ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ০২ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৯ ১৪৩১

নারীর প্রতি সহিংসতা: বদলাতে হবে পুরুষকে

সুশীল মালাকার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০২, ১২ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নারীর প্রতি সহিংসতা: বদলাতে হবে পুরুষকে

মেলার মধ্যে কিংবা বড় কোন ভিড়ের মধ‌্যে নারীর স্পর্শকাতর স্থানে হাত দেন বা দেয়ার চেষ্টা করেন এমন এক শ্রেণির পুরুষ আছে আমাদের দেশে। এরা মূলত সম্ভাব্য ধর্ষক। সুযোগের অভাবে সৎ। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে এরকম এক শ্রেণির বন্ধুর সঙ্গে আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছে। তাদের প্রতিমুহূর্তের আলাপ-আলোচনার উপাদেয় বিষয় নারীর শরীর।

কিশোর বয়সে এলাকায় এক শ্রেণির বড় ভাইদের দেখেছি যারা আশপাশের কোন মেলা কিংবা ধর্মীয় অনুষ্ঠান অর্থাৎ ভিড় পেলেই দল বেঁধে ঘুরতে যেত। তাদের ঘোরাঘুরি করার সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ স্থান ছিল মেলার মধ্যে কসমেটিকস-এর দোকানগুলো যে গলিতে তার আশপাশে। তারা অপেক্ষা করতো কখন ভিড় জমবে আর মেয়েদের স্পর্শকাতর স্থানে হাত দিয়ে তারা বিকৃত যৌন লালসা চরিতার্থ করবে।

সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং আঁতকে ওঠার মত বিষয় হলো এমন মন-মানসিকতাসম্পন্ন লোকজন দ্বারা বাংলাদেশের নিরক্ষর অঞ্চলগুলো পরিপূর্ণ। তারা মনে করে ‘মাইয়া মানুষ হইল কাম-বাসনার বস্তু। এরা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করছে পুরুষদের যৌন বাসনা মেটানোর জন্য আর রান্না-বান্না করে খাওয়ানোর জন্য।’

তাদের এই বিকৃত ধারণার পরিবর্তন আসে তখনম যখন সে নিজে মেয়ে সন্তানের বাবা হয়। কিন্তু তাতেও আসলে কোন লাভ হয় না। কারণ ইতোমধ্যে ঐ পুরুষটির সংস্পর্শে যত পুরুষ এসেছে তারাও তার বিকৃত পুরুষতান্ত্রিক মন-মানসিকতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। অতীতে তার হাতেই পর্যায়ক্রমে তৈরি হয়েছে শত শত সম্ভাব্য ধর্ষক।

কিশোর বয়সে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আমি এই পোটেনশিয়াল ধর্ষক মন-মানসিকতার লোকজনদের এড়িয়ে চলেছি। এক মিনিট কথা বললেই বুঝে যেতাম এই ব্যক্তি সম্ভাব্য ধর্ষক। তিনি এখনো সুযোগের অভাবে সৎ আছেন।  হুট করেই সম্ভাব্য ধর্ষকদের চিনে ফেলার একটি সামাজিক বৈশিষ্ট আমার আছে। আমার মায়ের পাঁচ মেয়ে। অর্থাৎ আমার পাঁচ বোন। জন্মের পর থেকেই আমার বাবা-মাকে দেখেছি বোনদের নিরাপত্তা নিয়ে সবসময় শঙ্কিত থাকতে। নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে পড়ালেখা বন্ধ করে অল্প বয়সেই আমার সামনে বোনদের বাল্যবিবাহ দিতে দেখেছি। মেয়েদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা উচিৎ এবং উচিৎ নয় সেটি আমার বাবা-মা আমাকে ছোটবেলায় শিখিয়ে দিয়েছেন।

পরিবারই আমাদের শিক্ষার প্রাথমিক স্তর। কিছুদিন আগে গ্রামে গিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেই বুঝতে পারলাম আমার কিশোর বয়সে দেখা সেই ধর্ষক মন-মানসিকতাসম্পন্ন লোকগুলোর মানসিকতায় এখনো পরিবর্তন আসেনি। তারা এখনো সেরকমভাবে সেই নির্দিষ্ট বয়সে বেড়ে উঠছে। তারা এখনো মেলায় গিয়ে কসমেটিকস-এর গলিতে ভিড়ের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ায়। সুযোগ খোঁজে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মাদক। ফলে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে।

বাংলাদেশে যেমন আছে দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল, তেমন আছে দুর্যোগপূর্ণ সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল। সেই দুর্গম এবং দুর্যোগপূর্ণ জায়গায় একজন নিরক্ষর যুবতী নারী ধর্ষিত হলে পুলিশের কাছে গিয়ে কখনোই সাহস করে বলতে পারে না- আমাকে ধর্ষণ করা হয়েছে, কিংবা পুলিশের কাছে গিয়ে জানানোর প্রয়োজন বোধ সে করে না লোকলজ্জার ভয়ে। পরিবারও অনেক সময় বিষয়টি ধামাচাপা দিতে তৎপর হয়ে ওঠে।

গ্রামের একজন গরিব মহিলা মানুষ পুলিশের কাছে  যাওয়াটাকে ঝামেলা মনে করেন। ভয়ও পান। ফলস্বরূপ এই সমস্যাগুলোর সমাধান করেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বাররা। তারা ধর্ষককে কিছু টাকা জরিমানা করে কিংবা ধর্ষকের সাথে ভিকটিমকে বিয়ে দিয়ে দেন। গ্রামের প্রান্তিক গরিব মানুষেরা পুলিশকে কিংবা বাইরের কাউকে এসব ঘটনা জানায় না। কারণ তারা মনে করে এসব লোক জানাজানি হলে মেয়েটিকে কোনভাবেই বিয়ে দেয়া যাবে না। কিছুদিন আগে গ্রামে একজন ভিকটিমের বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই ঘটনা পুলিশকে আগে জানাননি কেন। তিনি বললেন, ‘ধর্ষিত হইছে জানলে মাইয়ার বিয়া হবে না।’

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সলিশ কেন্দ্র (আসক) এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ১৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৩২ জন৷ অর্থাৎ, গত বছরের তুলনায় ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ যা ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি৷  ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮১৮ জন নারী৷ এদিকে ২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে৷ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০জন নারী৷

নারীর প্রতি সহিংসতার অন্য চিত্রগুলোও ভয়াবহ৷ ২০১৯ সালে যৌন হয়ানারীর শিকার হয়েছেন ২৫৮ জন নারী৷ ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিলো ১৭০ জন৷

২০১৯ যৌন হয়রানীর শিকার ১৮ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন৷ প্রতিবাদ করতে গিয়ে চারজন নারীসহ ১৭ জন হত্যার শিকার হয়েছেন৷ যৌন হয়রানীর প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৪৪ পুরুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন৷ এই হিসাবটি করা হয়েছে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে। তার মানে ধর্ষণের বাস্তব পরিস্থিতি কতটা ভয়ঙ্কর- ভাবা যায়!

এসব জানার পর বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ স্বপ্নবাজ তরুণদের কষ্ট লাগে, আক্ষেপ জাগে মনে। তাদের মনে হতে থাকে, সৌরজগতের তৃতীয় গ্রহের একটি ভুল স্থানে, ভুল মানুষে পরিপূর্ণ একটি সভ্যতায় যেন জন্ম হয়েছে তার। মেগাসিটিতে অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে এই শহরে। ধর্ষককে ফাঁসি দিলেই দেশে ধর্ষণ কমে যাবে ভেবে যারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে চাইছেন তাদেরকে বলছি, গ্রামে বেড়ে ওঠা লক্ষ লক্ষ সম্ভাব্য ধর্ষকদের আপনি কীভাবে নিবৃত্ত করবেন? যারা সংবাদপত্র পড়ে না, নিউজ দেখে না। যারা মনে করে নারীর প্রতি যৌন আকাঙ্ক্ষা আমার জন্মগত অধিকার। এখন তাদের মানসিকতা বদলানোর সময়।

পারিবারিকভাবে এর সূচনা হওয়া জরুরি। এরপর স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ‌্যালয়েও প্রয়োজনে নিতে হবে ক্লাস। নিয়োগ দিতে হবে মানসিক চিকিৎসক। যারা এই ভুল ধারণা দূর করতে সাহায‌্য করবেন।

সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম বলেছেন, ‘যখন একটি সমাজে কোন নেগেটিভ অ‌্যাকশন বেড়ে যায় তখন সেই নির্দিষ্ট অ‌্যাকশনের জন্য কিছু জোরালো রি-অ‌্যাকশন সেট করে দিতে হয়, যার প্রভাবে সমাজ এবং সমাজের ব্যক্তিগণ একটি নির্দিষ্ট নৈতিক ভারসাম্যে চলে আসে।" এই মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়ার বাঙালিদের সামনে দুটি পথ খোলা আছে বলে আমি মনে করি। অর্থাৎ আমরা দুটি কাজ করলে এই ধর্ষণ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারি। একটি Micro Level এর কাজ আরেকটি Macro Level এর কাজ। যার মাধ্যমে আমাদের এই পঁচে যাওয়া সমাজে কিছু পরিবর্তন আসলেও আসতে পারে।

প্রথমত, ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করতে হবে এবং এই ক্রান্তিকালীণ মুহূর্তে সংসদ অধিবেশনের মাধ্যমে আইনটি প্রনয়ন করতে হবে। ধর্ষণ করলে তার শাস্তি যে মৃত্যুদণ্ড এই বার্তাটি বাংলাদেশের সকল শ্রেণিপেশার মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। ভিক্টিমকে কখনই ধর্ষিত/ধর্ষিতা বলা যাবে না। এই শব্দটি ভিক্টিমের জন্য অস্বস্তিকর। এক বছরের মধ্যেই এর সুফল আমরা পাব। প্রথম বছরেই আমাদের দেশে ধর্ষণের ঘটনা এক তৃতীয়াংশে নেমে আসবে। নারীর প্রতি এসিড নিক্ষেপের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার পর এদেশে এখন আর কেউ এসিড মারে না।

দ্বিতীয়ত যে কাজটি আমাদের করতে হবে সেটি মাইক্রো লেভেলে। এই দায়িত্বটি দেশের প্রতিটি বাবা-মায়ের। তারা যদি ছোট থেকেই তাদের সন্তানকে সেক্স এডুকেশন সম্পর্কে ধারণা দেয়, তাদেরকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে- ছেলেমেয়ে আলাদা কোন জিনিস না। নারী এবং পুরুষ একটি সামাজিক ধারণামাত্র। নারী এবং পুরুষের মধ্যে সামান্য কিছু অঙ্গগত পার্থক্য ছাড়া আর কোন পার্থক্য নেই। নারীর সম্মতির বিরুদ্ধে তার সাথে কোন প্রকার অপ্রত্যাশিত আচরণ করা যায় না। তাহলে পরিস্থিতির পরিবর্তন আসতে পারে।

পৃথিবীর উন্নত দেশের মানুষের ধারণা বাঙালি হচ্ছে একটা অভদ্র জাতি যারা খুব অশিক্ষিত এবং অসভ্য। বিশ্বের বুকে স্বসম্মানে মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য এই ৪৯ বছর বয়সী বাংলাদেশের মানুষদের সামাজিক পর্যায়ে অনেক কিছু করতে হবে। উদ্যোগ নিতে হবে। আমার বিশ্বাস, এখনই এদেশের বাবা-মায়েরা সন্তানের প্রতি উপরোক্ত কাজগুলো করলে এর সুফল আমরা আগামী দশ বছরের মধ্যেই পাব। একটি বিশুদ্ধ প্রজন্ম বেড়ে উঠবে বাংলাদেশে।

ধর্ষণ বাংলাদেশের একটি ঘৃণ‌্য সমস্যা। বর্তমান সময়ের লক্ষ লক্ষ তরুণ একদিন পুরুষ থেকে বাবা হবে। তাদের কন্যা সন্তান থাকবে। সেই প্রজন্মের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তরুণদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে জোড়ালো জনমত গড়ে তুলতে হবে। নারীর জন্য নিরাপদ বাংলাদেশ গঠনের লক্ষে আশপাশের অসচেতন মানুষগুলোকে সচেতন করতে হবে।



ঢাবি/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়