ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

কার্টুনিস্ট থেকে প্রভাবশালী নেতা বাল ঠাকরে

|| রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:২৬, ১৮ নভেম্বর ২০১২   আপডেট: ০৮:৪৫, ১১ আগস্ট ২০২০
কার্টুনিস্ট থেকে প্রভাবশালী নেতা বাল ঠাকরে

রাইজিংবিডি২৪.কম:

গত ৪ দশক ধরে মহরাষ্ট্রের রাজনীতি আর ক্ষমতাবলয় তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। কার্টুনিস্ট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করা থাকরে জানতেন না যে সামনের দিনগুলোতে ভারতের শক্তিশালী রাজ্য মহারাষ্ট্র তথা ভারতীয় রাজনীতির কত বড় নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠবেন তিনি।

দীর্ঘ এক বর্ণাঢ্য জীবন কাটিয়ে শনিবার বিকাল ৩টা ৩৩ মিনিটে ৮৬ বছর বয়সে মহারাষ্ট্রে নিজ বাড়ি মাতশ্রীতে শেষ নিঃস্বাস তাগ করেছেন শিবসেনা নেতা বাল ঠাকরে ।

ইউনিইটেড মহারাষ্ট্র মুভমেন্ট-এর শীর্ষ পর্যায়ের নেতা কেশব সীতারাম ঠাকরে’র ঔরসে ১৯২৬ সালের ২৩ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন বাল ঠাকরে। তার কর্মজীবন শুরু হয ‘দ্য ফ্রি প্রেস জার্না‍ল’ নামের ইংরেজি দৈনিকের মাধ্যমে। এরপর ১৯৬০ সালে নিজের সম্পাদনায় বের করেন রাজনৈতিক সাময়িকী মার্মিক।

তার রাজনৈতিক দর্শন পিতা সীতারামের রাজনৈতিক মতাদর্শে অনুপ্রাণিত ছিল। ‘ইউনিইটেড মহারাষ্ট্র মুভমেন্ট’ এর আন্দোলনের সূত্রেই ভাষাভিত্তিক আলাদা একটি রাজ্য মহারাষ্ট্র গঠনের দাবি মজবুত হয়ে ওঠে।

রাজনৈতিক দর্শন ও উত্থান
রাজনৈতিক দর্শনে তিনি কট্টর হিন্দুবাদী ছিলেন। তার রাজনৈতিক জীবন অনেক বিতর্ক আর বিবাদের পদযাত্রায় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। তার রাজনীতি মূলত পশ্চিম ভারতীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রকেন্দ্রিক আবর্তিত হলেও ভারতজুড়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের নমস্য নেতা ছিলেন তিনি। হিন্দুরা তাকে ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’ হিসেবে মান্য করতো। মারাঠা তথা হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা এই নেতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ছিল।  

নিজের সম্পাদিত কার্টুন পত্রিকা মার্মিক’র মাধ্যমে তিনি মহারাষ্ট্রের রাজধানী চলচ্চিত্র ও বাণিজ্য নগরী মুম্বাইয়ে গুজরাতি, মারোয়ারি ও দক্ষিণ ভারতীয়দের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকাতে জনমত গড়ে তোলেন।

মহারাষ্ট্রের রাজনীতি ও আর্থিক ক্ষেত্রে স্থানীয়দের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালে গঠন করেন শিবসেনা।

অচিরেই শিবসেনা মুম্বাইতে (ত‍ৎকালীন বোম্বাই) বামপন্থিদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। মুম্বাইতে শ্রমিক আন্দোলন দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সংগঠনটি।

১৯৯৬ সালে ব্যক্তিজীবনে মারাত্মক বিপর্যয়ে পড়েন। এসময় পরপর তার স্ত্রী মীনা ঠাকরে ও পুত্র বিন্দু মাধব মারা যান। বর্তমানে জীবিত আছেন ২ ছেলে জযদেব ও উদ্ভব ঠাকরে।

ভারতীয় রাজনীতির দক্ষিণপন্থি ধারা অর্থা‍ৎ হিন্দু মৌলবাদী দল বিজেপি’র সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয় চলে ঠাকরের নেতৃত্বাধীন শিবসেনা। বিজেপির প্রায় যে কোনো কর্মসূচি বা কৌশলে শিবসেনা তাদের সমর্থন-সহযোগিতা দিয়ে গেছে।

ঠাকরের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হিসেবে তার ভাতিজা রাজ ঠাকরেকে ধরে নেওয়া হতো একসময়। কিন্তু একপর্যায়ে বাল ঠাকরে পুত্র উদ্ভব থাকরের দ্বারা কোনঠাসা হয়ে পড়েন ভাতিজা রাজ। তার বিভিন্ন আচরণে ক্ষুব্ধ রাজ ২০০৬‍ সালের ৯ মার্চ মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা (এমএনএস) নামে নয়া সংগঠন গড়ে তোলেন। এ ঘটনা বাল ঠাকরের ব্যক্তি ও রাজনৈতিক জীবনের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দেয়।

কট্টর হিন্দুবাদী এই নেতা ব্যক্তিজীবনে পুরোপুরি ‘ফ্যামিলি ম্যান’ ছিলেন। পরিবারকে সময় দিতেন সব উপলক্ষ্যেই।

balহিটলারে ভক্তি
নানান বিতর্কিত ভূমিকা আর মন্তব্যের জন্য বিতর্ক-বিসম্বাদ তার সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলতো বলা যায়। একাধারে একজন জনপ্রিয় নেতা এবং শিল্পী হওয়া সত্ত্বেও নাৎসি নেতা অ্যাডলফ হিটলারের গুণকীর্তন করে সুধী সমাজের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। তার এ সংক্রান্ত বক্তব্য ভারতজুড়ে ব্যাপক হৈচৈ ফেলে দেয়। একইভাবে ‘ভালেন্টাইন্স ডে’ বিরোধী অবস্থান নিয়েও মাঠ গরম করেন তিনি।

সাম্প্রদায়িক বক্তব্য
মুম্বাইয়ের হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তার মুসলিম বিরোধী কঠোর অবস্থান ছিল।পরে অবশ্য তিনি বলেন, তার অবস্থান সব মুসলমানের বিরুদ্ধে ছিল না। তিনি শুধু যারা ‍ভারতে থেকে ভারতের আইন মানতে চায় না তাদের বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি বলেন, এ ধরনের লোকদেরকে আমি বিশ্বাসঘাতক মনে করি।

ভারতীয় মিডিয়ায় শিব সেনাকে মুসলিম বিরোধী হিসেবেই মূল্যায়ন করা হয়। বাল ঠাকরে মুসলিম বিরোধিতার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ বিরোধীতাও করে গেছেন। তার ভাষায়, বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক অবৈধ ‍অভিবাসী মহারষ্ট্রে আবাস গেড়েছে। তিনি কথিত ওইসব বাংলাদেশিকে বিতারণের দাবি তোলেন।

ইন্ডিয়া টুডেকে দেওয়া এক সাক্ষা‍ৎকারে তিনি বলেন, মুসলমানরা ক্যান্সারের মত ছড়িয়ে পড়ছে। তাদেরকে ক্যান্সারের মতই মোকাবেলা করতে হবে। মুসলমানদের হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে। একাজে পুলিশের উচি‍ৎ হিন্দুমহাসভাকে সমর্থন করা সেভাবে যেভাবে খালিস্তান আন্দোলনের সময়ে পাঞ্জাব পুলিশ সহানুভতিশীল ছিল পাঞ্জাবি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি।

তবে পরে ১৯৯৮ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ঠাকরে জানান, মুসলমানদের বিষয়ে শিবসেনার অনেক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে অবস্থান বদলেছেন তিনি, বিশেষ করে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা ও রাম জন্মভূমি প্রসঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের অবশ্যই উচি‍ৎ মুসলমানদের দেখাশোনা করা এবং আমাদের অংশ হিসেবেই তাদের মূল্যায়ন করা।

কিন্তু এরপর ২০০৮ সালেই আবার তিনি লেখেন, ইসলামি সন্ত্রাসবাদের উত্থান হচ্ছে এবং এটা মোকাবেলায় একমাত্র পথ হচ্ছে হিন্দু সন্ত্রাসবাদ। ভারত এবং হিন্দুদের রক্ষায় আমাদের সুইসাইড বোম্ব স্কোয়াড প্রয়োজন।
তিনি ভাষাগত পার্থক্য এড়িয়ে বৃহ‍ৎ হিন্দু ঐক্য গড়ে এমন একটি দেশ গড়ার কথা বলেন যা হবে ‘শুধু হিন্দুদের জন্য হিন্দুস্থান’ এবং যেখানে ইসলাম ধর্মানুসারীদের পদাবনত করে রাখা হবে।

balসাক্ষাৎপ্রার্থীদের দীর্ঘ তালিকা
তবে ভাষা ও ধর্মভিত্তিক ধারায় রাজনীতি করলেও বাল ঠাকরের সঙ্গে সদ্ভাব ছিল দক্ষিণ ভারত, গুজরাতসহ অন্যান্য অঞ্চলের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের। তার সঙ্গে সাক্ষাৎপ্রার্থী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দীর্ঘ লাইন বলা যায় সর্বদাই লেগে থাকতো।         

ভারতীয় সাংস্কৃতিক অঙ্গন বিশেষ করে মুম্বাইকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র শিল্পে বাল ঠাকরের ব্যাপক প্রভাব ছিল।

লতা মুঙ্গেশকর, মাইকেল জ্যাকসন, প্রণব মুখার্জী, অটল বিহারী বাজপেয়ী, অমিতাভ বচ্চন, সালমান খান— কে না সাক্ষাৎ চাইতেন বাল থাকরের! পপসম্রাট মাইকেল জ্যাকসন প্রথমবার মুম্বাই এসে বাল থাকরের বাড়ি মাতশ্রীতে তার সঙ্গে দেখা করেন।

কংগ্রেসের সঙ্গে বাল ঠাকরের বলা যায় বনিবনা কখনোই হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ২০১২ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি কংগ্রেস প্রার্থী প্রণব মুখার্জীকে সমর্থন দেন। এর আগে মহারাষ্ট্রের মেয়ে প্রতিভা পাটিলকেও রাষ্ট্রপতি পদে সমর্থন দিয়েছিলেন ঠাকরে। তারা দু’জনই রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

বাল ঠাকরে বিহারি!
বাল ঠাকরে সম্পর্কে চলতি বছর কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিংয়ের একটি উক্তিকে কেন্দ্র করে চমকের সৃষ্টি হয়। দিগ্বিজয় জানান, মারাঠি কায়স্থ প্রভু পরিবারের সন্তান বাল ঠাকরের পরিবার মহারাষ্ট্রের আদি বাসিন্দা নয়। তার দাদা প্রবোধাঙ্কারের লিখিত বক্তব্য মোতাবেক— তারা আসলে বিহার থেকে মহারাষ্ট্রে এসে আবাস গাড়েন। এর জবাবে ঠাকরের ছেলে উদ্ভব জানান, তার দাদা আসলে তাদের পরিবারের নয়, গোষ্ঠীর কথা বলেছেন।

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়