ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

সাতবার বজ্রপাতেও জীবিত

নিয়ন রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৯, ৯ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সাতবার বজ্রপাতেও জীবিত

এক বা দুইবার নয়, গুণে গুণে সাতবার বজ্রপাতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন রয় স্যুলিভান। তিনি হয় বিশ্বের সবচেয়ে ভাগ্যবান অথবা সবচেয়ে দুর্ভাগা ব্যক্তি। আদতে তাকে সৌভাগ্যবান নাকি দুর্ভাগা বলবেন নির্ভর করছে আপনি বিষয়টিকে কীভাবে নিচ্ছেন তার ওপর। স্যুলিভান ১৯১২ সালে আমেরিকার ভার্জিনিয়ার গ্রিন কাউন্টিতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা-মায়ের এগারো সন্তানের মধ্যে তিনি চতুর্থ। ছোটবেলা থেকেই ডাঙর স্বভাবের স্যুলিভান ব্লু রিজ পর্বতমালা চষে বেড়িয়েছেন। পড়াশোনা অতোটা গুরুত্ব না দেয়ায় কলেজের গণ্ডি পেরুতে পারেননি। তবে তার বাহ্যিক জ্ঞান ছিল প্রখর। যৌবনে তিনি শেনান্দোয়া জাতীয় উদ্যানে পার্ক রেঞ্জার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৩৬ সাল থেকে অবসর নেয়া অবধি তিনি সেই পদেই কর্মরত ছিলেন।

রয় স্যুলিভানের পার্ক রেঞ্জারের চাকরিটা ছিল চ্যালেঞ্জিং। সারাদিন তাকে বনে ঘুরে বেড়াতে হতো। তাঁর এই পেশাই তাকে গড়পড়তা ব্যক্তিদের তুলনায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলেছিল। তাই বলে সাতবার! রয় স্যুলিভান ১৯৪২ থেকে ১৯৭৭ সালের মধ্যে মোট সাতবার বজ্রপাতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছেন। এরপরও তিনি বেঁচে ছিলেন। কে জানে হয়তো মানুষকে সেই গল্প শোনাবেন বলেই।

১৯৪২ সালে প্রথমবার স্যুলিভান যখন বজ্রপাতের কবলে পড়েন তিনি শেনান্দোহ জাতীয় উদ্যানের ওয়াচ টাওয়ারে কাজ করছিলেন। বজ্রপাতে টাওয়ারটিতে আগুন ধরে যায়। স্যুলিভান সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কয়েক ফুট যেতে না যেতেই তার পায়ে বজ্রপাত আঘাত হানে। ডান পায়ের অনেকটা অংশ পুড়ে যায়, পায়ের তালু ফুটো হয়ে যায়। খুব বাজেভাবে আহত হন তিনি। স্যুলিভানের মতে, ১৯৪২ সালের এই বজ্রপাত ছিল তার জীবনে সবচেয়ে খারাপ আর ভয়ঙ্কর মুহূর্ত।

দীর্ঘ সাতাশ বছর পর ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে স্যুলিভান দ্বিতীয়বারের মতো বজ্রপাতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন। এবারও তিনি ডিউটিতে ছিলেন। ট্রাকে চড়ে বন পরিদর্শনে যাওয়ার সময় ট্রাকের খোলা জানালা দিয়ে বজ্রপাত তার চুলে আগুন ধরিয়ে দেয়। তিনি জ্ঞান হারান। ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে পাহাড়ের খাড়া বাঁধে ধাক্কা খায়। সৌভাগ্যবশত এবারও বেঁচে যান স্যুলিভান।

পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭০ সালে স্যুলিভান বাগানের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তখন হঠাৎ তাঁর পাশেই বিদ্যুতের ট্রান্সফর্মারে বজ্রপাত আঘাত হানে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনি এক ঝটকায় কয়েক ফুট দূরে ছিটকে পড়েন। তবে এবার খুব বাজে কিছু হয়নি। শুধু বাম কাঁধে হালকা ফোস্কা পড়ে। স্যুলিভান চতুর্থ এবং পঞ্চমবার যখন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন তখনও অনডিউটিতে ছিলেন। ১৯৭২ সালে রেঞ্জার স্টেশনে কাজ করছিলেন। হঠাৎ প্রবল ঝড়ের সঙ্গে মেঘের গর্জন শুরু হয়। এবারও বজ্রপাতে তাঁর চুলে আগুন ধরে যায়। আগুন নেভানোর জন্য তিনি মাথায় ভেজা তোয়ালে ব্যবহার করেন। পরের বছর হঠাৎ একদিন প্রবল ঝড়ো মেঘ তাঁর দিকে ধেয়ে আসতে শুরু করে। আবহাওয়া আগে থেকেই অবশ্য খারাপ ছিল। তিনি বিপদ বুঝে দ্রুত পাশ কাটানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু পারেননি। পঞ্চমবারের মতো বজ্রপাত আঘাত হানে তার উপর। এই ঘটনার পর থেকে স্যুলিভান বিশ্বাস করতে শুরু করেন, তার সঙ্গে এমন কিছু থাকতে পারে যে কারণে বজ্রপাত তাকে এভাবে আকর্ষণ করে। তিনি বলেন, আমি কখনো ভীতু মানুষ ছিলাম না। কিন্তু আজকাল যখন মেঘের গর্জন শুনতে পাই তখন নিজেকে কিছুটা নড়বড়ে লাগে।

স্যুলিভানের বিশ্বাস একেবারেই ভিত্তিহীন ছিল না। কেননা তাকে আরো দুইবার বজ্রপাতের আঘাত সহ্য করতে হয়েছিল এবং বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েও শেষ পর্যন্ত তিনি জীবিত আছেন। ১৯৭৬ সালের ৫ জুন স্যুলিভান আবারও ঝড়ো মেঘের মুখোমুখি হন। তিনি যতোই পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন, তার মনে হচ্ছিল মেঘগুলো তাকেই অনুসরণ করছে। কিছুক্ষণ পর তার উপর ষষ্ঠবারের মতো বজ্রপাত আঘাত হানে। তবে সেবার তেমন কোনো ক্ষতি না হলেও পায়ের গোড়ালিতে চোট পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৭ সালের ২৫ জুন সপ্তম এবং শেষবারের মতো বজ্রপাত আঘাত হানে স্যুলিভানের কপালে। সেদিন তিনি পুকুরে মাছ ধরছিলেন। এবারও বজ্রপাতের কারণে তার চুলে আগুন ধরে যায়, বুক এবং পেটের অনেকটা অংশ পুড়ে যায়। বাজেভাবে আহত হন তিনি। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, এই অবস্থাতেও একটা ভালুক তার মাছ চুরি করার চেষ্টা করে। প্রচণ্ড ব্যথা নিয়েও স্যুলিভান লাঠি দিয়ে আঘাত করে ভালুকটিকে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হন।

পাঠক, রয় স্যুলিভানকে আপনি এবার কি বলবেন? সৌভাগ্যবান নাকি দুর্ভাগা? সাতবারের চেষ্টায় বজ্রপাত তাকে পরাজিত করতে না পারলেও প্রেমের জন্য নিজের কাছেই পরাজিত হয়েছিলেন তিনি।

১৯৮৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর একটি অপ্রত্যাশিত প্রেমের সম্পর্কের কারণে মারাত্মক হতাশাগ্রস্ত হয়ে শটগানের গুলিতে আত্মহত্যা করেন তিনি। সাতবার বাজেভাবে বজ্রপাতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েও যিনি বেঁচেছিলেন তিনিই কিনা মারা গেলেন আত্মহত্যা করে। হায় প্রেম! তবে হ্যাঁ, গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস বুকে সবচেয়ে বেশিবার বজ্রপাতে আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে রয় স্যুলিভানের নাম এখনও জ্বলজ্বল করছে। সেখানে তিনি আজও বেঁচে আছেন। 



ঢাকা/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়