ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

সেদিন বিশ্ব গণমাধ্যমে শুধু বঙ্গবন্ধু

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:০৮, ১৪ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সেদিন বিশ্ব গণমাধ্যমে শুধু বঙ্গবন্ধু

এস‌কে রেজা পার‌ভেজ: স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি তিনি। নিজের পুরো জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন বাংলার মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে। যৌবন কাটিয়েছেন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। পরিবারকে সময় দিতে পারেননি। শুধু চিন্তায় থেকেছেন শোষিত এই বাংলার মানুষকে দিতে হবে মুক্তির স্বাদ। সারাজীবন ত্যাগ, তিতিক্ষা ও সংগ্রামী জীবনের এই মানুষটি বাংলার অহংকার প্রাণের নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের আরেক নাম।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটিয়ে বাংলার মানুষকে পুরো বিশ্বের কাছে ‘বিশ্বাসঘাতক’ এর তকমা জুটিয়ে দিয়েছে কিছু মানুষরূপী জানোয়ার। পাকিস্তান কখনো যা করতে সাহস করেনি, স্বাধীন দেশে দাঁড়িয়ে সেটিই করে দেখিয়েছে এদেশের কিছু বিশ্বাসঘাতক।

এই বিশ্বাসঘাতক রাজনীতিকদের চক্রান্ত এবং সেনাবাহিনীর একদল উচ্ছৃঙ্খল উচ্চাভিলাষী সদস্যের নির্মম বুলেটের আঘাত ওইদিন শুধু বঙ্গবন্ধুকে আঘাত করেনি, আঘাত করেছে পুরো বাংলাদেশের মানুষের। শোকে বিধ্বস্ত, হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলো পুরো দেশ। আর বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে বলেছে, এও কি সম্ভব? একটি দেশ তার স্থপতি, মহান নেতাকে কিভাবে হত্যা করে? এই প্রশ্ন আর হতাশা এখনো বয়ে বেড়ায় দেশের মানুষ।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট কালরাতে ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধু সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল। পৃথিবীর এই ঘৃণ্যতম হত্যাকান্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর সহোদর শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মনি, তার সহধর্মিনী আরজু মনি ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও আত্মীয়-স্বজন।

সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক বিপদগামী সদস্য সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর গোটা বিশ্বে নেমে আসে তীব্র শোকের ছায়া এবং ছড়িয়ে পড়ে ঘৃণার বিষবাষ্প।

ভারত বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক নীরদ সি চৌধুরী বাঙালিদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেছেন, বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানুষের কাছে নিজেদের আত্মঘাতী চরিত্রই তুলে ধরেছে।

‘দ্য টাইমস অব লন্ডন’ এর ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় উল্লেখ বলা হয় ‘সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সবসময় স্মরণ করা হবে। কারণ তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোন অস্তিত্ব নেই।’

একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকান্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’

ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন-‘শেখ মুজিব নিহত হবার খবরে আমি মর্মাহত। তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন। তার অনন্য সাধারণ সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগণের জন্য প্রেরণাদায়ক ছিল।’

বৃটিশ এমপি জেমসলামন্ড বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশই শুধু এতিম হয়নি, বিশ্ববাসী হারিয়েছে একজন মহান সন্তানকে।’

ব্রিটিশ লর্ড ফেন্যার ব্রোকওয়ে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব জর্জ ওয়াশিংটন, গান্ধী এবং দ্য ভ্যালেরার থেকেও মহান নেতা ছিলেন।’

জাপানি নাগরিক মুক্তি ফুকিউরা বাঙালি দেখলে বলতেন, ‘তুমি বাংলার লোক? আমি কিন্তু তোমাদের জয় বাংলা দেখেছি। শেখ মুজিব দেখেছি। জানো এশিয়ায় তোমাদের শেখ মুজিবের মতো সিংহ হৃদয়বান নেতার জন্ম হবে না বহুকাল।’

বিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ত্রো বলেছিলেন- ‘আমি হিমালয় দেখিনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।’

ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন বলছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রথম শহীদ। তাই তিনি অমর।’

ফিলিস্তিনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও নোবেল শান্তি পুরষ্কার বিজয়ী ইয়াসির আরাফাত বলেছিলেন, ‘আপসহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম কোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।’

জাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট কেনেথা কাউণ্ডা বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান ভিয়েতনামী জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।’

মরহুম মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিবের কবর একদিন সমাধিস্থলে রূপান্তরিত হবে এবং বাঙালির তীর্থস্থানের মতো রূপলাভ করবে।’

বঙ্গবন্ধুর নিহত হবার সংবাদ শুনে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এতটাই দুঃখ পেয়েছিলেন যে, তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমারই দেয়া ট্যাঙ্ক দিয়ে আমার বন্ধু মুজিবকে হত্যা করেছ! আমি নিজেই নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি।’

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর শোকে পাথর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে আসার জন্য জার্মানির একটি এয়ারপোর্টে তার পাসপোর্টটি ইমিগ্রেশন অফিসারকে দেখালে সেই অফিসার পাসপোর্টটি দেখেই শেখ হাসিনাকে বললেন ‘ছিঃ তোমরা বাংলাদেশিরা খুব জঘন্য একটি জাতি, যেই মানুষটি তোমাদেরকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন তাকেই তোমরা হত্যা করে ফেললে?’

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে সরাসরি অবস্থান নিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হেনির কিসিঞ্জার বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মত তেজী এবং গতিশীল নেতা আগামী বিশ বছরের মধ্যে এশিয়া মহাদেশে আর পাওয়া যাবে না।’

ফিন্যান্সিয়াল টাইমস্ উল্লেখ করে, ‘মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনই জন্ম নিত না।’

বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবর পাওয়ার পর পশ্চিম জার্মানি পত্রিকায় বলা হয়েছিল, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে চতুর্দশ লুইয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায়। জনগণ তার কাছে এত জনপ্রিয় ছিল যে লুইয়ের মতো তিনি এ দাবি করতে পারেন যে, আমিই রাষ্ট্র।’

১৫ আগস্ট ওই ঘটনার পর বিবিসি প্রকাশ করে, ‘শেখ মুজিব নিহত হলেন তার নিজেরই সেনাবাহিনীর হাতে। অথচ তাকে হত্যা করতে পাকিস্তানিরা সংকোচবোধ করেছে।’

ভারতীয় বেতার ‘আকাশ বাণী’ ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট তাদের সংবাদ পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে বলে, ‘যিশু মারা গেছেন। এখন লক্ষ লক্ষ লোক ক্রস ধারণ করে তাকে স্মরণ করছেন। মূলত একদিন মুজিবই হবেন যিশুর মতো।’

একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’

নিউজ উইকে বঙ্গবন্ধুকে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ বলে আখ্যা দেয়া হয়।

১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগে শোষক শ্রেণি, আরেক ভাগে শোষিত। আমি শোষিতের দলে।’

ওই ভাষণের পর কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ত্রো শেখ মুজিবুর রহমানকে বলেছিলেন, ‘তুমি আজ যে ভাষণ দিলে, এখন থেকে সাবধানে থেকো। আজ থেকে তোমাকে হত্যার জন্য একটি বুলেট তোমার পিছু নিয়েছে।’ ফিদেল ক্যাস্ত্রোর সেদিনের কথাটিই সত্য হয়ে যায় ঠিক দুই বছরের মাথায়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী টাইম ম্যাগাজিন ১৯৮২ সালের ৫ এপ্রিল তাদের একটি সংখ্যায় উল্লেখ করে, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দশ বছরের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের আমল ছিল সর্বপ্রথম এবং দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আমল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক ও প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবকে হত্যার পর হঠাৎ গণতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটে।’
 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ আগস্ট ২০১৯/রেজা/এনএ/নাসিম

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়