনার্সের মতো মাস্টার্সেও তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন।

১৯৬৩ সালের ডিসেম্বরে পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। ফল প্রকাশিত হওয়ার পরদিন তার জীবনে ঘটে অপ্রত্যাশিত আনন্দময় ঘটনা। তার শিক্ষক অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘যাও, ক্লাস নাও।’ অরুণ কুমার বসাকের জীবনের বৃহত্তর অধ্যায় শুরু হয়েছিল এখান থেকেই।

তিনি মাস্টার্সে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদে সর্বোচ্চ নম্বর (৭৬ শতাংশ) পাওয়ার পুরস্কার হিসেবে লন্ডনে উচ্চশিক্ষার একটি বৃত্তি পান। তখন অবশ্য তিনি যেতে পারেননি। পাকিস্তান সরকার তাঁর বিরুদ্ধে প্রগতিশীল আন্দোলনে যুক্ত থাকার অভিযোগ এনে পাসপোর্ট জব্দ করে। তাই লন্ডনের ইমপেরিয়াল কলেজে পড়তে যাওয়ার স্বপ্ন অধরা থেকে যায়। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, শুধু সে বছরই নয়, ১৯৭২ সালের আগ পর্যন্ত প্রতিবারই স্কলারশিপ পেলেও পাসপোর্ট জব্দ থাকায় লন্ডনে যাওয়া সম্ভব হয়নি তাঁর।

১৯৬৪ সালে চীনের একটি সিম্পোজিয়ামে অরুণ কুমার বসাকের থিসিস-এর টপিক নিয়ে আলোচনা হলে পাকিস্তানের গণমাধ্যমে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। কিন্তু অবাক বিষয়, সেই পাকিস্তানই তাকে বিদেশ যেতে দেয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে নতুন পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়। সে বছরই তিনি কমনওয়েলথ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট স্কলারশিপ নিয়ে ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচ.ডি করতে যান।

কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে তিনি বার্মিংহামে গিয়ে নিজেকে প্রমাণ করেন। সেখানে তিনি সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে নিজের জাত চিনিয়েছেন। দুনিয়ার একমাত্র পোলারাইজড হিলিয়াম সোর্স ছিল বার্মিংহামেই। সে বিষয়ে কাজ করেছেন। ‘নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’ ও ‘ফিজিক্যাল রিভিউ’ জার্নালে তাঁর গবেষণা প্রকাশিত হয়েছিল। অরুণ কুমার বসাকের হাত ধরে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সেন্টারের যাত্রা শুরু হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কম্পিউটার সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা প্রশাসক হিসেবে ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানে কাজ করেছেন। তিনি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন। ১৯৭১ সালে ভারতে বিবেকানন্দ কলেজে পড়িয়েছেন ছয় মাস। যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ইলিয়নস ইউনিভার্সিটিতে রিসার্স প্রফেসর হিসেবে একাধিকবার কাজ করেছেন। ‘ইনস্টিটিউট অব ফিজিক্স, লন্ডন’, ‘বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স’ ও ‘বাংলাদেশ ফিজিক্যাল সোসাইটি’র আজীবন সদস্য এবং ‘আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটি’রও সদস্য তিনি। এ পর্যন্ত বিদেশের বিভিন্ন বিখ্যাত জার্নালে ১০০টি প্রকাশনা প্রকাশিত হয়েছে তার। ‘বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স’ স্বর্ণপদক পেয়েছেন তিনি। তার নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা বৃত্তি চালু হয়েছে।

তিনি এই বয়সেও সারা দিন ল্যাবে থাকেন। সকাল নয়টায় ল্যাবে আসেন, বাসায় ফিরে যান সন্ধ্যায়। শুক্র-শনিবারও  তিনি ল্যাবে আসা বাদ দেন না ।

অরুণ কুমার বসাকের সাদাসিধে জীবন পছন্দ। সারাজীবন চেয়েছেন পদার্থবিজ্ঞানের সাধনায় কাটিয়ে দিতে। হাজার কৃতী শিক্ষার্থী গড়েছেন তিনি। অথচ এই বয়সে এসে এখনও তিনি নিজেকে একজন বৃদ্ধ ছাত্র মনে করেন।

লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

 

রাবি/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়