ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

দৃপ্ত পায়ে ডায়াসের সামনে দাঁড়ালেন বঙ্গবন্ধু

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দৃপ্ত পায়ে ডায়াসের সামনে দাঁড়ালেন বঙ্গবন্ধু

‘মাতৃভাষার প্রতি যার ভালবাসা নেই, দেশের প্রতি তার ভালবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।’ বঙ্গবন্ধু এ ক্ষোভযুক্ত বাণী উচ্চারণ করেছিলেন ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে এক আদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও স্বাধীনতার তিন বছর পরও অধিকাংশ অফিস–আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজী ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালবাসা নেই, দেশের প্রতি তার ভালবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।’

বাংলা ভাষাকে কতখানি তিনি ভালবাসতেন তা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে। সেদিন তিনি বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

সেদিনের দৃশ্যপট ছিল এরকম- লাল সবুজের পতাকা পত পত করে উড়ছে জাতিসংঘের সদর দফতরের সামনে। আরো শতাধিক দেশের পতাকার পাশে বাংলাদেশ ঠাঁই করে নিয়েছে নিজের আসন। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ অধিবেশন কক্ষে সদস্য দেশগুলোর রাষ্ট্রনায়ক ও সরকার প্রধানরা। অধিবেশনে সভাপতির আসনে আলজেরিয়ার মুক্তি সংগ্রামের নেতা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা আবদেল আজিজ বুতেফ্লিকা। সভাপতি বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বক্তৃতা মঞ্চে আহ্বান করেন। বাঙালির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু সদর্পে বীরোচিত ভঙ্গিমায় আরোহণ করলেন বক্তৃতা মঞ্চে। প্রথম এশীয় নেতা, যিনি এই অধিবেশনে সবার আগে ভাষণদান করেন। দৃপ্ত পায়ে বক্তৃতা মঞ্চে উঠে ডায়াসের সামনে দাঁড়ালেন বঙ্গবন্ধু। তুমুল করতালি। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা শুরু করেন মাতৃভাষা বাংলায়। যে ভাষার জন্য ঢাকার রাজপথে বাঙালি বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। সেই ভাষায় প্রথম ভাষণ জাতিসংঘে। বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষাকে বিশ্ব দরবারে আবার ঠাঁই করে দিলেন।

বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে এক পলকে চারদিক দেখে নিলেন। বঙ্গবন্ধু সাধু বাংলায় জাতিসংঘে দেয়া ভাষণের প্রারম্ভেই বললেন, "মাননীয় সভাপতি, আজ এই মহামহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সাথে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির ভাগীদার যে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ এই পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙালি জাতির জন্য ইহা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।"

বঙ্গবন্ধু এরপর ভাষণে তুলে ধরেন বাঙালি জাতির সংগ্রামী চেতনার সফল সংগ্রামের ইতিবৃত্ত। বললেন, "স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশে মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়া বাঁচার জন্য বাঙালি জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম করিয়াছেন, তাহারা বিশ্বের সকল জাতির সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়া বাস করিবার জন্য আকাঙ্ক্ষিত ছিলেন। যে মহান আদর্শ জাতিসংঘ সনদে রক্ষিত রহিয়াছে আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন। আমি জানি, শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সকল মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের উপযোগী একটি বিশ্ব গড়িয়া তুলিবার জন্য বাঙালি জাতি পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের এই অঙ্গীকারের সহিত শহীদানের বিদেহী আত্মাও মিলিত হইবেন।"

বাংলাদেশেকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু অভিনন্দন জানান। অধিবেশনের সভাপতিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন সক্রিয় যোদ্ধা সভাপতি থাকাকালেই বাংলাদেশকে এই পরিষদের অন্তর্ভুক্ত করিয়া নেয়া হইয়াছে। এর আগের বছর ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর শীর্ষ সম্মেলন সফল করার ক্ষেত্রে আবদেল আজিজ বুতেফ্লিকাকে অভিনন্দন জানান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুক্তিসংগ্রামে সমর্থনদানকারী দেশগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, "যাঁহাদের ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ বিশ্বসমাজে স্থান লাভ করিয়াছে এই সুযোগে আমি তাঁহাদেরকে অভিনন্দন জানাই। বাংলাদেশের সংগ্রামে সমর্থনকারী সকল দেশ ও জনগণের প্রতি আমি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছি। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ছিল শান্তি ও ন্যায়ের মিলিত সংগ্রাম। জাতিসংঘ গত ২৫ বছর ধরিয়া এই শান্তি ও ন্যায়ের জন্যই সংগ্রাম করিয়া যাইতেছে।"

বঙ্গবন্ধু জনগণের অধিকার কেড়ে নেয়ার ক্ষেত্রে দেশে দেশে সেনাবাহিনী ব্যবহারের তীব্র নিন্দা জানান এবং বাংলাদেশসহ চারটি দেশ আলজেরিয়া, গিনি বিসাউ এবং ভিয়েতনামের নামোল্লেখ করে বলেন, "এই দেশগুলো অপশক্তির বিরুদ্ধে বিরাট বিজয় অর্জন করিতে সক্ষম হইয়াছে।" "চূড়ান্ত বিজয়ের ইতিহাস জনগণের পক্ষেই থাকে" উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু ফিলিস্তিন, জাম্বিয়া এবং নামিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন।

অসাধারণ মননশীলতাপূর্ণ বাঙালি জাতির জনকের ভাষণের সময় পুরো অধিবেশন কক্ষ ছিল পিনপতন নিস্তব্ধ। বঙ্গবন্ধু আগামীদিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য জাতিসমূহের পথ কি হবে সে নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, "পথ বাছিয়া লইবার সঠিকতার উপরেই নির্ভর করিতেছে ধ্বংসের অথবা সৃজনশীলতার দিকে যাত্রার কঠিন বাস্তবতা।"

বঙ্গবন্ধু তাঁর পুরো ভাষণে একটি মাত্র দেশের সরকার প্রধানের নামোল্লেখ করেন। কৃতজ্ঞতা সহকারে বঙ্গবন্ধু তাঁর বন্ধু আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারি বুমেদীনের নামোল্লেখ করে বলেন, "জোট নিরপেক্ষ দেশসমূহ যাহাতে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায় প্রেসিডেন্ট বুমেদীন তাহার জন্যে বিশেষ আহ্বান জানাইয়াছিলেন।"

বঙ্গবন্ধু বার্মাসহ (মিয়ানমার) আঞ্চলিক 'জোন' গঠনের সম্ভাবনা ও বাস্তবতার প্রতি তাঁর অনুভূতি তুলে ধরেন ভাষণে। বলেন তিনি, "বাংলাদেশের অভ্যুদয় এই উপমহাদেশের শক্তি কাঠামো সৃষ্টি করিয়াছে। .... আমরা শান্তি চাই। আর কেবল এই জন্যই অতীতের সকল গ্লানি ভুলিয়া যাইয়া পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করিয়াছি। ....শান্তির জন্য ইহা আমাদের একটি বিনিয়োগ বলিতে পারেন।"

বঙ্গবন্ধু ভাষণের শেষ পর্যায়ে বেশ আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েন। বলেন, "সম্মানিত সভাপতি, মানুষের অজয় শক্তির প্রতি আমার বিশ্বাস রহিয়াছে। আমি বিশ্বাস করি, মানুষ অসম্ভবকে জয় করিবার ক্ষমতা রাখে।"

বঙ্গবন্ধু বলেন, "অজয়কে জয় করিবার সেই শক্তির প্রতি অকুণ্ঠ বিশ্বাস রাখিয়াই আমি আমার বক্তৃতা শেষ করিবো।" এরপর তিনি দৃঢ়তার সাথে আরো বলেন, "বাংলাদেশের মতো যেই সব দেশ দীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মদানের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে, কেবল তাহাদেরই এই দৃঢ়তা ও মনোবল রহিয়াছে, মনে রাখিবেন সভাপতি, আমার বাঙালি জাতি চরম দুঃখ ভোগ করিতে পারে, কিন্তু মরিবে না, টিকিয়া থাকিবার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমার জনগণের দৃঢ়তাই আমাদের প্রধান শক্তি।"

বিপুল হর্ষধ্বনি ও করতালির মধ্যদিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষণ শেষ করেন। বিশ্বের নানা দেশের নেতারা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণকে অভিনন্দন জানাতে সারিবদ্ধভাবে জড়ো হন।

 

ঢাকা/ শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়