এইখানে এক নদী ছিল
বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল। কখনও ধান ক্ষেত। কখনও ধু ধু মাঠ। কোথাও পানির চিহ্ন নেই। স্পষ্ট দেখা যায় দু'টি বয়া। একটু গভীরভাবে তাকালে বুঝতে কষ্ট হয় না, বয়া দু'টি শত বছরের ইতিহাসের ধারক। বয়া দুটি বলে দেয় এখানে এক সময় খরস্রোতা মেঘনা নদীর অস্তিত্ব ছিল।
নৌ-যান চলাচলে নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন ধরনের নির্দেশক চিহ্ন স্থাপন করে নৌ-মন্ত্রণালয়। নির্দেশক চিহ্নগুলোর মধ্যে বয়া প্রাচীন একটি চিহ্ন। সমুদ্র, নদীতে পণ্যবাহী জাহাজ, ফেরী, লঞ্চ, স্টিমারসহ অন্যান্য নৌ-যান বিপদ থেকে রক্ষায় বয়া যুগ যুগ ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বয়ার আকৃতি গোলাকার, যা লোহার তৈরি। একটি লৌহ দণ্ডের সাথে নদী বা সমুদ্রের গভীর তলদেশে শিকল দ্বারা সংযুক্ত করা হয়। ফলে বয়া ওই স্থান থেকে সহজে সরে না। বয়ার সঙ্গে লৌহ দণ্ডের আংটা থাকে। সারেং চাইলে আংটাতে শিকল লাগিয়ে জাহাজ, লঞ্চ, ফেরীর মতো পণ্যবাহী নৌ-যান নোঙর করতে পারেন।
বয়া নির্দেশনা দেয়, সামনে নাব্যতা সংকট আছে বা অন্য কোনো বিপদ আছে। সেদিকে যেন নৌ-যান না যায়। বর্তমানেও সাগর ও নদীর মোহনায় এমন বয়ার দেখা মিলে। তবে, সভ্যতার পরিক্রমায় বয়ার সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত হয়েছে। বয়ার সঙ্গে অত্যাধুনিক ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। ফলে সমুদ্র বা নদীর তলদেশের অনেক বিস্ময়কর ছবি পাওয়া যায়।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুর সদরের ১৯নং তেওয়ারীগঞ্জ ইউনিয়নের মৌলভীরহাটে দু'টি বয়ার দেখা মেলে। সেগুলো এখন বিস্তীর্ণ ফসলি মাঠের মাঝখানে রয়েছে। বয়া দু'টিকে কেন্দ্র করে ওই অঞ্চল ‘বয়ার চর’ নামেও পরিচিত। প্রায় দুই শতাধিক বছরের বয়া দু'টি প্রমাণ করে এখানে এক সময় নদী ছিল।
লক্ষ্মীপুর জেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও তথ্যকোষ সমৃদ্ধ গ্রন্থ ‘লক্ষ্মীপুর ডায়েরি’ থেকে জানা যায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে মেঘনা নদী বর্তমান লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার শহর কসবা, ফরাশগঞ্জ, ভবানীগঞ্জের পাশ দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে প্রবাহিত ছিল। প্রমত্তা মেঘনার এই শাখাটির নাম ছিল কুশাখালী নদী। কুশাখালীর ভাঙনে তৎকালীন বহু জনপদ লণ্ডভণ্ড হয়েছে। বয়ার এই চরের পাশেই ফরাশগঞ্জ ছিল তৎকালীন নৌ-বন্দর। এখানে বড় বড় জাহাজ ভিড়ত। জাহাজ ভিড়াবার জন্য ব্রিটিশরা এখানে কয়েকটি বয়া স্থাপন করে। সেগুলোর মধ্যে এ দু'টি বয়াও ছিল।
কমলনগরের তোরাবগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নজিব উল্লাহ বলেন, ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৪ সালের মধ্যে চর জাগতে জাগতে মেঘনা চলে যায় ৩৫কি.মি. পশ্চিমে। তখন থেকে সেখানে গড়ে উঠতে থাকে নতুন জনপদ। মাটি চাপা পড়ে অসংখ্য বয়া। তবে এই দু'টি বয়া রয়ে গেছে। তিনি জানান, শুধু লক্ষ্মীপুর না, নোয়াখালীতেও একটি বয়ার চর আছে। তবে সেখানে বয়ার কোন অস্তিত্ব নেই।
বয়া দু'টি নিয়ে ছোটবেলার স্মৃতির কথা জানান সাংবাদিক শাহ আলম। তিনি বলেন, দল বেঁধে শাপলা আর শামুক কুড়াতে যেতাম বয়ার চরে। বর্ষাকালে বেড়িবাঁধ পার হয়ে সরু খালে (যেটি এক সময় নদী ছিল বলে শুনেছি) সাঁতরে পৌঁছে যেতাম বয়ার চরে। চরজুড়ে ছিল বাথানের মহিষের রাজত্ব। রাখাল বালকের সাথে আলগা খাতির জমিয়ে কতবার মহিষের পিঠে চড়েছি। জোঁকের ভয়ে কতবার এই বয়ায় উঠে বসে থেকেছি। দাদার কাছে শুনেছি এই বয়ার ইতিহাস। উপকূলের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা ইতিহাসের উপাদানগুলো সংরক্ষণে কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
বয়া দু'টি পড়ে আছে অযত্ন-অবহেলায়। সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কোনো নজর নেই। বয়া দু'টিকে ঘিরে হতে পারে পর্যটন কেন্দ্র। তবে এ বিষয়ে আলাপ হলে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক অঞ্জনচন্দ্র পাল বলেন, বয়া দু'টি প্রত্নতত্ত্বের জন্য অনেক মূল্যবান। এগুলো সংরক্ষণ করলে আগামী প্রজন্ম তাদের অঞ্চলের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা পাবে। বয়া দু'টি সংরক্ষণ এবং এজন্য যা যা করা দরকার, সে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ঢাকা/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন