ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ০৯ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৬ ১৪৩১

গবেষণার অভাবে উচ্চশিক্ষার মান নিম্নমুখী

আহমেদ ফাহিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪৮, ১২ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গবেষণার অভাবে উচ্চশিক্ষার মান নিম্নমুখী

উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রবেশ করেন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা। এজন্য মেধার পরিচয় দিয়ে উত্তীর্ণ হতে হয় ভর্তি পরীক্ষায়। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান উৎপাদন করে, বিভিন্ন প্রকাশনার মাধ্যমে সেই জ্ঞান সংরক্ষণ করে, পাঠদানের মাধ্যমে জ্ঞান বিতরণ করে। যখন এভাবে দু’পক্ষের জ্ঞানের সমন্বয় ঘটে, কেবল তখনই উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন হয়।

কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেখা যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। এখানে শুধু পুরনো জ্ঞান বিতরণ হচ্ছে, নতুন জ্ঞানের আবিষ্কার খুবই বিরল। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ২০১৯ সালের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি, বেসরকারি এবং আন্তর্জাতিক মিলিয়ে মোট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৫০টি। এর মধ্যে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ৪৫টি, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ১০৩টি এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় ২টি।

প্রতি বছর এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় শিক্ষার্থীরা। কিন্তু দেখা যায় এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হয়ে পরিপূর্ণ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় শিক্ষার্থীরা। আর এর প্রভাব পড়ে কর্মক্ষেত্রে। পরিপূর্ণ শিক্ষার অভাবে ভালো প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করা শিক্ষার্থীরা। ফলে, দেশে শিক্ষিত বেকারের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, দেশে নারী-প্ররুষ স্বল্পশিক্ষিত ও অশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৭৭ হাজার।

প্রযুক্তি নির্ভর যুগে প্রযুক্তির জ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ে কম দেয়া হয়। ফলে, প্রযুক্তি নির্ভর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সুযোগ কম। এর প্রভাব পড়ে এদেশের শিক্ষাব্যবস্থায়। ফলে উন্নত শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যায় এখানকার শিক্ষার্থীরা এবং দেশে উপযুক্ত কর্মক্ষেত্রের অভাবে বিদেশে স্থায়ীভাবে থেকে যায় অনেকে। ইউনেস্কোর  পরামর্শ হলো, শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হবে জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ২০ শতাংশ এবং জিডিপির ৬ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো সেই লক্ষ্যমাত্রা থেকে দূরে অবস্থা করছে।

২০১৯-২০২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটেও শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে মোট বাজেটের শতকরা ১৫ দশমিক ২ শতাংশ বা প্রায় ৭৯ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। এই বরাদ্ধ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।

একটি উন্নত জাতি ও উন্নত দেশ গঠনে প্রযুক্তিগত, গবেষণাধর্মী ও কারিগরি শিক্ষা খুবই জরুরি। আমাদের দেশে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের মধ্যে চাকরি করার প্রবণতা বেশি, উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা খুবই কম। কেননা, উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পান না এখানকার শিক্ষার্থীরা। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত গবেষণা না হওয়ায় বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ে অনেক পিছিয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাজেটের বেশির ভাগ ব্যয় হয় উন্নয়ন কাজে, গবেষণা খাতে বরাদ্দ খুবই কম।

২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৫ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বাজেট অনুমোদন করা হয় ৮ হাজার ৮৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে অনুন্নয়ন বাজেট ৫ হাজার ৮৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। ৩৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গবেষণা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৬৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা, যা অনুন্নয়ন বাজেটের ১.২৬ শতাংশ। প্রতি বছরই কমেছে গবেষণায় বরাদ্দের হার।

ইউজিসির ২০১৮ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রকাশনা নেই, সরকারি ৬টি ও বেসরকারি ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে কোনো ব্যয় নেই। যেখানে বিশ্বের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে, সেখানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা খাতে সরকারি বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল।

বেসরকারিভাবে গবেষণার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রণোদনা নেই। অথচ, বিশ্বের অনেক দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার বাজেটের বড় অংশ আসে বেসরকারি খাত থেকে। ফলে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মৌলিক গবেষণা তেমন একটা হচ্ছে না। বাংলাদেশের প্রধান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণায় কিছু বরাদ্দ রাখে, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক তাই গবেষণার চেয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে অধিক অর্থ উপার্জনে আগ্রহী। আবার গবেষণায় বরাদ্দ দেয়া হয় রাজনৈতিক পরিচয় এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে। ফলে, অনেক মেধাবী শিক্ষক হয়তো গবেষণা করতে চেয়েও প্রকল্প পাচ্ছেন না। এভাবে সরকারি বরাদ্দের অপ্রতুলতা, বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, বরাদ্দ অর্থের যথাযথ বণ্টন-মনিটরিং-মূল্যায়নের অভাবে মানের গবেষণা হচ্ছে না। ফলে, উচ্চশিক্ষার মানও ক্রমান্বয়ে নিম্নমুখী হচ্ছে।

নতুন বছরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো অতীব জরুরি। আর যে গবেষণা হচ্ছে বা হবে, সেটা যেন মানসম্মত হয়। আসল মেধাবীরাই যেন এর দায়ীত্ব পান। সাথে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করা শিক্ষার্থীদের বেকারত্বের হাত থেকে মুক্তির জন্য প্রদক্ষেপ নেয়া হোক।

লেখক: শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

 

নোবিপ্রবি/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়