ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

দ্বীপ মদনপুরে রাত হলো

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ৭ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দ্বীপ মদনপুরে রাত হলো

রফিকুল ইসলাম মন্টু : ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের তালে তালে মেঘনার বুকে চলছে ইঞ্জিন নৌকা। এপারে তুলাতলী খেয়াঘাট। এখান থেকেই ওপারের দ্বীপ মদনপুর ধূ ধূ চোখে ভাসে। ধূসর সবুজ গাছপালা আর ছোট ছোট ঘরের কেবল চালাটাই চোখে পড়ে। আকাশে মেঘের আনাগোনা। বাতাসের জোর বেড়েছে। তাই শান্ত মেঘনা খানিক অশান্ত হয়ে উঠেছে। মাঝি ঘাড় ঘুরিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। আবার হাতে নেয় বৈঠা। না, ভয় নেই। ঝড় হাওয়ার আশঙ্কা নেই। ঘাটের মাঝিরা এভাবেই নদী পাড়ি দেয় আকাশের চেহারা দেখে। আকাশ আর চারপাশের প্রকৃতি দেখেই এরা আবহাওয়ার গতি বুঝে নেয়।

ঘরমুখো মানুষ। শেষ খেয়ায় অনেকজন হাঁটুরে। সবার গন্তব্য দ্বীপ মদনপুর। মদনপুরের সব সদাইপাতি যায় এপার থেকে। ভোলা জেলা সদরই প্রধান হাট। কেউ সাপ্তাহিক মালামাল নেয়; কেউ প্রতিদিন। বেচাকেনা- আবার ভয়াল নদী পেরিয়ে ঘরে ফেরা। হাটে ছাগল দুটোর দাম ওঠেনি; তাই আলতাফ হোসেন ছাগল দুটো নিয়ে আবার ফিরছেন ঘরে। কেনা হয়নি সদাইপাতি। কাল আবার যাবেন। সবজি বেঁচে ঘরের সদাইপাতি কিছু নিয়ে এসেছেন হোসেন আলী। কিন্তু নৌকার পাটাতনে ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে বসে থাকা শিহাব উদ্দিন ধারের টাকা ফেরত পাননি বলে কিছুই আনতে পারেননি। খালি হাতে গিয়েছেন; ফিরেছেন সেভাবেই। নৌকা ভর্তি মালামাল। কিছু মালামাল গৃহস্থের, কিছু দোকানপাটের। মুদি দোকানের পিঁয়াজ, রসুন, তেল, নুন, কনফেকশনারীর দোকানের বিস্কিট, টোস্ট, কোমল পানীয়, হোটেলের চাল, আটা, ময়দা- সবকিছু নিয়ে খেয়া নৌকা মদনপুরের পথে।

এই হাঁটুরেদের মত আজ আমিও যেন মদনপুরে বাসিন্দা। সঙ্গে ব্যাগ। গলায় ঝুলানো ক্যামেরা। মাথায় ক্যাপ। আগে কয়েকবার মদনপুর যাওয়ার কারণে নৌকার কয়েকজন আমাকে চিনেন। তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় হয়। তাদের অভাব অভিযোগের অন্ত নেই। বলতে চান একথা, সে কথা। কয়েকদিন থাকবো মদনপুর- আলাপ হবে ওপারে; বলি তাদের। রহমত আলী তবুও এখনই কিছু বলতে চান-

: কোথা থেকে এলেন স্যার?

: ঢাকা থেকে।

: কোথায় যাবেন?

: মদনপুর।

: আমাগো কথা ল্যাখেন। আমরা ভালো নাই।

: কেন, কী হয়েছে?

: দ্বীপের মধ্যে অসহায় আমরা।

: সরকারি সুবিধা পান?

: তেমন কিছু পাই না।

: স্বাস্থ্য-চিকিৎসার কী অবস্থা?

: গেলে সব দেখতে পাবেন। আমার কিছু বলতে হবে না। 

 

দ্বীপ মদনপুর সরেজমিনের পরিকল্পনা ঠিকঠাক আগেই। সেখানে থাকতে হবে কয়েকদিন। সকালে গিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে বিশাল একটা স্টোরি লেখার পক্ষে আমি নই। দ্বীপের মানুষের সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা না দেখলে, হাটের চা-দোকানে আড্ডা না দিলে, গভীর রাত অবধি বাজারে না ঘুরলে আসল খবর মিলে না। গল্পে গল্পে উঠে আসে মানুষের জীবনচিত্র। ঢাকা থেকে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর, সেখানে কিছু কাজ সেরে নৌকায় ভোলার তুলাতলী পৌঁছাই। মেঘনার পূর্বে পাড়ে কমলনগরের মতিরহাট থেকে একখানা ইঞ্জিন বোট ছাড়ে ভোলা সদরের তুলাতলীর উদ্দেশ্যে। আগের চেয়ে এই নৌপথের গুরুত্ব অনেক কমেছে। অনেকে ফেরিতে যাতায়াত করে। তবে এখনও কিছু মানুষের ভরসা এই ইঞ্জিন নৌকা। মতিরহাট থেকে ছেড়ে বেশ কয়েকটি ঘাট থেকে যাত্রী নিয়ে দীর্ঘ মেঘনা পাড়ি দেয়। অনেক যাত্রী নিয়ে ট্রলার যাত্রা করে। ওপার থেকে এপারের কিছুই দেখা যায় না। নদীর মাঝ অবধি না পৌঁছালে বোঝার উপায় নেই, কোথায় চলেছি। বর্ষাকাল কিংবা দুর্যোগের মৌসুমে বেশ ঝুঁকি থাকলেও শুকনোয় তেমন সমস্যা নেই। কমলনগরের লুধুয়া ওপারের শেষ ঘাট। গন্তব্য এপারের ভোলার তুলাতলী ঘাট। পথে নদীর বুকেই দ্বীপ মদনপুরের দেখা মেলে। দ্বীপের পুব দিকটা গড়ছে আর পশ্চিম আর দক্ষিণ ভাঙছে। ইঞ্জিন নৌকাটি মদনপুরের পাশ দিয়ে আসার সময় সেখানকার কিছু মানুষ মালপত্র নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে যায়। দ্বীপাঞ্চলে এটাই নিত্য চেহারা। 

মতিরহাট থেকে সকাল সাড়ে দশটার দিকে ছেড়ে আসা ইঞ্জিন নৌকাটি ভোলার তুলাতলী যখন পৌঁছায়, তখন সূর্যটা পশ্চিমে হেলে পড়েছে। আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগে নদীর ওপার থেকে এপার আসতে। নৌকা ঘাটে ভিড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সকালে খাওয়া ক্ষুধার্ত মানুষগুলো যত দ্রুত সম্ভব খাবারের দোকানে ছুটেছে। আমি আলাপ জুড়ি হানিফ মাঝির সঙ্গে; যিনি মাত্রই আমাদের পৌঁছে দিলেন তুলাতলী ঘাটে। অনেক খাটুনি, অনেক শ্রম, অনেক ঝুঁকি। বংশ পরম্পরায় ঘাটের মাঝি হানিফ। বাবার কাছ থেকে দায়িত্ব পেয়েছেন। এক সকালে ওপার থেকে এপারে আসেন যাত্রী নিয়ে, পরের সকালে এপার থেকে ওপারের উদ্দেশ্যে নৌকা ছাড়েন। কখনো ঝড়ের মুখে পড়েছেন? জানতে চাই হানিফ মাঝির কাছে। উত্তর আসে- অনেকবার পড়েছি।  

: ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কেমন?

: মালামালের ক্ষতি হয়েছে, মানুষজনের ক্ষতি হয়নি।

: কত বছর এখানে ইঞ্চিন নৌকা চলে?

: হিসেব ঠিকভাবে বলতে পারবো না। তবে অনেক বছর।

: নদী বড় হয়েছে, না ছোট?

: অনেক বড় হয়েছে। আগে তো ছিল খাল। এপার ওপার কথা শোনা যেতো।

: ভাড়া কত?

: ১৫০ টাকা।

: আগে ছিল কত?

: আগে তো অনেক কম ছিল। ৫ টাকায় মানুষ পার হয়েছে।

: নৌকায় নিরাপত্তার কী ব্যবস্থা আছে?

: নিরাপত্তা তো দিবে আল্লায়। আল্লার ওপর ভরসা করেই চলি।

তথ্য সংগ্রহে এর আগেও বেশ কয়েকবার দ্বীপ মদনপুর গেলেও এবারই প্রথম সেখানে কয়েকদিন থাকার পরিকল্পনা। কোথায় থাকবো? এ দ্বীপে তো হোটেল-মোটেল নেই। মানুষজনের বাড়িঘরে থাকা ছাড়া বিকল্প দেখি না। না পেলে মসজিদ তো আছেই! ব্যবস্থা করে দিতে পারেন মদনপুরের অভিভাবক বলে পরিচিত লুতু পাটোয়ারী। লুৎফর রহমান পাটোয়ারী নামটি কবে যে মানুষের কাছে ‘লুতু পাটোয়ারী’তে পরিণত হয়েছে, তা কেউ জানে না। আসল নামটি হয়তো এখানকার অনেকে জানেনই না। লুতু পাটোয়ারীর নামে এখানে বাজার হয়েছে- পাটোয়ারী বাজার। এই বাজারকে দ্বীপের রাজধানীও বলা যায়। শুধু বাজারের জন্য নয়, দ্বীপের গঠনকালে এখানকার উন্নয়নে জমিদানসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন লুতু পাটোয়ারী। এলাকার মানুষজন যে কোন সমস্যায় ছুটে আসে বাজারের পেছনে লুতু পাটোয়ারীর বাড়িতে। এই যাত্রা আমার থাকার ব্যবস্থাটাও হলো এই বাড়িতেই। ভোলার সাংবাদিক ছোটন সাহা এ বিষয়ে দায়িত্ব নিলেন। লুতু পাটোয়ারির সঙ্গে কথা বললেন। এক কথায় রাজি লুতু পাটোয়ারী। ভোলা সদর থেকে তিনি আসছেন তুলাতলী ঘাটে। অবশেষে আমরা একই ট্রলারের যাত্রী হই। শেষ খেয়ায় দ্বীপ মদনপুর।

 

আমার সঙ্গে থাকা বড় ব্যাগটি তুলাতলী বাজারের একটি চেনা দোকানে রেখে দেই। সঙ্গে ছোট একটি ব্যাগ, প্রয়োজনীয় কাপড়, নোটবুক, কলম, ক্যামেরা, ইত্যাদি যা কিছু প্রয়োজনীয়। ঘাটে উপস্থিত সাংবাদিক ছোটন সাহা। আমরা ছবি তুলি, খবরের গল্প করি। খানিক বাদে ভোলা সদর থেকে ঘাটে আসেন লুতু পাটোয়ারী। আমরা আসলে তার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। এরই মধ্যে চলে গেছে একাধিক খেয়া। শেষ খেয়া ছাড়তে আরও কিছুক্ষণ বাকি। আমরা আবারও খবরের গল্পে ডুবি। মদনপুরের সমস্যা নিয়ে আলাপ করি। আমার খাতায় মদনপুরের সমস্যার তালিকা। নোট করা আছে অনেক বিষয়। আলাপের সময় সেগুলোর সঙ্গে মিলাই। মজার মানুষ লুতু পাটোয়ারী একটার সঙ্গে আরেকটা বিষয় জোড়া দেন, আমাদের বুঝিয়ে দেন খুব ভালোভাবে। লুতু পাটোয়ারীর চেষ্টায় মদনপুরায় অনেককিছু হয়েছে। দ্বীপের গঠনকালে কুকুর-বিড়াল আনা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই তাকে করতে হয়েছে সময়ের প্রয়োজনে। কিন্তু ভঙ্গুর দ্বীপের উন্নয়নের গতি আর এগোতে চায় না। আলাপ করতে করতেই ঘনিয়ে আসে শেষ খেয়া ছাড়ার সময়। গলুইয়ে পাশাপাশি বসি আমি আর লুতু পাটোয়ারী। খেয়া ছেড়ে দেয়। কিনারে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে আমাদের বিদায় জানায় সাংবাদিক ছোটন সাহা। লুতু পাটোয়ারির সঙ্গে আমার আলাপ থামে না।

আরও কয়েকবার এ দ্বীপে আসা গল্পগুলোর সঙ্গে এখনকার গল্পগুলো মেলানোর চেষ্টা করি। এই লুতু পাটোয়ারীর বাড়িতেই এক দুপুর আমরা খেয়েছিলাম। ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন দ্বীপের রাস্তাঘাট। বলেছিলেন নানান সমস্যার কথা। আমাদের আলাপে সেই গল্পগুলোই প্রাধান্য পায়। পূর্বপ্রান্তের মানুষদের এখনও দ্বীপের কেন্দ্রবিন্দু পাটোয়ারী বাজারে আসতে তিনটি খাল পেরোতে হয়। খালে পানি কমার অপেক্ষা করে অনেকে। ভাটার সময়ও হাঁটু পানি ভেঙে পারাপার হতে হয়। জরুরি প্রয়োজন হলে সাঁতরে যেতে হয়। মনে আছে, তথ্য সংগ্রহে এসে একবার পাশের বাড়ি থেকে লুঙ্গি এনে প্যান্ট বদল করে এই খালের কোমর পানি পার হয়েছিলাম। সেই খালগুলো এখনও সেরকমই আছে, জানালেন লুতু পাটোয়ারী। তিনি আরও জানালেন, দক্ষিণে ইউনিয়ন পরিষদ ভবনটি নদী ভাঙনের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। ওই প্রান্তের অনেক বাড়িঘর সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। দ্বীপে নিজের ঘরের সামনেই কমিউনিটি ক্লিনিকের জায়গা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখানে ডাক্তার নেই, ওষুধপত্র নেই- বড় আক্ষেপ লুতু পাটোয়ারীর। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কয়েকটি হয়েছে, পাকা ভবনও হয়েছে; কিন্তু শিক্ষক স্বল্পতা আর শিক্ষকের অনুপস্থিতি শিক্ষা ব্যবস্থাকেই যেন পঙ্গু করে রেখেছে।

এইসব আলাপে আলাপেই মদনপুর ঘাটের কাছে ইঞ্জিনের খেয়াতরী ভেড়ে। মেঘনা থেকে দ্বীপের সরু খালে ধরে এঁকেবেঁকে চলে খেয়া। দুই ধারে হরেক ক্ষেত খামার। ধনচে গাছগুলো বাতাসে হেলে দুলে পড়ছে। পশ্চিমে গোধূলীর লাল আভা। রাখাল গরু নিয়ে ফিরছে ঘরে। তখনও গোধূলীর শেষ আলোটা মিলিয়ে যায়নি। হঠাৎ তীরের কাদামাটিতে ধাক্কা খায় খেয়া। কিছু মানুষ ফিরতি খেয়ার আপেক্ষা করছিলেন- খেয়ায় আসা যাত্রীদের নামার জন্য তাদের আর অপেক্ষার সময় নেই। তাই হুড়মুড় করে উঠে গেলেন কয়েকজন। ওপারে ফিরতি যাত্রীদের হাঁক- মাঝি খেয়া ছাড়ো। মাঝি আরেকটা সিগারেট ধরায়। মাঝির সহযোগী দ্রুত নৌকা থেকে কিনারে উঠে রাস্তার পাশে বসে লুঙ্গি তুলে সারছে বিশেষ কাজ। মাঝি যাত্রীদের আশ্বস্ত করে- এখনই ছাড়বো।

খেয়াঘাট থেকে পাটোয়ারী বাজার খানিক দূর। কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটতে হয় পনেরো-কুড়ি মিনিট। আমাদের যেতে হবে সেই পর্যন্ত। বাজারের পাশেই লুতু পাটোয়ারীর বাড়ি। আমরা রাস্তায় উঠি। সঙ্গে খেয়ায় আসা অন্য মানুষেরাও। কারও হাতে বোঝা, কারও মাথায়। কেউ সামনে, কেউ পিছনে। কেউ দ্রুত হাঁটছে, কেউ খুব ধীরে। রাস্তার পাশে ছোট ছোট ঘর। সন্ধ্যায় কুপির বাতি জ্বালিয়েছে কেউ কেউ। কারও ঘর ধবধবে ফরসা সৌরবাতির আলোয়। সেই আলো বেড়ার ফাঁক দিয়ে চলে এসেছে রাস্তায়। আমরা হাঁটতে থাকি দলে দলে। গোধূলী পেরিয়ে অন্ধকার আরও গাঢ় হতে থাকে। রাত নামে দ্বীপ মদনপুরে।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ আগস্ট ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়