বর্ণিল পাখি কমলা-বুক হরিকল
শামীম আলী চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম
শামীম আলী চৌধুরী : গতবছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে সাতছড়ি যাচ্ছি। একটানা বৃষ্টি হচ্ছে। বাসে বসে জানালায় বৃষ্টি দেখছি আর ভাবছি- যদি বৃষ্টি না থামে তবে যাওয়াটাই বিফলে যাবে। ভাবতে ভাবতে শায়েস্তাগঞ্জ পৌঁছালাম। ভোরের আলোর জন্য যাত্রী ছাউনীতে অপেক্ষা করছি। কারণ মাঝে মাঝে বনের রাস্তায় ডাকাত পড়ে। ফজরের নামাজ পড়ে মুসুল্লীরা মসজিদ থেকে বের হচ্ছেন। এরই মধ্যে সিএনজি চলে এলো। সাতছড়ি বনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ভোর সাড়ে ৬টায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বনের ভিতর প্রবেশ করলাম। ওয়াচ টাওয়ারে উঠে বিশ্রাম নিচ্ছি আর বৃষ্টি-ভেঁজা প্রকৃতির সবুজাভ নয়ন ভরে দেখছি। বনের ভিতর উঁচু উঁচু গাছ সবার আগে বৃষ্টির সঙ্গে মিতালী করছে। ছোট গাছ ও ঝোপগুলি অসহায়ের মত তাকিয়ে আছে। প্রকৃতির স্বভাবজাত আচরণ দেখতে দেখতে বৃষ্টি থেমে গেল। পূব আকাশে সূর্যও উঁকি দিয়েছে। দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল।
এরই মধ্যে বনের নানা প্রজাতির পাখি খাবারের জন্য বের হয়েছে। টাওয়ারের সামনে পাকুড় গাছে পাকুড় ফলে ভরপুর। সেই ফল খাবার জন্য কয়েক প্রজাতির হরিকল গাছে বসেছে। ক্যামেরা হাতে নিয়ে ছবি তোলা শুরু করলাম। এদের মাঝে ‘কমলা-বুক হরিকল’ পেয়ে গেলাম। আরো বেশ কয়েক প্রজাতি হরিকলের ছবি তুললাম।
কমলা-বুক হরিকল Orange-breasted Green Pigeon কোলাম্বিডি পরিবারভুক্ত বৃক্ষচারী পাখি। জালালি কবুতরের চেয়ে আকারে কিছুটা ছোট। ঠোঁটের আগা থেকে লেজের ডগা পর্যন্ত প্রায় ২৯ সেন্টিমিটার। ওজন ১৫৫ থেকে ১৯৪ গ্রাম। বর্ণিল পাখি কমলা-বুক হরিকলের পুরুষ ও স্ত্রীর দেহের রঙে পার্থক্য রয়েছে। পুরুষের কপাল হলদে-সবুজ, মাথার চাঁদি থেকে ঘাড়ের নিচ পর্যন্ত নীলচে-ধূসর। পিঠ ও ডানার ওপর জলপাই-সবুজ। ডানার কিছু পালকের প্রান্ত হলুদ। উড়লে ডানার পালকের তলার ধূসর রং চোখে পড়ে। পিঠের নিচ ও লেজের সংযোগস্থলের ওপর দারুচিনি রঙের। লেজের ওপর ধূসর, আগা ফিকে। মুখমণ্ডল হলদে-সবুজ, গলা বেগুনি ও বুক উজ্জ্বল কমলা। পেট হলদে-সবুজ ও লেজের তলা কমলা। স্ত্রী হরিকলের দেহের ওপরটা জলপাই-সবুজ ও নিচটা হলদে-সবুজ। মুখমণ্ডল হলদে-সবুজ। লেজের পেটে দারুচিনি ও ধূসরের প্রাধান্য এবং নিচে হালকা কমলা।
স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ের ঠোঁট নীলচে-সবুজ এবং পা ও পায়ের পাতা গাঢ় গোলাপি। চোখের মণির বাইরের বলয় লালচে ও ভেতরেরটা গাঢ় নীল। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি দেখতে মায়ের মত। কমলা-বুক হরিকল মূলত চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ বন এবং খুলনা বিভাগের সুন্দরবনের বাসিন্দা। সাধারণত একাকী, জোড়ায় বা ছোট দলে বিচরণ করে। আবার অন্যান্য সবুজ কবুতরের দলেও একসঙ্গে বিচরণ করতে দেখা যায়।
বট, পাকুড়, ডুমুর, পাকা খেজুর, বড়ই জাতীয় ছোট ফল পছন্দ করে। ফলে ভরা গাছের উঁচু শাখায় ধীরে ধীরে হেঁটে হেঁটে ফল ও বিচি খায়। খুব ভোরে খেঁজুরের রসও খেতে দেখা যায়। সকাল ও সন্ধ্যায় বেশি সক্রিয় থাকে। তবে ভরদুপুরেও খাবার খেতে দেখা যায়। দ্রুত ডানা নেড়ে বেশ জোরে সোজা পথে উড়ে চলে। নিচু স্বরে শিস দেওয়ার মতো করে ডাকে।
মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এদের প্রজননকাল। এ সময় গাছের ডালে খড়কুটো দিয়ে বাসা বানায়। এদের বাসা ঘুঘুর বাসার চেয়েও ঢিলেঢালা, বেশ গভীর ও বাসার কিনারা উপরের দিকে ওঠানো। বাসা তৈরি হলে স্ত্রী সেখানে দুটো সাদা রঙের ডিম পাড়ে ও দুজনেই পালাক্রমে ডিমে তা দেয়। ডিম ফোটে ১২ থেকে ১৪ দিনে। বাবা-মা দুজনেই বাচ্চাদের যত্নাদি করে লালন পালন করে। পৃথিবীতে ২৩ প্রজাতির হরিকল দেখা যায়। বাংলাদেশে ৬ প্রজাতির হরিকল পাওয়া যায়। কমলা-বুক হরিকল আমাদের দেশে দুর্লভ আবাসিক পাখি।
বাংলা নাম: কমলা-বুক হরিকল
ইংরেজি নাম: Orange-breasted Green Pigeon
বৈজ্ঞানিক নাম: Treron bicinctus
লেখক ছবিগুলো সাতছড়ি থেকে তুলেছেন।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯/হাসনাত/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন