ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

মা হবার তাড়নায় ছুটে এসে মৃত্যু

খায়রুল বাশার আশিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১৯, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মা হবার তাড়নায় ছুটে এসে মৃত্যু

দৈর্ঘ্য কমপক্ষে ৩ ফিট, প্রস্থে ২ ফিট। আনুমানিক ওজন ২০ কেজি। বিশাল আকৃতির এই কচ্ছপ মৃত পড়েছিল সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণপাড়া এলাকার প্রবাল সৈকতে।

এত বড় কচ্ছপ কেন এবং কীভাবে মারা গেল? বিস্ময়ে জানতে চেয়েছিলাম স্থানীয় একাধিক মানুষের কাছে। তারা জানালেন, জেলেদের জালে জড়িয়ে এভাবে মারা যায় বড় আকৃতির কচ্ছপ। বিক্রি কিংবা পরিবহন নিষিদ্ধ থাকায় বিচে ফেলে রেখে চলে যায় জেলেরা। একাধিক মানুষের মুখে উঠে আসে আরো কিছু তথ্য। জানা যায়, অসাধু জেলেদের কারেন্ট জাল কিংবা বিহুন্দি জাল কচ্ছপের মৃত্যুর অন্যতম কারণ।

সেন্ট মার্টিন উপকূলের কাছাকাছি প্রতিদিন কমপক্ষে ৩ হাজার জেলে মাছ ধরে। এসব জেলেদের কাছে দুই হাজারের বেশি বিহন্দি জাল রয়েছে। এছাড়া সাগরে মাছ ধরা ট্রলার থেকেও বড় ভাসাজাল, ডুবোজাল, বিহুন্দি ও লাক্ষ্যা জাল পেতে রাখা হয় সাগরে। অপরদিকে জীবনচক্রের নিয়মে সমুদ্রের মাঝ থেকে হাজার কি.মি. পথ পাড়ি দিয়ে একেকটি কচ্ছপ ডিম দিতে ছুটে আসে বালুচরের সৈকতে। মা হবার তাড়নায় ছুটে আসা এসব কচ্ছপ জেলেদের জালে আটকা পড়ে। জেলেরা ঝামেলা এড়াতে বৈঠা, বাঁশ, কাঠ বা ধারালো দা দিয়ে কচ্ছপগুলো নির্মমভাবে হত্যা করে সমুদ্রে ফেলে দেয়। এসব মৃত কচ্ছপের নিথর দেহ জোয়ার কিংবা ঢেউয়ের সাথে ভেসে আসে সৈকতে। 

সামুদ্রিক কচ্ছপ রক্ষণাবেক্ষণের কথা বলা আছে সেন্ট মার্টিনের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর বিলবোর্ড কিংবা ব্যানারে। জায়গাটি কচ্ছপ প্রজননের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান বিবেচনা করা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। বাস্তবতা বলছে, দ্বীপের অসাধু জেলেদের জন্য কচ্ছপ আজ হুমকির মুখে। এছাড়াও বিচের পাশেই অপরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা, সৈকতে আলোর ঝিলিক, গানবাজনার বিকট শব্দ ও পর্যটকদের অনিয়ন্ত্রিত পদচারণার ফলে কচ্ছপের ডিম দেয়ার পরিবেশ আজ বিপন্ন।

বিষয়টি নিয়ে কথা হলে প্রাণ-প্রকৃতি বিষয়ক সিনিয়র সাংবাদিক হোসেন সেহেল বলেন, গত বছরপাঁচেক আগেও সোনাদিয়া ও সেন্ট মার্টিন সমুদ্র সৈকতে অনেক বড় আকৃতির মা কচ্ছপ ডিম দিতে আসত। কিন্তু এখন তারা আসছে না। এছাড়া টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের সৈকতে এখনো দু’একটি মা কচ্ছপ চোখে পড়লেও ইনানী, কক্সবাজার, হিমছড়ি কিংবা পেঁচার দ্বীপে এখন আর তারা ডিম দিতে আসে না। এর মূল কারণ ডিম দেয়ার মত পরিবেশ না থাকা।

তিনি আরও বলেন, প্রবাল ধ্বংস, সৈকত দূষণসহ নানা কারণে কচ্ছপ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তারা ডিম না পেড়েই পুনরায় সমুদ্রে চলে যাচ্ছে। কখনো আবার বালুচরে উঠতে না পেরে পানিতেই ডিম দিচ্ছে। সে ডিমগুলো থেকে বাচ্চা ফোটে না। মা হবার বাসনা অপূর্ণ রেখেই তাদের চলে যেতে হচ্ছে। এতসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও যে দু-একটি কচ্ছপ উপকূলে আসে তারাও যদি অসাধু জেলেদের হাতে প্রাণ হারায় তাহলে একদিন কচ্ছপের অস্তিত্বই থাকবে না।

২০০১ সালে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলো কচ্ছপ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। ফলশ্রুতিতে সামুদ্রিক কচ্ছপ সংরক্ষণ, কচ্ছপ বিষয়ক শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশ সরকার ২০০৪ সালে চুক্তিতে স্বাক্ষর করার মাধ্যমে সামুদ্রিক কচ্ছপ রক্ষায় অঙ্গীকার করে। 

প্রাণ প্রকৃতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের এমন অঙ্গীকার থাকা সত্ত্বেও কেন সেন্ট মার্টিন উপকূলে কচ্ছপের এমন দুর্দশা সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কচ্ছপ সংরক্ষণে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক সমন্বয় এখন সময়ের দাবি।  পাশাপাশি কচ্ছপ সংরক্ষণে জাতীয় উদ্যোগ না নেয়া হলে অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে এই প্রাণি।


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়