ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

শাপলা এবং শালুকের গল্প

জুবায়ের আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪৮, ৯ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শাপলা এবং শালুকের গল্প

হাসান সাহেব স্বনামধন্য একটি প্রাইভেট ফার্মের ডিরেক্টর। ১০ বছর ধরে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। শুরুতে স্বল্প বেতনে মার্কেটিং বিভাগে চাকরিজীবন শুরু করলেও আজ ৫০ হাজার টাকা বেতন পান তিনি। পাশাপাশি কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্যও হাসান সাহেব।

স্ত্রী ও একমাত্র সন্তান নিয়ে চাকরি সূত্রে চট্টগ্রাম শহরে বসবাস করেন তিনি। তবে শৈশব থেকে লেখাপড়া সবকিছু হয়েছে কুমিল্লায়। পিতা-মাতার তৃতীয় সন্তান তিনি। তার পিতা-মাতা গত হয়েছেন বেশ কিছুদিন হয়। বড় এক ভাই গ্রামের বাড়িতেই ব্যবসা করেন। একমাত্র বোনও একজন গৃহিণী। তিন ভাই-বোনের শৈশব কাটে দুরন্তপনায়, তার বড় ভাই তার বন্ধুদের নিয়েই সময় কাটাতেন বেশি। হাসান এবং একমাত্র বোন দু’জনে একসঙ্গে খেলতেন, পড়তেন, ঘুমাতেন শৈশবে। করপোরেট লাইফের ব্যস্ততায় আজকাল গ্রামে খুব বেশি যাওয়া না হলেও নিয়মিত ফোন-সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রামে ভাই-বোনের সাথে যোগাযোগ করেন। এলাকার সকল খোঁজ-খবর রাখেন।

চীনের উহান প্রদেশের মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়ানো করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) বাংলাদেশেও প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর কিছুদিন হাসান সাহেব নিয়মিত অফিস করলেও করোনা আক্রান্ত রোগী দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারি নির্দেশনা মতে বন্ধ করা হয় তাদের কোম্পানি।

অফিসের ব্যস্ততায় স্ত্রী-সন্তানকে তেমন সময় দিতে না পারলেও করোনার কারণে গৃহবন্দিজীবনে দিনের পুরোটাই সন্তানকে কাছে পাচ্ছেন। হাসান সাহেবের একমাত্র ছেলে জিসানও বাবাকে কাছে পেয়ে অনেক খুশি। তিনি চাকরিজীবনে এই প্রথম লম্বা ছুটি পেয়ে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়েই পুরো সময় মেতে থাকতে চাইছেন।

হাসান সাহেব বেশ স্মৃতিকাতর একজন মানুষ। গৃহবন্দি থাকার সময়ে ধর্মীয় নির্দেশনা মানাসহ স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে গল্প করে সময় কাটান। অবসরে মধুমাখা শৈশবের আনন্দঘন দিনগুলোর কথা তার বেশি মনে পড়ে। একমাত্র বোন হাসান সাহেবের বয়সে বড় হলেও বন্ধুদের পাশাপাশি বোনকে নিয়েই নিজেদের নৌকা করে বর্ষাকালে শাপলা আর শালুক তুলতে যাওয়ার দিনগুলো ভাবতে থাকেন।

শুধু প্রকৃতির দান শাপলা, শালুক, মাছ ধরাই নয়। বন্ধুদের নিয়ে সন্ধ্যা বেলায় ধানি জমিতে আটকে থাকা হাঁস ধরে জবাই করে রাতের বেলায় ভুনা করে খাওয়ার কথা মনে পড়লে হাসি পায় তার। এই সময়ে এসে কিছুটা অনুতপ্তও তিনি পুরনো দস্যিপনার জন্য।

হাসান সাহেবের মনে পড়ে ৭ম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বর্ষাকালে দিন দিন পানি বাড়ছেই। পানি বৃদ্ধির ফলে বাড়িতেও পানি উঠার উপক্রম হয়েছে। বাড়ির পাশেই বড় ডোবায় শাপলা তুলতে গিয়ে নৌকা থেকে পড়ে যান। সাথে ছিল শুধুই বড় বোন। নৌকা থেকে একটু জোরে হোচট খেয়ে পড়ায় একেবারে ডোবার নিচে চলে যান হাসান সাহেব।

এসবের অভ্যেস থাকলেও নিচ থেকে পুনরায় উঠে আসতে আসতে দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়। এই দিকে বড় বোন রহিমাও কান্নায় ভেঙে পড়েন। হাসান সাহেব নৌকার উপরে উঠে কিছু সময় শুধু শ্বাস ফেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও এই ঘটনার কথা বাবা-মা বড় ভাই কিংবা কাউকে কোনো দিন বলেননি হাসান সাহেব কিংবা তার বোন।

দুই ভাই-বোন ও বন্ধুদের নিয়ে নৌকা করে ঘুরাঘুরি শাপলা, শালুক তোলা ছিল হাসান সাহেবদের নিত্য দিনের ঘটনা। নৌকা থেকেই শাপলার ডাটাসহ তোলা গেলেও ডাটার মূল-শালুক তোলার জন্য পানিতে ডুব দিতে হয়। পানির নিচে গিয়ে মাটির নিচে থাকা শালুক হাত দিয়ে মাটি কুড়ে বের করতে হয়।

ছোট সাইজের শালুক চামরা ছিলে কাঁচাও খাওয়া যায়। বড়-ছোট প্রকৃতির সব শালুকই সিদ্ধ করে খাওয়া যায়। শালুকের ঔষধি গুণাগুণও আছে বেশ। বাজারে সিদ্ধ করা শালুক বিক্রি করতে দেখা যায় কেজি হিসেবে। শাপলা ফুলটা ছিড়ে ফেলে শাপলার ডাটাও বেশ সুস্বাদু। এর ডাটা কাঁচা খাওয়া ছাড়াও রান্না করে খেলেও খুব স্বাদ পাওয়া যায়। বর্ষাকালে গ্রামাঞ্চলের বহু ঘরেই শাপলার ডাটা রান্না করা হয়। শাপলার ঔষধি গুণাগুণও পরীক্ষিত।

হাসান সাহেব পুরনো দিনের কথা ভেবে বেশ স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। ভাবতে থাকেন, আবার যদি ফেলে আসা শৈশবে ফিরে যেতে পারতাম। অবশ্য এখন গ্রামেও লেগেছে ইট-পাথরের শহরের ছোঁয়া। গ্রামের ছেলেরা এখন সারাদিন মোবাইল নিয়েই ব্যস্ত। পুরনো দিনের খেলাধূলা, দস্যিপনা খুব বেশি দেখা যায় না এখন। তবুও হাসান সাহেব মনস্থির করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সময় করে বেশ কয়েক দিনের জন্য স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে গ্রামে যাবেন।

ছেলেকে গ্রামের চিরচেনা ঐতিহ্যগুলোর সাথে পরিচয় করাবেন। নিজ হাতেই ছেলেকে সাতার শেখাবেন। কীভাবে কনুই জাল দিয়ে মাছ ধরতে হয়, কীভাবে নৌকা বাইতে হয়, শাপলা-শালুক তোলে আনতে হয়, সব ছেলেকে শেখাবেন। ছেলের মাধ্যমেই নিজের হারানো শৈশবকে আবারো ফিরিয়ে আনার এবং গ্রাম বাংলার সব ঐতিহ্যের সাথে ছেলেকে পরিচয় ও পারদর্শী করার কথা ভাবেন।

ভাবনার জগত থেকে ফিরে এসে হাসান সাহেব প্রার্থনা করেন। বিদ্যমান করোনা সংকট থেকে সবাই যেন নিরাপদে থাকেন, সুস্থ থাকেন, আর আক্রান্ত সবাই যেন সুস্থ হন এটাই তার কামনা।

লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম অ্যান্ড ইলেকট্রনিক মিডিয়া (বিজেম)।


ঢাকা/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়