ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

বন্যপ্রাণী নয়, ওরা মানুষকে ভয় পায়

খালেদ সাইফুল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৬, ১৯ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বন্যপ্রাণী নয়, ওরা মানুষকে ভয় পায়

লাউয়াছড়া বন, বনের শেষপ্রান্তে খাসিয়াদের বাস

উঁচুনিচু টিলা, পাহাড়ি পথ। পথ পাড়ি দিতে কোথাও উঠতে হয় উঁচুতে, কোথাও ঢাল বেয়ে নিচে নামতে হয়। আছে সরু খাল। এসব পাড়ি দিয়ে খানিকটা পথ পেরুলেই উঁচু টিলার উপর বসবাস খাসিয়াদের। টিলায় উঠতে হয় পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তৈরি করা সিঁড়ি দিয়ে। সেখানেই খাসিয়াদের ঘরবাড়ি।

বাংলাদেশের সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জসহ এই অঞ্চলের চা-বাগান অধ্যুষিত এলাকাতে খাসিয়াদের বাস। খাসিয়ারা সাধারণত চা-বাগানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। এদের বড় একটি অংশের বাস ভারতের আসাম অঞ্চলের চা-বাগান অধ্যুষিত অঞ্চলে। ১৯ শতকে যখন সিলেট অঞ্চলে চা-বাগান তৈরি হতে থাকে, তখন সেখান থেকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এই জাতিসত্ত্বা এখানে বসবাস শুরু করে।

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। রাস্তার দু’ধারের অনিন্দ্যসুন্দর চা বাগান পার হতে না হতেই লাউয়াছড়া উদ্যান শুরু। বৃক্ষরাজি শোভিত এই বনে রয়েছে নানা প্রজাতির গাছ ও প্রাণি। বনের প্রবেশপথ দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে যেতেই ঘন জঙ্গল। বনের মাঝখানে লাউয়াছড়া বন গবেষণা কেন্দ্র। এরপর গভীর জঙ্গল। সেদিকে এগিয়ে গিয়ে কয়েকটি খাল পেরিয়ে বনের শেষপ্রান্তে খাসিয়াপুঞ্জি।

লাউয়াছড়া বনের খাসিয়াপুঞ্জিতে প্রতিদিন আগমন ঘটে শত শত দর্শনার্থীর। এরা বাঙালি। বিদেশি পর্যটকও যান সেখানে। তবে খাসিয়ারা নিজেদের ব্যপারে মুখ খোলেন না সহজে। খাসিয়া পুঞ্জিতে রয়েছে তাদের প্রার্থনা ঘর- চার্চ। সামনেই কাঠের তৈরি একটি বাড়ি। বাড়ির একটি ঘরে সাধারণ খাবারের দোকান। দোকানে বসেই কথা হলো। তবে সব প্রশ্নের উত্তর মিলল না। আমিও নাছোড়বান্দার মতো প্রশ্ন করতে লাগলাম। মনের কৌতূহল প্রকাশ করতে দ্বিধা করলাম না। ফলে কথায় কথায় কথা বাড়ল। ধীরে ধীরে আলাপ জমে উঠল। খাসিয়া নারী পিংকি পথমির সঙ্গে সেই আলাপের সূত্রেই উঠে এলো খাসিয়াপল্লীর মানুষের জীবনের নানা দিক।

খাসিয়া পুঞ্জিতে খাসিয়া রয়েছে ৩০ ঘর। দুই ঘর মুসলমান এবং এক ঘর হিন্দু ধর্মাবলম্বীর বসবাস এখানে। পল্লীর হিন্দু-মুসলিম ও খাসিয়ারা যুগ যুগ ধরে বাস করছে সৌহার্দ-সম্প্রীতির সঙ্গে। খাসিয়ারা খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী। সমগ্র পুঞ্জির জন্য রয়েছে একটি চার্চ- লাউয়াছড়া প্রেসবিটারিয়ান চার্চ; সংক্ষেপে এলপিসি। খাসিয়াদের বাড়ির সীমানা নির্দিষ্ট। তবে নেই কোন মাপজোখ। দীর্ঘদিনের চিরাচরিত নিয়মে পূর্বপুরুষকে ভোগ করতে দেখা স্থাবর সম্পতির যে সীমানা, সেটাই তারা ধরে রাখে। কখনও সীমানা নিয়ে কারো সঙ্গে দ্বন্দ্ব হয়নি। তাদের জমিজমার নেই কোনো কাগজ। মুখের কথার উপরেই জমিজমা সংক্রান্ত সকল কাজ হয়। জমিজমার উত্তরাধিকারও নির্ধারিত হয় মুখের কথায়।

খাসিয়া ছেলেমেয়েরা পার্শ্ববর্তী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে মাধ্যমিকে পা দেওয়া মাত্র চলে যায় শ্রীমঙ্গল। উচ্চ মাধ্যমিকে উঠলে কেউ কেউ চলে যায় মৌলভীবাজার বা সিলেট। পরিবার স্বচ্ছল হলে আসে ঢাকা শহরে। উচ্চ মাধ্যমিকের পর পড়াশোনা করতে চাইলে বাড়িতে থাকা সম্ভব হয় না। সে কারণে অধিকাংশ খাসিয়া মেয়ের পড়াশোনা উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। বাড়ি থেকে জঙ্গল পেরিয়ে কলেজে যাওয়াও খাসিয়া মেয়েদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

পিংকি পথমি ২০১৬ সালে এইচএসসি পাস করেছেন। পড়ালেখার ইতি সেখানেই। তারপর একবছর চাকরি করেছেন শ্রীমঙ্গলে। বাবা মারা যাওয়ায় বর্তমানে মায়ের সঙ্গে বাড়িতে অবস্থান করছেন। ছাত্রজীবনের অভিজ্ঞতার কথা জানান পিংকি। স্বাভাবিকভাবেই তাদের সঙ্গে বাঙালি সহপাঠী ছিল বেশি। তবুও বন্ধুত্ব হয়ে ওঠে খুব কম। কারণ বাঙালিরা তাদের সবসময় ভিন্ন চোখেই দেখে বলে পিংকির ধারণা। শুরুর দিকে তারা বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করলেও অপরপক্ষ থেকে ততটা সাড়া মেলেনি- এমন অভিযোগ তার। ফলে দূরত্ব থেকেই যায়। পড়াশোনা শেষ করে পিংকি একটি হাসপাতালের অভ্যর্থনা ডেস্কে কাজ নেন। সেখানে তাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। ফোন কলে তাকে প্রায়ই উত্যক্ত করা হতো। মুখ বুজে সহ্য করতে হতো জীবিকার প্রয়োজনে। কিন্তু এরপর বাবা মারা গেলে তিনি চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। 

লাউয়াছড়ার খাসিয়ারা জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। জুমে সাধারণত পান চাষ করা হয়। জুমের অধিকতর ভারি কাজগুলো পুরুষরা করে। নারীরা পান সংগ্রহ, পান গোছানো- এসব কাজ করে। নিজের জুমে কাজ না থাকলে তারা অন্যের জুমে শ্রম বিক্রি করে। খাসিয়া নারীরাও সময় পেলে অন্যের কাজ করে অর্থ উপার্জন করে। অন্যের জমিতে কিংবা বাড়িতে কাজ করাকে তারা ছোট কাজ মনে করে না। জুমে যে পান চাষ করা হয় তা সাধারণ চাষের মত নয়। বনের বড় বড় গাছ বেয়ে পানের ডগা উপরে উঠে যায়। সেকারণে বনের গাছগুলো তাদের জুম চাষে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কাঠচোরদের যন্ত্রণা জুমের জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষতি ডেকে আনছে। কাঠচোররা গাছ কেটে নিয়ে গেলে জুম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গাছ চুরি ঠেকাতে তাদের সারাদিন পাহারা দিতে হয়। আবার একজন বা দুজন পাহারা দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের জিম্মি করে কখনো কখনো গাছ কেটে নিয়ে যায় দুষ্কৃতিকারী। খাসিয়া পুরুষেরা দল বেঁধে জুম পাহারা দেয়।

শান্তিপ্রিয় নিরীহ প্রকৃতির খাসিয়াদের সখ্য প্রকৃতির সঙ্গে। দীর্ঘদিন বনে বাস করে প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকা খাসিয়ারা তাই বনের হিংস্র জন্তুর চেয়ে মানুষকে বেশি ভয় পায়।



ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়