ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

দাঁড়াও পথিকবর- আমার নাম কাইজেলিয়া

জাহিদ সাদেক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪০, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দাঁড়াও পথিকবর- আমার নাম কাইজেলিয়া

উত্তর বঙ্গের প্রাচীন বিদ্যাপীঠ কারমাইকেল কলেজের প্রধান ফটক থেকে একটু এগোতেই চোখে পড়ল একটি সাইনবোর্ড। লেখা: ‘দাঁড়াও পথিকবর- আমার নাম কাইজেলিয়া’।

কাইজেলিয়া এশিয়াতে আছে মাত্র পাঁচটি। এর মধ্যে দুটি আছে ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যাপীঠে। সুতরাং দাঁড়াতেই হলো। কিন্তু সেখানে দেখা মিলল একটির। আরেকটি কোথায়? খোঁজ নিতে জানা গেল আরেকটি গাছ রয়েছে খানিকটা অদূরে ক্যাম্পাসের মসজিদের সামনে।

তবে সাইনবোর্ডে গাছটির উৎস কিংবা উৎপত্তি সম্পর্কে কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগ, শিক্ষক কিংবা স্থানীয়  প্রবীণদের কাছে সঠিক তথ্য নেই জেনে বিস্মিত হলাম। আবার ভাবলাম- বিস্ময়কর এমন তথ্য দেশের ক’জনেরই বা জানা?

কারমাইকেল কলেজের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯১৬ থেকে ১৯২০ সালে কলেজটির প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে কেউ এই দুর্লভ প্রজাতির তিনটি গাছ এখানে রোপণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে একটি মরে গেলেও এখন রয়েছে দুটি। তবে কেউ কেউ বলেন, সে সময় বড় রকমের কোনো ঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের মাধ্যমেও চারা এখানে এসে গজিয়ে উঠতে পারে।

দ্বিজেন শর্মা রচিত ‘বাংলাদেশের বৃক্ষ’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম ‘কাইজেলিয়া আফ্রিকানা’। এদের আদি নিবাস আফ্রিকার সেনেগালে। কাইজেলিয়া গাছের উচ্চতা হয়ে থাকে ২০ থেকে ২৫ মিটার। শীতের শেষে ফাল্গুন, চৈত্র ও বৈশাখ মাসে গাছে এক ধরনের ফুল ফোটে। রং হয় মেরুন অথবা কালচে লাল। ফল দেখতে সুন্দর, লম্বা ও গোলাকৃতির অনেকটা মোটা বেগুনের মতো। একেকটি ফলের ওজন হয় ৫ থেকে ১০ কেজি। এই গাছের ফল ভয়ানক বিষাক্ত হলেও প্রক্রিয়াজাত করে আলসার, সর্প দংশনের প্রতিষেধক, বাত, ছত্রাক, চর্মরোগ, মহিলাদের প্রসাধন সামগ্রী এমনকি ক্যানসার রোগের চিকিৎসাতেও ব্যবহৃত হয়।

ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় যেন কারমাইকেল কলেজের বিশাল ক্যাম্পাস। অজস্র বৃক্ষরাজের সবুজ সমারোহ আর মনোরম প্রাকৃতিক আলোছায়ায় লুকিয়ে আছে মহামূল্যবান কাইজেলিয়া গাছ দুটি। দেশ বিদেশের অনেকেই হয়তো এই তথ্য জানেন না।

খোঁজ নিয়ে জানলাম, কাইজেলিয়ার পরাগায়ন প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল হওয়ায় এত দিন এর চারা উদ্ভাবন করা যায়নি। তবে এ ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন কারমাইকেল কলেজের বাগান মালি বাটুল সিং। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর তিনি এই গাছের চারা উৎপাদন করতে পেরেছেন। বাটুল সিং প্রায় ১০ বছর ধরে দেশীয় সনাতন পদ্ধতিতে চেষ্টা করেছেন। অবশেষে গত বছরের শেষ দিকে তিনি কয়েকটি চারা উৎপাদনে সক্ষম হন।

 

 

কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও সহযোগী অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের ভাষ্য মতে, তিনি যখন ‘৭৫ সালে কারমাইকেল কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হন তখন থেকেই গাছ তিনটি দেখছেন। তখন এগুলো সবার কাছে ‘অচিন বৃক্ষ’ নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু ৯৪-৯৫ সালে কলেজের তৎকালীন উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. মোস্তফা কামাল পাশা গাছ দুটির ওপর বিষদ গবেষণা চালিয়ে আবিষ্কার করেন এর আদ্যোপান্ত। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি দলও   গবেষণা করেন। যেহেতু এই গাছের প্রজনন কিংবা বংশ বৃদ্ধি অত্যন্ত জটিল তাই টিস্যু কালচারের মাধ্যমে গাছ থেকে তারা ১১টি চারা উৎপন্ন করেন এবং কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সামনে রোপণ করেন। বাকি ৯টি চারা রোপণ করা হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে। মজার বিষয় হলো অপর ওই ৯টি চারা মরে গেলেও এখানকার দুটি বেড়ে উঠেছে। অর্থাৎ এই ক্যাম্পাসে প্রবীণ এবং নবীন মিলে চারটি কাইজেলিয়া গাছ রয়েছে।

দুর্লভ ও বিরল প্রজাতির গাছটি দেখতে অনেকদিন আগে থেকেই দেশ-বিদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ছাড়াও পর্যটকদের অনেকেই এখানে আসেন এবং জানার চেষ্টা করেন। তারা এর ছবিও তুলে নিয়ে যান। ইতোমধ্যেই কাইজেলিয়ার স্মৃতি ধরে রাখতে কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে কারমাইকেল কাইজেলিয়া শিক্ষা সংস্কৃতি সংসদ (কাকাশিস)। সংগঠনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক চন্দন সাহা বাপ্পী জানান, আমরা একদিন থাকব না। হয়ত এ গাছগুলোও থাকবে না। তাই আমরা এর স্মৃতি আগামী প্রজন্মের কাছে ধরে রাখার জন্যই এ গাছের নামে সংগঠনের আত্মপ্রকাশ করেছি।

কলেজের প্রফেসর ড. শেখ আনোয়ার হোসেন জানান, ‘প্রায়ই দেশ বিদেশের অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং পর্যটক আসেন। তাঁরা এ গাছ সম্পর্কে জানতে চান। তিনি জানান, যেহেতু এটি একটি বিরল এবং দুর্লভ প্রজাতির গাছ। এবং অনেক ব্যাধির ঔষধি কাজে ব্যবহৃত হয়; এটাও প্রমাণিত যে, এখানকার মাটি ও আবহাওয়া এই গাছের জন্য উপযোগী, সেহেতু টিস্যু কালচারের মাধ্যমেই হোক আর অন্য যেকোন উপায়েই হোক এর বংশ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া উচিত। এজন্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কৃষি বিভাগকেই এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়