ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

প্রলয়ঙ্করী সেই ঘূর্ণিঝড়: কতটা সুরক্ষিত উপকূল?

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৩৭, ২৯ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রলয়ঙ্করী সেই ঘূর্ণিঝড়: কতটা সুরক্ষিত উপকূল?

‘আকাশ ভারি হয়ে আছে দুপুর থেকে। গুমোট চারদিক। সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টি হচ্ছে গুঁড়িগুঁড়ি। কান পেতে আছি রেডিওতে। সতর্কীকরণ সংকেত বেড়ে চলেছে। বাড়ছে আমাদের ভয়। কিছু মানুষ ছুটে যাচ্ছে আশ্রয়কেন্দ্রে। অনেকে আবার পাত্তা দেয়নি। রাত দশটার দিকে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলো। সকালে দেখি চারদিকে লাশ আর লাশ!’

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের সেই ঘূর্ণিঝড়ের বর্ণনা দিচ্ছিলেন সন্দ্বীপের সারিকাইত ইউনিয়নের বিজেন্দ্র চন্দ্র জলদাস। তার বয়স এখন ৭৫ বছর। ঘূর্ণিঝড়ের কথা মনে করেই দিতেই স্মৃতিগুলো যেন তার চোখের নামনে জ¦লজ¦ল করে উঠলো। বললেন, ‘অল্পের জন্য সেবার বেঁচে গেছি।’

প্রত্যক্ষদর্শীদের দেওয়া তথ্য মতে, সে রাতে ঘূর্ণিঝড়ের তা-বে বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয়েছিল উপকূলীয় জনপদ। সবকিছু মিশে যায় মাটির সঙ্গে। রাত দশটার দিকে শুরু হওয়া ঝড় চলতে থাকে টানা ভোর পর্যন্ত। যারা আশ্রয়কেন্দ্রে না গিয়ে বাড়িঘরে ছিলেন; তাদের প্রাণহানি ঘটেছে বেশি। তবে সে সময় সব মানুষের আশ্রয় নেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় আশ্রয়কেন্দ্র ছিল না। আবার মানুষের মাঝে ঘূর্ণিঝড় বিষয়ে ছিল না তেমন সচেতনতা। ফলে ক্ষতির মাত্রা ছিল অনেক। প্রাণ হারিয়েছিল ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ। সব হারিয়ে পথে বসেছিল প্রায় এক কোটি মানুষ। ৩৯ বছর পরেও প্রশ্ন জাগে- বাংলাদেশের উপকূল কতটা সুরক্ষিত?

কেমন ছিল সে ঘূর্ণিঝড়?   

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল রাতের সেই ঘূর্ণিঝড়কে শতাব্দীর ‘প্রচ-তম ঘূর্ণিঝড়’ আখ্যা দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ১২-২২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস নিয়ে ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল সর্বোচ্চ ২২৫ কিলোমিটার। প্রায় ছয় ঘণ্টা স্থলভাগে তা-ব চালায় ঘূর্ণিঝড়টি। কিন্তু সাধারণত সাইক্লোন ২-৩ ঘণ্টার বেশি স্থায়ী হয় না। ঘূর্ণিঝড়ে তেলের ট্যাংকার পর্যন্ত উপরে উঠে গিয়েছিল। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে সেবছর ২২ এপ্রিল বঙ্গোপসাগরে গভীর নি¤œচাপের সৃষ্টি হয়েছিল। এটি ২৪শে এপ্রিল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। ২৯শে এপ্রিল রাতে এটি চট্টগ্রামের উপকূলবর্তী অঞ্চলে আঘাত করে।

প্রান্তিক উপকূল এখনও অরক্ষিত

স্বাধীনতা পরবর্তীকালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ এগিয়েছে অনেকখানি। ঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণ ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। অসংখ্য আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। বেড়িবাঁধ নির্মিত হয়েছে। রাস্তাঘাটের উন্নয়ন ঘটেছে। এইসব ব্যবস্থার কারণে দুর্যোগে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমেছে। কিন্তু এখনও রয়েছে ঝুঁকি। উপকূলের বহু এলাকা এখনও রয়েছে অরক্ষিত। জোয়ারের পানি বাড়লেই ডুবে যায় ঘরবাড়ি। ছোট ধাক্কাতেই ভেঙে যায় নাজুক বেড়িবাঁধ। উপকূলের সব স্থানে যেমন বেড়িবাঁধ নেই, তেমনি বাঁধের উচ্চতাও প্রয়োজন অনুযায়ী বাড়ানো হয়নি। ফলে ৯১-এর সেই ঘূর্ণিঝড়ের মতো  বড় আকারের কোনো ধাক্কা উপকূলে এলে ক্ষয়ক্ষতি যে হবে না- এটা বলা যায় না।

সরেজমিনে পাওয়া মাঠের তথ্যসূত্র বলছে, প্রান্তিক উপকূলের বহু মানুষ এখনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের আতঙ্কে দিন কাটান। জোয়ারের পানি বাড়লে, জলোচ্ছ্বাস হলে, ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত পড়লে ভয় বাড়ে। পূর্ব উপকূলের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের মানুষ গত কয়েক বছরে চরম ভোগান্তিতে দিন কাটাচ্ছে। স্বাভাবিক জোয়ারের পানিতেও বাড়িঘর, ফসলি জমি ডুবে যাচ্ছে। লবণের মাত্রা অস্বাভাবিক বেড়েছে। ভাঙনে দ্বীপটি ছোট হয়ে গেছে, বহু মানুষ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। লবণচাষি, মৎস্যজীবী, কৃষিজীবীরা পেশা বদল করেছে।

নোয়াখালীর ঐতিহ্যবাহী দ্বীপ হাতিয়া ক্রমেই ছোট হচ্ছে। নলচিরা, সুখচর, তমরুদ্দি ক্রমাগত ভাঙছে। সুখচর ইউনিয়ন প্রায় বিলীন হওয়ার পথে। হাতিয়ার দ্বীপচরগুলোতে থাকা হাজারো মানুষের বিপন্নতায় বসবাস। আকাশে মেঘ দেখলেই তাদের আতঙ্ক বাড়ে। হাতিয়ার পশ্চিমে, রামগতি-আলেকজান্ডারের দক্ষিণে, মনপুরার উত্তরে এবং ভোলা-দৌলতখানের পূর্বে মেঘনার বুকে রয়েছে বৃহৎ চরাঞ্চল। দ্বীপ জেলা ভোলার মনপুরার মানুষ এখনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কাছে অসহায়। এ উপজেলায় রয়েছে চর নিজাম কলাতলী, ঢালচরসহ বেশ কয়েকটি চর। এতে অসংখ্য মানুষের বসবাস। জীবন বাঁচানোর মতো আশ্রয়ের ব্যবস্থা এসব চরে একেবারেই সীমিত। বড় কোনো গাছপালাও নেই, যা ধরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে চরবাসীরা জীবন রক্ষা করবে। চরফ্যাসনের ঢালচর সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে। নদী ভাঙনের কারণে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় থাকা এ দ্বীপটি এরইমধ্যে অনেক ছোট হয়ে গেছে। পটুয়াখালীর গলাচিপা, কলাপাড়া, রাঙ্গাবালী, দশমিনা, বাউফলে রয়েছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে থাকা বেশকিছু অরক্ষিত চরাঞ্চল। একই অবস্থা রাঙ্গাবালীর দ্বীপ ইউনিয়ন চালিতাবুনিয়ার। গলাচিপার চরকাজল, চর বিশ^াস, পানপট্টির অনেক স্থানের মানুষের বারোমাসই ঝুঁকিতে বসবাস। বরগুনার তালতলী, পাথরঘাটা, পিরোজপুরের মাঝেরচর, শরণখোলার বগী, তাফালবাড়িয়া, খুলনার কয়রা, দাকোপ, সাতক্ষীরার গাবুরার প্রাকৃতিক ঝুঁকি কোনভাবেই কমছে না।

কিছুটা আশার আলো

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল যে সন্দ্বীপের; সেখানে এবার নতুন বেড়িবাঁধ হয়েছে। যুগের পর যুগ ক্রমাগত ভাঙনের মুখে থাকা সন্দ্বীপের মানুষ দেখছে আশার আলো। বেড়িবাঁধ নির্মাণের আগেই অনেক স্থানে পলি জমতে শুরু করেছিল। এবার মানুষ হয়তো স্বস্তিতে বসবাস করতে পারবে। ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু ক্ষতি করেছিল যে বাঁশখালীর ছনুয়া ও খানখানাবাদের; সেখানে বাঁধ হয়েছে। তবে একই ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ কুতুবদিয়ার উত্তর ধূরুং, দক্ষিণ ধূরুং কিংবা আলী আকবর ডেইলের অবস্থার কোনো বদল হয়নি। এদিকে অরক্ষিত থাকা দ্বীপ ইউনিয়ন কুকরি মুকরির চারিদিকে বেড়িবাঁধ হলেও পাশের দ্বীপ ঢালচরের সংকট রয়েই গেল। ক্ষত শুকায়নি সিডর বিধ্বস্ত শরণখোলা কিংবা আইলা বিধ্বস্ত গাবুরা, আশাশুনি এলাকার। ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র কিংবা সতর্কীকরণ বার্তা প্রচারের ক্ষেত্রেও অবস্থার কিছুটা উন্নয়ন ঘটেছে।

দরকার আরও উদ্যোগ, সচেতনতা

প্রাকৃতিক বিপদ মোকাবিলায় স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি শক্ত ও উঁচু বেড়িবাঁধ নির্মাণের। একইসঙ্গে প্রয়োজনীয় সংখ্যক আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন তারা। আশ্রয়কেন্দ্রে ভালো পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবিও জানিয়েছেন তারা। একইসঙ্গে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সড়ক যাতে চলাচল উপযোগী থাকে, সে বিষয়ে নজর রাখার দাবি উপকূলবাসীর। সিগন্যাল সম্পর্কে সর্বস্তরে সচেতনতা বাড়ালে প্রাকৃতিক বিপদ অনেকটা কমে আসবে বলে মনে করেন ঝুঁকিপ্রবণ এলাকার বাসিন্দারা।


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়