ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

যত দোষ, নারী ঘোষ || প্রভাষ আমিন

প্রভাষ আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২২, ২৯ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যত দোষ, নারী ঘোষ || প্রভাষ আমিন

প্রভাষ আমিন

এক বিচারক ছিলেন। তার কাছে কেউ কোনো বিচার নিয়ে গেলে তিনি প্রথমেই প্রশ্ন করতেন- নারীটা কে? দূষিত চিন্তার সেই বিচারকের ধারণা পৃথিবীর সব সমস্যার পেছনেই কোনো না কোনো নারী আছে। তো একবার এক ডেকোরেটর মালিক তার কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিচার নিয়ে গেলেন। অভিযোগ হলো, সে মাথায় করে অনেকগুলো প্লেট নিয়ে এক জায়গায় যাচ্ছিল। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় পড়ে গিয়ে সব প্লেট ভেঙ্গে গেছে। খামখেয়ালীর অভিযোগ এনে তিনি ক্ষতিপূরণ চান। যথারীতি বিচারক জানতে চাইলেন- নারীটা কে?

ক্ষতির মুখে পড়া ডেকোরেটর মালিক ক্ষেপে গিয়ে বললেন, হুজুর এখানে কোনো নারী নেই। আমার অফিসেও নেই, যেখানে যাচ্ছিল সেখানেও নেই, যে সিঁড়িতে ঘটনা সেখানেও কোনো নারী ছিল না। কিন্তু বিচারক তার প্রশ্নে অনড়। পরে সরেজমিন তদন্ত শেষে অভিযুক্ত কর্মচারীকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, বিচারকই ঠিক। কর্মচারীটি সিঁড়ি ভাঙ্গার সময় দূরে এক বাসার ছাদে এক নারীকে দেখে সেদিকে তাকিয়ে হাঁটতে গিয়েই বেচারা হোঁচট খায়, আর তাতেই প্লেটগুলো...।   বিচারক এবার খুশী হলেন। সব ব্যাপারেই নারীদের ভিলেন বানানোর চেষ্টায় তিনি সফল। সেই বিচারকের মতো দূষিত চিন্তার মানুষ এই  সময়ে আমাদের চারপাশে অনেক আছে, যারা সব বিষয়ে নারীর ওপর দায় চাপিয়ে, নারীকে ভিলেন বানিয়ে খুশি হন।

গত বুধবার সকালে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে কয়েকজন বখাটে ও সন্ত্রাসী সবার সামনে রাম দা দিয়ে কুপিয়ে রিফাত শরীফ নামে এক যুবককে হত্যা করে। এ সময় রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি সন্ত্রাসীদের হাত থেকে স্বামীকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পারেননি। অনেকের উপস্থিতিতে দুই সন্ত্রাসী মিন্নির সামনেই তার স্বামীকে কুপিয়ে হত্যা করে। ঘটনাটা দিনের বেলা সবার সামনে ঘটেছে, যার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। কিন্তু ঘটনাস্থলে একজন নারীর উপস্থিতি দেখেই আমার মনের গহীনে একটা কু ডাক ডাকছিল, নিশ্চয়ই কেউ না কেউ মিন্নিকে দোষী বানানোর চেষ্টা করবে।  সে আশঙ্কার কথা লিখিনি ভয়ে, পাগলকে সাঁকো নাড়াতে বলি কীভাবে? কিন্তু সাঁকো নাড়ার কথা পাগল কখনো ভোলে না। কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয় না। রিফাত হত্যার প্রতিবাদে দেশজুড়ে ঝড় উঠলেও কিছু মানুষ প্রথম সুযোগেই আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির চরিত্রহননে লেগে যায়। মানুষের মত দেখতে অনেকগুলো প্রাণীর সামনে একমাত্র সাহসী মানুষ মিন্নির চরিত্র হননে লেগে যাই আমরা, যাদের প্রতিবাদ করার মুরোদ নেই। মজাটা হলো, একজন পুরুষের জন্য খুব বেশি

কার্যকর গালি নেই অভিধানে। কিন্তু নারীর জন্য অসংখ্য। সবচেয়ে নিরীহ গালি ‘চরিত্রহীন’ বলেই কাবু করে দেয়া যায়  নারীকে। মিন্নিকে কাবু করার জন্য এই কৌশলটিই বেছে নিয়েছে একটি মহল। চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তো আছেই, তার

বিরুদ্ধে আনা হয়েছে পরকীয়ার অভিযোগ। একজন নারীকে কাবু করার জন্য অব্যর্থ অস্ত্র। খুনী নয়ন বন্ড তো পলাতক। তাহলে কারা তার হয়ে এই লড়াই করছে? প্রথমে ফিসফাস, তারপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, তারপর গণমাধ্যমেও আসছে নানা খবর। খুনী নয়নের সাথে নাকি মিন্নির বিয়ে হয়েছিল। প্রমাণ হিসেবে বিয়ের কাবিননামা, নয়নের সাথে তার ছবিও ছড়িয়ে দেয়া হয়। তবে মিন্নি দাবি করেছেন, নয়ন তাকে বিরক্ত করতো। বিষয়টি পরিবারকে জানানোর পর মাস দুয়েক আগে রিফাতের সাথে তার বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের পরও নয়ন তাকে বিরক্ত করতে থাকে। ফেসবুকে নানা বাজে পোস্ট দেয়। তাকে হুমকি দেয়। এ কারণেই স্বামী রিফাত প্রতিদিন তাকে কলেজে দিয়ে আসতো, নিয়ে আসতো। কিন্তু বখাটেদের হাত থেকে স্ত্রীকে রক্ষায় জীবন দিতে হলো তাকে। নয়নের সাথে বিয়ে এবং তালাক প্রসঙ্গে মিন্নি বলেছেন, তার শুধু রিফাতের সাথেই বিয়ে হয়েছে, অন্য কারো সাথে নয়। তাই তালাকের প্রশ্নই আসে না। নয়ন প্রসঙ্গে মিন্নি বলেছেন, নয়ন একবার জোর করে অস্ত্রের মুখে তার কাছ থেকে সই নিয়েছিলেন। জোর করে নেয়া সই দিয়ে কাবিননামা বানানো হতে পারে। বা এমনিতেও একটা কাবিননামা বানানো বাংলাদেশে কোনো ঘটনাই না। তারপরও আমি কুৎসা রটনাকারীদের কথাই বিশ্বাস করলাম- নয়নের সাথেই মিন্নির বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু একবার বিয়ে হওয়া মানেই তো সারাজীবন

থাকার গ্যারান্টি নয়। বিয়ে যেমন বৈধ, তালাকও তো বৈধ। যে দিনে-দুপুরে মানুষ খুন করে ফেলতে পারে, তেমন একজন মানুষের সাথে আরেকজন মানুষ থাকবে কেন? সে তো সেই অমানুষকে ছেড়ে একজন সাধারণ মানুষের সাথে সংসার গড়তেই পারে। এটা তো কোনো অপরাধ নয়। রিফাত তো নয়নের স্ত্রী মিন্নিকে তুলে নিয়ে বিয়ে করেনি। রিফাতের সাথে তো মিন্নির স্বাভাবিকভাবে বিয়ে হয়েছে। তাহলে এখানে রিফাতের অপরাধ কোথায়? নয়নের যদি রাগ থাকতোই, সেটা তো মিন্নির ওপর থাকার কথা, রিফাতের ওপর নয়। মিন্নিকে এমনভাবে চিত্রিত করা হচ্ছে, যেন নয়ন একজন খুব ভালো ছেলে। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বা স্ত্রীকে হারিয়ে সে রাগের মাথায় রিফাতকে কুপিয়েছে। নয়নের জন্য অনেকের মায়াকান্নার শেষ নেই।

ভাইয়েরা, মিন্নিকে যত খারাপই বলুন, এমনকি তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ সত্যি হলেও নয়নের অপরাধ কিন্তু একটুও কমে না। আগে নয়নের ফাঁসি নিশ্চিত হোক, তারপর না হয় মিন্নির সতিত্ব পরীক্ষার আয়োজন করা যাবে। নয়নকে যারা ব্যর্থ প্রেমিক বা প্রতারক স্বামী হিসেবে বিবেচনা করছেন; তারা কি জানেন না নয়ন একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী। একাধিকবার পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছিল। তার মানে নয়ন জাত সন্ত্রাসী, ধোয়া তুলসি পাতা নয়, ব্যর্থ প্রেমিক তো নয়ই।

কোনো একটি ঘটনায় নারীদের ঘাড়ে দায় দেয়া, তাদের চরিত্রের দোষ খুঁজে বেড়ানো, নারী এমন পোশাক পরলো কেন? এভাবে তাকালো কেন? কথা দিয়েও রাখলো না কেন? বিয়ে করে সারাজীবন থাকলো না কেন?- ত্যানা প্যাঁচানোর কোনো শেষ নেই। দিনাজপুরের ইয়াসমিন থেকে ফেনীর নুসরাত- চরিত্র হননের চেষ্টা কারো কম হয়নি। এটা আসলে অপরাধীকে আড়াল করার চেষ্টা। পুরুষ ১০টা প্রেম করলেও অপরাধ নেই, নারী দুইজনের সাথে কথা বললেই নষ্টা, চরিত্রহীন। আরে ভাই, আগে বলুন, নয়ন খুন করেছে, তার বিচার হোক, শাস্তি হোক। মিন্নিকে অনেক গালাগাল করতে পারেন, কিন্তু সে তো কোনো অপরাধ করেনি। সেই বিচারকের মত আমাদের অনেকেই নারীদের ঘাড়ে সব দোষ চাপাতে পারলেই খুশি হন। আচ্ছা, শুরুতে যে বিচারকের গল্প বলছিলাম, সেখানে যে নারীকে প্লেট ভাঙ্গার জন্য দায়ী করা হচ্ছে, তার অপরাধটা কী? তিনি তো তার বাসার ছাদে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি তো ডেকোরেটর কর্মচারীর কথা জানেনই না। এখন কোনো সুন্দরী নারী ছাদে উঠলে বা বারান্দায় দাঁড়ালেই যদি পুরুষ হোঁচট খায়; তাহলে তো শিগগিরই ঢাকার অধিকাংশ পুরুষ হাত-পা ভেঙ্গে ঘরে বসে থাকবে। সব ঘটনায় নারীদের দায় না দিয়ে নিজেদের দৃষ্টি বদলান, দৃষ্টিভঙ্গি বদলান; তাহলেই আপনি হোঁচট খাবেন না। মিন্নির দোষ খোঁজার আগে নয়নের ফাঁসি নিশ্চিত করুন। অপরাধীকে আড়াল করার চেষ্টা করাও কিন্তু অপরাধ।

লেখক : বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ জুন ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়