ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ০৯ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৬ ১৪৩১

দুই মিনিট বাংলা বলা

নাবিল হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ১৭ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দুই মিনিট বাংলা বলা

হঠাৎ সিদ্ধান্ত হলো দুই মিনিট বাংলা বলার প্রতিযোগিতা হবে। দুই মিনিট বাংলা বলা এ সময়ের বাংলাদেশে কতটা কষ্টসাধ্য ভেবে দেখেছেন কি?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের সাহিত্য সংসদের কার্যনির্বাহী মিটিং শেষে বিদায় নেব নেব এমন একটা সময় জনি ভাই অকস্মাৎ বলে বসলেন, ‘দুই মিনিট শুধু বাংলায় কথা বলার প্রতিযোগিতা করি’। বাংলা বলা মানে সাথে অন্য কোনো ভাষার শব্দের যত্রতত্র অনুপ্রবেশ চলবে না, নো কথ্য বাংলিশ।  সবার গলার জল শুকিয়ে গেলো এই কনকনে শীতের রাতেও।

যথারীতি প্রতিযোগিতা চলতে চলতেই বলা হয়ে গেলো কতশত ইংরেজি, হিন্দি ভাষার শব্দ। কেউ কেউ কৌশলে খাঁটি বাংলার পাঠ চুকাতে পারলো। প্রতিযোগিতা শেষে দেখা গেলো অনেকেই প্রমিত বাংলা ভাষায় কথা বলতে সফল। আসলে একটু খেয়াল করে কথা বললেই কিন্তু প্রাঞ্জল বাংলা ভাষায় মুখে খই ফুটে। মিশ্র ভাষা যে আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রোথিত নয়, সেটা প্রমাণ হয়ে গেছে আমাদের এই বাংলাকে সমীহ করে প্রতিযোগিতায়।

আধুনিকায়ন এবং বিশ্বগ্রামের এই কালে বিদেশি ভাষার শব্দকে মুড়ি-মুড়কি মনে করে নিজেদের ছ’ভাষী করে রাখতে একটুও কার্পণ্য করছি না আমরা। একটু স্মার্ট সাজতে গিয়ে নিজের ভাষায় কথা বলার মাঝে দু'একটা ইংরেজি শব্দের চাটনি কিন্তু মন্দ নয়। ঠিক এমনি চিন্তাভাবনায় নিমগ্ন থাকার প্রবণতা দিন দিন ক্রমবর্ধমান। অন্যদিকে বাংলা ভাষায় কথা বলাটা নিয়ে আজকের অভিভাবকদেরও ব্যাপক অনীহা লক্ষণীয়। নিতান্তই বাচ্চাকাল থেকে শহরে বেড়ে ওঠা বাচ্চাদের ভর্তি করিয়ে দেন ইংরেজি শিক্ষার একাডেমিতে। কারণ তারা বিশ্বাসী যে, মাতৃভাষায় টাকা আনে না, ইংরেজি ভাষায় ভালো চাকর হওয়া যায়। এভাবেই ফাঁকা থেকে যায় মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা আর ভাষাগত দখল।

আজকাল ফেসবুকের যুগ। সক্রিয় ফেইসবুক ব্যবহারে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। এটা ধরে নেয়া হয়ে যে, যার কোনো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই, সে হলো ব্যাকডেটেড। এই ফেসবুকের কল্যাণে তথ্যের অবাধ ছড়াছড়ি যেমন বেগবান, তদ্রুপ শিক্ষার্থীরা তাদের পরীক্ষার খাতায় আজকাল এই ফেসবুক ব্যবহারের অকল্যাণকর স্বাক্ষরও রেখে যাচ্ছেন। পরীক্ষার খাতায় লিখে আসছেন ইংরেজি বর্ণে বাংলা, বাংলিশ। যেমন- আমার লিখছে 'amar' আবার চলে যাবোকে লিখছে 'chole jabo'। এসব বাংলা ভাষার গতিপথে সত্যিই অশনি সংকেত।

আমাদের বিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যপুস্তক খুললে শিশুদের জন্য ভুল বানান আর ভুল বাক্যের ছড়াছড়ি দেখতে পাই। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে অধিকাংশ শিক্ষকেরই নেই প্রমিত বাংলা উচ্চারণ দক্ষতা। ফলে, আমাদের নতুন প্রজন্ম বিদ্যাপীঠ থেকে ভুল উচ্চারণ ও ভুল বানানে মাতৃভাষা শিখছে। উপরন্তু মহাবিপদ হয়ে উঠেছে হিন্দি ভাষার সিরিয়াল এবং হিন্দিতে ডাবিং করা কার্টুন ও অন্য অনুষ্ঠানগুলো। আমাদের দেশে বাংলা ভাষা নিয়ে যুক্তি-তর্কে সভা-সমিতি, রেডিও-টিভির প্যানেল আলোচনা যতই সরগরম হয়ে উঠুক না কেন, পত্র-পত্রিকার পাতায় অবধি, ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধসম’ এই প্রবচনের জ্ঞান গম্ভীর প্রবন্ধেই তা সীমাবদ্ধ থেকে যায়। সেই দুগ্ধের অভাব ঘটিয়ে কীভাবে আমরা নিজেরাই ভাষাকে অপুষ্ট-রিকেটি করে তুলছি - সেই ভাবনা আমাদের চেতনায় ঘা দেয় না কখনো।

ইউনেস্কোর কাছে ২০১০ সালে বাংলা পৃথিবীর সব চেয়ে মিষ্টি ভাষার স্বীকৃতি পেলেও এদেশের মানুষের কাছে ঠিক ততটুকুই তেতো হয়ে উঠছে। এর কারণ শুধু ভাষার মান না বোঝার কারণে।

অন্যদিকে প্রমথ চৌধুরীর ভাষ্যমতে, ‘বাংলা ভাষা আহত হয়েছে সিলেটে, আর নিহত হয়েছে চট্টগ্রামে।’ কথাটা কতটা যৌক্তিক? আজকাল যত্রতত্র, হরহামেশাই আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলাটার পক্ষে বিপুল যুক্তি প্রদান করতেও দেখা যায়।

কেউ কেউ বলেন, আমাদের আহমদ সফা, জয়নুল আবেদীনেরা এত প্রথিতযশা ব্যক্তি হয়েও আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে গেছেন, কিন্তু তারা তো এটা ভাবেন না যে উনারা প্রমিত বাংলা ভাষার উপর কতটুকু দখল রাখতেন। ধরুন, একটা সভায় বাংলাদেশের প্রায় সকল অঞ্চলের মানুষের সমাগম। সে সভায় কোনো নির্দিষ্ট একটি আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা কি ঠিক হবে? তার চেয়ে বড় কথা হলো বৈদেশিক যোগাযোগ রক্ষা, চাকরির সাক্ষাৎকারের জন্য হলেও প্রমিত বাংলা ভাষাটা চর্চা করা উচিৎ। আঞ্চলিক ভাষা চর্চা হোক নির্দিষ্ট এলাকায়। কারণ, এগুলোও বাংলা ভাষার অলঙ্কারের মতই। প্রথম চৌধুরীর আরেকটি বিখ্যাত উক্তি আছে ‘ভাষা মানুষের মুখ হতে কলমের মুখে আসে।’

যেখানে কথায় কথায় ইংরেজি শব্দের ব্যবহার করা হয়, সেখানে লিখতে গেলে বাংলা শব্দগুলো মাথায় আসবে কি? আমাদের এই ভাষা বিড়ম্বনা থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসা চাই। ঋকবেদে বলা হয়েছে, ‘মাতৃভূমি, নিজের সংস্কৃতি ও মাতৃভাষার প্রতি প্রত্যেকের শ্রদ্ধা রাখা উচিৎ। কারণ, সেগুলো আনন্দ দেয়।

অথর্ববেদে বলা আছে, ‘মাতৃভাষা থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে দিয়ো না। আমরা যেনো সবসময় মাতৃভাষার সেবা করতে পারি। যারা সৃষ্টিকর্তার গুণগান করতে চান তারা মাতৃভাষায় প্রার্থনা করুন। মাতৃভাষায়ই শুদ্ধতা ও সঠিকতার চর্চা করা যায়। মাতৃভাষার প্রতিটি শব্দ আমাদের রক্তের বাঁধনে বাঁধা। মাতৃভাষার প্রতিটি শব্দ দিয়ে মনের মতো অর্থের প্রকাশ ঘটে। প্রতিটি মহান কলাই মাতৃভাষায় শিল্পীত হয়। মাতৃভাষায় আমরা সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভক্তি প্রদর্শন ও তার গুণকীর্তন করতে পারি।’

তাই, দেশের সর্বত্র মাতৃভাষার উপর নানা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হোক। এতে করে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধি লাভ করবে অচিরেই। অবশেষে, প্রাণভরে গাইতে চাই, ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা।’

লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


ঢাবি/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়