লেজকাটা টিয়া
শামীম আলী চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম
শামীম আলী চৌধুরী : ছোটবেলা থেকেই নতুনত্বের প্রতি আগ্রহ ছিল বেশি। তাই সবসময় নতুন কিছু পাওয়ার জন্য অনেকটাই মোহগ্রস্ত হয়ে পড়তাম। বন্যপ্রাণী গবেষক ও আলোকচিত্রশিল্পী আদনান আজাদ আসিফের হাত ধরে প্রথম সাতছড়ির সবুজ বনে যাই। ভোর ৬টায় আমরা সাতছড়ি পৌঁছলাম। নতুন বন ও বনের রাস্তা দেখে ভালো লাগল। সবুজে ঘেরা বনে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গেলাম। প্রায় ৮৯টি সিঁড়ি বেয়ে ওয়াচ টাওয়ারের গোড়ায় পৌঁছলাম। বেশ খানিকটা পথচলা ও সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার পর অনেকটা ক্লান্ত অনুভব হলো। তাই ওয়াচ টাওয়ারের নিচে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম।
যাত্রা পথে আদনানের কাছে বনের গল্প শুনে বেশ উত্তেজিত ছিলাম। হরেক প্রজাতির পাখি এই বনে বিচরণ করে। যা দেখবো আর ছবি তুলবো সবই আমার কাছে একেবারে নতুন। টাওয়ারে উঠার পর ভোরের আলো ফুঁটে উঠলো। ওয়াচ টাওয়ারের পাশেই কাঁটাযুক্ত মান্দার গাছে হরেক প্রজাতির পাখি ফুলের মধু খাচ্ছে। বেশ কিছু প্রজাতির পাখির ছবি তুললাম। হঠাৎ করে মান্দারের ফুলে এক দল পাখি বসলো। পাখিগুলো দেখে উত্তেজনা বেড়ে গেলো। তাদের ফ্রেম বন্দী করলাম। পরে আদনানের কাছে পাখিগুলোর পরিচয় জানলাম এরা লটকনটিয়া বা লেজকাটা টিয়া।
লেজকাটা টিয়া ১৪ সে.মি. দৈর্ঘ্যের Psittaculidae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত Loriculus শ্রেণির ছোট আকারের গোলগাল দেহের একটি টিয়া পাখি। এদের ঠোঁট লাল এবং আগা হলুদ। দেহ সবুজ। কোমর লাল রঙের। চোখ বাদামি-পীতাভ ও মাঝখানটা কালো। পা ও পায়ের পাতা ফিকে-কমলা। নখ কালচে-বাদামি। ছেলে ও মেয়ে পাখির চেহারায় ভিন্নতা আছে। মেয়ে পাখির গলার নীলকান্তমণি পট্টির সাহায্যে সহজে পুরুষ পাখি থেকে আলাদা করা যায়। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির চোখ বাদামি ও কোমর লাল। লেজের উপরি ভাগের ঢাকনা লাল-সবুজে মেশানো। দুই ডানা যখন আবৃত থাকে তখন লেজের উপরিভাগে লাল রং স্পষ্ট দেখা যায়। এদের লেজ খাটো বা ছোট বলে ‘লেজকাটা টিয়া’ পাখি বলেও পরিচিত।
লটকনটিয়া আদ্র পাতাঝরা ও প্রশস্ত পাতাওয়ালা চিরসবুজ বনে বিচরণ করে। গাছের মগডালে এদের বেশি দেখা যায়। সমুদ্রসমতল থেকে ১৮০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত এদের দেখা যায়। সচরাচর পারিবারিক দলে কিংবা সর্বাধিক পঞ্চাশটি পাখি ঝাঁক বেধে থাকতে দেখা যায়। বনের ফলজ গাছে এরা ঘুরে ঘুরে খাবার খুঁজে বেড়ায়। এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে বন্য ডুমুরের নরম ফলত্বক, রসালো ফল, বাঁশ বীজ ও ফুলের মিষ্টি রস। ঝুলে থাকতে এরা পছন্দ করে; গাছের ডালে উল্টো করে ঝুলে বিচরণ করে, খাবার খায়। বাদুড়ের মত উল্টো ঝুলে বিশ্রাম নেয়। অনেক সময় খাবারও উল্টো ঝুলে খায়। ওড়ার সময় চিটচিট শব্দে ক্রমাগত ডেকে যায়।
সাধারণত জানুয়ারি থেকে জুন লটকনটিয়ার প্রধান প্রজনন ঋতু। স্থানভেদে প্রজনন মৌসুমে ভিন্নতা দেখা যায়। এসময় মরা গাছের গর্তে এরা বাসা বানায়। বাসায় সবুজ পাতার পত্রফলক বিছিয়ে বসবাস করে। নিজেদের বানানো বাসায় এরা ৩-৪টি সাদা রঙের ডিম দেয়। পুরুষ ও মেয়েপাখি মিলে ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়।
লটকনটিয়া বাংলাদেশে দুর্লভ আবাসিক পাখি। এরা লোকালয়ে আসে না। চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের চির সবুজ বন ও বনভূমিতে পাওয়া যায়। এছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম এদের মূল আবাস।
বাংলা নাম: লটকনটিয়া বা লেজকাটা টিয়া
ইংরেজি নাম: Loriculus vernalis.
বৈজ্ঞানিক নাম: Vernal hanging parrot
লেখক ছবিগুলো সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান থেকে তুলেছেন
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ আগস্ট ২০১৯/হাসনাত/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন