ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

যে শিক্ষা ব্যবস্থার বলি শিশুরা

অরিত্র দাস || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৯, ১৩ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যে শিক্ষা ব্যবস্থার বলি শিশুরা

সোজা হয়ে হাঁটতে পারার আগে আমাদের শিশুদের স্কুলের আঙ্গিনায় পাঠানো হয়। কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হয় মস্ত বড় ভারী ব্যাগ। অ আ ক খ লিখতে না পারলে দেখানো হয় ভয়ভীতি। ‘ম’ যে একটি ব্যঞ্জনবর্ণ, সেটি না শিখিয়ে বলা হয়- মুখস্থ করো।

অতঃপর মুখস্থ করার ক্ষমতা দিয়ে একজন শিশুর মেধা মূল্যায়ন করা হয়, বুদ্ধি-বিচক্ষণতা-সৃজনশীলতা দিয়ে মূল্যায়ন করা হয় না। যে যত বেশি মুখস্থ বিদ্যায় পারদর্শী, সে তত বেশি মেধাবী। আর এ জন্য আমাদের শিশুরা বড় হয়ে আমলা হয়। বিশ্ববিখ্যাত ডাক্তার, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, লেখক, দার্শনিক, উদ্ভাবক হয় না। মা বাবা গর্ব করে বলেন, আমার সন্তান হাঁটতে শেখেনি, কিন্ত এটুকু বয়সে কতো সুন্দর ছড়া মুখস্থ বলতে পারে। এখানেই যেন অভিভাবকের সকল কৃতিত্ব। আর তখনই শিশুর মেধা অর্ধেক পচে যায়। মুখস্থ বিদ্যা মেধার বাহক নয়, ধারকও নয়। মেধার ব্যাধি।

‘আত্মস্থ’ শব্দটার সাথে একজন শিক্ষার্থী পরিচিত হয় প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক স্তর পার করে যাওয়ার পর। আমার জীবনে আমি আত্মস্থ শব্দটার সাথে পরিচিত হয়েছিলাম কলেজে পড়া অবস্থায়। এক শিক্ষক পড়ানোর ফাঁকে এই দুর্লভ শব্দটা বলে ফেলেছিলেন। তখন জানতে পারলাম আত্মস্থর স্থায়িত্ব বেশি, মুখস্থর কোনো স্থায়িত্ব নেই। শব্দটার প্রতি সেই থেকে একটা দুর্বলতা, একটা আফসোস, একটা ভালোলাগা এখনো কাজ করে। শব্দটার সাথে আগে কেন পরিচিত হলাম না। শব্দটার এত মহিমা, এত গুণ। অথচ এতকাল অজানাই ছিল। সুযোগ পেলে কাউকে না কাউকে সহসা বলে দেই- মুখস্থ নয়, আত্মস্থ করো।

এটা মূলনীতি হওয়া উচিত এদেশের প্রতিটি শিক্ষার্থীদের। যেমন সিঙ্গাপুরের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো মৌলিক শিক্ষাব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ‘থিংকিং স্কুলস, লার্নিং নেশন’ নামে একটি নীতি অনুসরণ করছে। যাতে বাচ্চারা চিন্তার মাধ্যমে মেধার চর্চা করতে পারে। অন্যদিকে এদেশে বাচ্চাদের বলা হয়, সারা দিন বই নিয়ে পড়ে থাকো, না পারলে মুখস্থ করো, না বুঝলেও মুখস্থ করো। ফলে, এখানের শিশুরা গণিতের মতো বিষয়ও মুখস্থ করে। কারণ, সামনে পরীক্ষা আসন্ন, পাস করতে হবে। পেতে হবে জিপিএ-৫। না হলে যে বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সকলের কাছে তার কদর কমে যাবে। মা-বাবা গালি দেবে, হীনমন্যতায় ভুগবে। অনেক চাপ মাথার ভেতর। তাই, মুখস্থ ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় নেই।

প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থীকে এত বেশি পরীক্ষার সম্মূখীন হতে হয় যে, সময় নিয়ে কোনো কিছু অনুধাবন ও বিশ্লেষণ করার সুযোগ তার অবশিষ্ট থাকে না। ফলে, জানার আগ্রহ, শেখার আগ্রহ, বোঝার আগ্রহ, সৃষ্টির আগ্রহ মরে যায়। তখন তার মধ্যে একটাই আতঙ্ক কাজ করে- পরীক্ষা। ইউনেস্কোর এক প্রতিবেদনে দেখেছি, বাংলাদেশে তৃতীয় শ্রেণির অর্ধেকের বেশি শিশু বাংলা রিডিং পড়তে পারে না। বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৭৫ জন শিক্ষার্থী অঙ্ক করতে পারে না। জানে না নামতা। অন্যদিকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলার এবং ৬৮ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিতের নির্ধারিত ধারণাগুলো অর্জন না করেই প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শেষ করে।

শিশুদের কথা ছেড়ে দিলাম, কিশোরদের কথা বলা যাক। আমার টিউশনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, কলেজ পড়ুয়া সর্বাধিক শিক্ষার্থী ক্রিয়াপদ (টেনস) বোঝে না, বাক্য গঠন করতে পারে না, ইংরেজিতে দু’লাইন লিখতে পারে না। তারা ভালো না পারে বাংলা, না পারে ইংলিশ। না পারার কারণ, তারা পরীক্ষার উদ্দেশ্যে পড়ে। জানার উদ্দেশ্যে পড়ে না। জানার উদ্দেশ্যে পড়লে তারা পারতো। যেমন, গল্প-উপন্যাস আমরা জানার উদ্দেশ্যে প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে পড়ি বলে, গল্পের কোথায় কী আছে, কে কোন সংলাপ দিয়েছে- তা কখনো ভুলি না। কিন্তু পড়াশুনার ক্ষেত্রে, আজ পড়লে কাল ভুলে যাই।

পরীক্ষা এবং মুখস্থ একে-অপরের পরিপূরক। ধ্বংসাত্মক, তথাপি মুখস্থ এবং তথাকথিত বারবার পরীক্ষা থেকে বের হতে পারেনি শিক্ষার্থীরা এবং শিক্ষা ব্যবস্থা। মুখস্থ নয়, আত্মস্থ করো- এ কথাটি যেমন কোনো বিদ্যালয়ের দেয়ালে লেখা আমার চোখে পড়েনি। তেমনি পরীক্ষার উদ্দেশ্যে নয়, জানার উদ্দেশ্যে পড়ো- এই কথাটিও কোনো বিদ্যালয়ের দেয়ালে দেখিনি। দেখবো কী করে? আমাদের বিদ্যালয়গুলো মানেই তো পরীক্ষালয়। স্কুলের পরীক্ষা, কোচিংয়ের পরীক্ষা, গৃহশিক্ষকের পরীক্ষা, মডেল টেস্টের পরীক্ষাসহ কতো সব পরীক্ষা! অথচ বিদ্যালয়ের দেয়ালে দেখেছি রাজনৈতিক ব্যক্তিদের রাজনৈতিক বাণী। দেখেছি, অপ্রাসঙ্গিক উক্তির হৈ হৈ রৈ রৈ কাণ্ড।

'শাস' নামক সংস্কৃত ধাতু থেকে বাংলা ‘শিক্ষা’ শব্দটি এসেছে। এর অর্থ শাসন করা বা উপদেশ দান করা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় ‘শিক্ষা হল তাই, যা আমাদের কেবল তথ্য পরিবেশনই করে না, বিশ্বসত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।’ সেই বিশ্বসত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে জ্ঞান অর্জনের প্রাথমিক সিঁড়ি বা প্রথম ধাপ হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। হাতেখড়িও বলা চলে। এর অপর নাম মৌলিক শিক্ষা। মৌলিক শিক্ষা বলতে বোঝায়, সার্বজনীন অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থা, সকলের জন্য সমান আবশ্যিক। ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত আবশ্যিক শিক্ষার কথা বলেছে ইউনেস্কো। সেই শিক্ষা ব্যবস্থায় জড়তা থাকবে কেন? জিপিএ-৫ পাওয়ার অন্যায় চাপ থাকবে কেন? অসুস্থ প্রতিযোগিতা, আতঙ্ক, ভয় ও আত্মহননের প্রবণতা থাকবে কেন? বৈষম্য থাকবে কেন?

বৈষম্য তৈরি করে পরীক্ষা। ভালো শিক্ষার্থী এবং খারাপ শিক্ষার্থীর ট্যাগ লাগিয়ে দেয় ঘন ঘন পরীক্ষা পদ্ধতি। এই হতাশা একজন শিক্ষার্থীকে ভেতরে ভেতরে শেষ করে দেয়। আর এই শেষ যদি হয় প্রাথমিক শিক্ষা জীবন থেকে, তবে তো পৃথিবীর পথ ধরে হাঁটতে শুরুতেই সে পঙ্গু। বাকি পথ হাঁটবে কীভাবে! কোনো কোনো শিক্ষার্থীর এই হতাশা কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লেগে যায়। অধিকাংশ শিক্ষার্থী কাটিয়ে উঠতে পারে না। তাই বাধ্য হয়ে বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ। এবছর সমাপনী এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেটের বিষাক্ত ফলাফলের ছোবলে অনেক শিশু আত্মহত্যা করেছে। মৌলিক শিক্ষার করাঘাতে তারা অতিষ্ঠ হয়ে আত্মহত্যা করেছে।

আত্মহত্যা করেছে শিশুরা এই কথাটাই আমরা বিশ্বাসের নিয়ে মেনে নিতে পারি না। তারপরও স্বীকার করতে হয়, হ্যাঁ শিশুরা আত্মহত্যা করেছে। তা করেছে কেবল মৌলিক শিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে। পঞ্চম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী বুঝে উঠতে পারে না জীবন সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান। কিন্তু সে বুঝে ফেলেছে অর্থহীন, আনন্দহীন একঘেয়ে জীবনের শেষ শব্দটি হলো আত্মহত্যা। এর চেয়ে দুঃখজনক ও অবিশ্বাস্য ঘটনা আর কী হতে পারে এ জগতে?

এরিস্টটল বলেছিলেন, ‘সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হল শিক্ষা।’ কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা শিশুদের মন অসুস্থ করে তুলছে। কোমলমতি শিশুগুলোকে পরীক্ষা নামক বর্বরতার চাকায় পিষ্টে শিশু শিক্ষাপদ্ধতির ধ্বজা উড়িয়ে বেড়ায় যারা, তারা রীতিমতো সন্ত্রাসী। শিক্ষার্থী আত্মহত্যার প্ররোচনায় তাদের প্রত্যক্ষ মদদ রয়েছে।

শিশুদের তো এ বয়সে আত্মহত্যা করার কথা ছিলো না, তারা জানে না আত্মহত্যার ইতিবৃত্ত। তবে আত্মহত্যা করলো কেন? এই প্রশ্নটি শিক্ষা সংস্কারকদের প্রতি আমরা রাখতে চাই।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।


জাবি/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়