ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

অভিশংসন মানেই কি ট্রাম্পকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়া?

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২৪, ২১ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অভিশংসন মানেই কি ট্রাম্পকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়া?

নানা বিতর্কের জন্ম দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিশংসিত হতে যাচ্ছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৪০ বছরের ইতিহাসে  তৃতীয়বারের মতো কোনো প্রেসিডেন্ট এই অসম্মানজনক অবস্থার মধ্য পড়েছেন। ট্রাম্পের এবারের সংকট শুরু হয় জুলাই থেকে।

২৫ জুলাই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেনেস্কিকে ফোন করে ডেমোক্রেটিক প্রতিনিধি জো বাইডেনের ছেলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে তদন্ত করার জন্য চাপ দেন ট্রাম্প। বাইডেনের ছেলে একসময় ইউক্রেনে ব্যবসা করতেন। তদন্ত শুরু না করলে ইউক্রেনের সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দেয়ারও হুমকি দেন তিনি। টোপ হিসেবে জেলেনস্কিকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানানোর কথাও বলা হয়। পরের মাসে বিষয়টি ফাঁস হয়ে যায়। এর পর থেকেই এ নিয়ে তদন্ত শুরু হয়। প্রথমে হাউসের গোয়েন্দা কমিটিতে তদন্ত চলে। পরে বিচার বিভাগীয় কমিটিতে। এই তদন্তের সব পর্যায়েই অসহযোগিতা করেছেন ট্রাম্প। হোয়াইট হাউসের কোন কর্মকর্তাকে তিনি তদন্তে অংশ নিতে দেননি।

ইমপিচমেন্ট বা অভিশংসন বিষয়টি কী? যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস যেখানে আইন তৈরি করা হয়, তারা দেশটির প্রেসিডেন্টসহ শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে আছে, বেশ কিছু অপরাধের জন্য প্রেসিডেন্টকেও তার পদ থেকে সরিয়ে দেয়া অর্থাৎ তাকে অভিশংসিত করা যেতে পারে। এসব অপরাধের মধ্যে রয়েছে- রাষ্ট্রদ্রোহিতা, ঘুষ নেয়া অথবা অন্য কোন বড় ধরনের কিংবা লঘু অপরাধ। ইমপিচমেন্টের প্রক্রিয়া শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে বা হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভস থেকে। এটি মার্কিন কংগ্রেসের একটি অংশ। প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য সেখানে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাস হতে হয়। পাস হলে পরের ধাপে বিচার অনুষ্ঠিত হয় সিনেটে, যেটি কংগ্রেসের দ্বিতীয় অংশ। এটি অনেকটা আদালত কক্ষের মতো, যেখানে সিনেটররা বিচারক বা জুরি হিসেবে কাজ করেন। তারাই সিদ্ধান্ত নেন প্রেসিডেন্টকে দোষী বা নির্দোষ ঘোষণা করা হবে কিনা। প্রেসিডেন্টকে তার পদ থেকে সরিয়ে দিতে হলে দুই-তৃতীয়াংশ সিনেটরকে ইমপিচমেন্টের পক্ষে ভোট দিতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ট্রাম্প হলেন অভিশংসিত হওয়া তৃতীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এর আগে অ্যান্ড্রো জনসন ও বিল ক্লিনটন এমন ভোটের মুখোমুখি হয়েছিলেন। অভিশংসিত হওয়ার ফলে এখন ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে উচ্চকক্ষ সিনেটে বিষয়টি উঠবে, তবে সিনেট যেহেতু রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত তাই সেখানে এটি পাস হবার সম্ভাবনা প্রায় নেই। তার বিরুদ্ধে দুটি অভিযোগের ক্ষেত্রেই অভিশংসনের জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক ভোট পড়েছে প্রতিনিধি পরিষদে। প্রথম অভিযোগের ক্ষেত্রে ২৩০ ভোট পড়েছে অভিশংসনের পক্ষে এবং ১৯৭টি পড়েছে বিপক্ষে। দ্বিতীয় অভিযোগের ক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয় ২১৬ ভোটের বেশি সংখ্যক ভোট পড়েছে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে। ট্রাম্পের অভিশংসন নিয়ে প্রতিনিধি পরিষদে ভোট শুরু হয় স্থানীয় সময় ১৮ ডিসেম্বর। প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫ জন সদস্য একে একে অভিমত ব্যক্ত করা শুরু করেন। এর মধ্যে বর্তমানে ডেমোক্র্যাটদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ২৩২টি আসন। দুটি স্বতন্ত্র আসনের ভোটও যায় তাদের দিকে। আর রিপাবলিকানদের সংখ্যা ১৯৭টি। ফলে সেখানে পাস হয়ে যাবে। গোল বাধবে উচ্চকক্ষ সিনেটে। সেখানে রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ১০০ আসনের মধ্যে সিনেটে রিপাবলিকানদের দখলে রয়েছে ৫৩টি আসন।

এদিকে শুরু থেকেই নিজেকে নির্দোষ দাবি করে আসছেন ট্রাম্প। তিনি কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসন ভোটকে ডেমোক্র্যাটদের ‘ক্যুর উদ্যোগ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিকে চিঠি পাঠিয়ে ট্রাম্প অভিযোগ করেছেন ডেমোক্র্যাটরা আমেরিকার গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তবে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হবে কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের চেয়ারের অনুমোদন দেয়ার পর। প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ও ডেমোক্র্যাট নেত্রী ন্যান্সি পেলোসি অবশ্য অভিশংসন প্রস্তাবের বিতর্ক শুরুর ভাষণে বলেন, ‘শত শত বছর ধরে দেশের মানুষ গণতন্ত্রের জন্য লড়ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রজাতন্ত্রের দর্শন আজ হোয়াইট হাউসের কর্মকাণ্ডকে হুমকির মুখে ফেলেছে। প্রেসিডেন্টের দায়িত্বহীন আচরণ আজ অভিশংসনকে জরুরী করে তুলেছে। আমাদের সামনে অন্য সুযোগ নেই।’ তার মানে ট্রাম্পকে অভিশংসনের মুখোমুখি হতে হচ্ছেই।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএনএন’র বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের গ্রহণযোগ্যতা কিংবা জনপ্রিয়তা এখন নির্ভর করছে তিন বিচারকের ওপর। সেগুলো হচ্ছে সিনেট, ২০২০ সালের ভোটার এবং যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ওই প্রজন্ম যারা এখনো ভূমিষ্ঠ হয়নি। প্রথমটি ট্রাম্পের নিজ দলের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দ্বিতীয়টির ওপর নিয়ন্ত্রণ কতটুকু সে পরীক্ষা এখনও বাকি। আর তৃতীয় ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলার সক্ষমতা নেই বললেই চলে। সিএনএন’র বিশ্লেষণ আরও বলছে ট্রাম্পের আমলে যতই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটুক না কেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বেকায়দায় ফেলতে তাঁর ক্ষমতা অপব্যবহারের এই বদনাম মার্কিন প্রেসিডেন্টের উত্তরসূরীদেরও বইতে হবে। আগামী পাঁচ বছর মার্কিন রাজনীতিতে যাই ঘটুক না কেন, ট্রাম্পের নাম লেখা থাকবে অভিশংসিত হওয়া অ্যন্ড্রু জনসন ও বিল ক্লিনটনের নামের পাশ। বিশেষ করে ট্রাম্পের মতো বিতর্কিত ও বহুল আলোচিত প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক জীবনে অভিশংসনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে থেকে যাবে। তবে এ বদনাম থেকে নিজেকে নির্দোষ সাব্যস্ত করার একটা সুযোগ ট্রাম্পের সামনে রয়েছে। সেটি ২০২০ সালের নির্বাচন। সেই নির্বাচনে জিততে পারলে অভিশংসনের বদনাম অনেকটাই কেটে যাবে। আবার এমনও হতে পারে যে ২০২০ সালের নির্বাচনে অভিশংসনের কোন প্রভাবই ফেলবে না। বিশেষ করে সেই ভোটারদের কাছে যারা এ রকম খামখেয়ালীপনা আচরণের জন্যই মূলত ট্রাম্পকে পছন্দ করেন কিংবা ঘৃণা করেন।

১৯৬৫ সালে আততায়ীর হাতে প্রাণ হারান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন। সে সময় ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে থাকা অ্যন্ড্রু জনসনের ওপর প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব অর্পিত হয়। তখন দক্ষিণে বর্ণবাদী সন্ত্রাস ব্যাপকমাত্রায় বৃদ্ধি পায়। বর্ণবাদ নিরসনে নতুন প্রেসিডেন্টের ওপর জোরালো চাপ তৈরি হলেও জনসন তাতে সায় দেননি। তিনি নিজেও শেতাঙ্গবাদী শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী ছিলেন, তবে বিচ্ছিন্নতাবাদী ছিলেন না। ক্ষমতায় থাকাকালে জনসন নাগরিক অধিকার আইনের বিরোধিতা করে যেমন বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন, তেমনি শত শত কনফেডারেট নেতাকে কারামুক্তি দিয়ে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টাও সমালোচনার মুখে পড়ে। এক পর্যায়ে তৎকালীন যুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বর্ণবাদবিরোধী এডউইন স্ট্যনটনকে সরিয়ে দেয়ায় জনসনের বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রতিনিধি পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে তা পাস হলেও সিনেটে এক ভোটের ব্যবধানে অভিশংসন থেকে রক্ষা পান অ্যান্ড্রু জনসন।

১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসিত হন বিল ক্লিনটন। তিনি হোয়াইট হাউসের শিক্ষানবিশ মনিকা লিউনস্কির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। শুরুতে মনিকার সঙ্গে সম্পর্কের কথা একবাক্যে অস্বীকার করেন ক্লিনটন। তবে ক্লিনটনের সম্পর্ক নিয়ে প্রমাণাদি হাজির করেন স্বাধীন কাউন্সেল কেনেথ স্টার। এরপরই মিথ্যা বক্তব্য ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ তুলে ক্লিনটনের বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু করে প্রতিনিধি পরিষদ। সেখানে এই ডেমোক্র্যাট নেতা অভিশংসিত হওয়ার পর সিনেটে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপাবলিকান। ফলে এ যাত্রায় সহজেই পার পেয়ে যান ক্লিনটন। ১৯৭২ সালের নভেম্বরে বড় ধরনের ব্যবধানে প্রেসিডেন্ট পুননির্বাচিত হন রিচার্ড নিক্সন। এর পাঁচ মাস আগে ওয়াশিংটনের ওয়াটারগেট হোটেল কমপ্লেক্সে বিরোধী ডেমোক্র্যট দলের সদর দপ্তরে আড়ি পাতার যন্ত্র বসায় নিক্সনের লোকজন। বিরোধীদের নির্বাচনী কৌশল জানতে টেলিফোনে আড়ি পাতার এ অভিযোগের তদন্ত শুরু হয় ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে। নিশ্চিত অভিশংসনে থাকা নিক্সন তখন বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেন।

এভাবে দেখা যায় পূর্ববর্তী দুই প্রেসিডেন্টই সিনেটে গিয়ে রক্ষা পান। তবে, ট্রাম্পের এই অভিশংসন প্রক্রিয়ার ছাপ পুরো দেশের ওপরই পড়বে। জাতি ইতিমধ্যে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে  পড়েছে। সিএনএন পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, অভিশংসন চান ৪৬ শতাংশ ভোটার। চান না ৪৯ শতাংশ। ডেমোক্র্যাট পার্টি মনে করে সিনেটে আটকে গেলেও অভিশংসন নিয়ে যে আলোচনা-বিশ্লেষণ চলছে তা আগামী বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাদের সুবিধা দেবে। আর রিপাবলিকানদের ধারণা, ডেমোক্র্যাটদের এই চেষ্টা বুমেরাং হয়ে  ফেরত আসবে। সিনেটে জয়ের পর আগমী নির্বাচনেও ভোটাররা রিপাবলিকান পার্টির পক্ষেই রায় দিবেন। ট্রাম্প এখন চাচ্ছেন, মার্কিন ভোটাররা এটি ভাবুক যে, অভিশংসন কোন ব্যাপার নয়। যদিও অভিশংসনের এই দাগ ট্রাম্পের সঙ্গে আজীবন থেকে যাবে। বাস্তবতা হচ্ছে, পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে অভিশংসিত হলেও ট্রাম্পকে ক্ষমতাচ্যুত হতে হবে না। কারণ এরই মধ্যে সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপাবলিকান দলের নেতা মিচ ম্যাককনেল আশ্বস্ত করেছেন, সিনেটের ভোটাভুটি ট্রাম্পকে ক্ষমতা থেকে সরানোর পক্ষে যাবে না।

ট্রাম্পও বিষয়টি জানেন। এ কারণে অভিশংসিত হওয়ার সময়টিতেও এক নির্বাচনী সমাবেশে তিনি ইঙ্গিত দেন, এর প্রতিশোধ তিনি ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নেবেন। ট্রাম্পকে ক্ষমতা থেকে অপসারিত করতে হলে দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৬৭ সিনেটরের সমর্থন দরকার। প্রতিনিধি পরিষদে সব ডেমোক্র্যাট সদস্য অভিশংসনের বিপক্ষে ভোট দেয়ায় অনুমান করা হচ্ছে যে, সিনেটে সব রিপাবলিকান প্রতিনিধি ভোট দেবেন ট্রাম্পের পক্ষে। তাতে ক্ষমতায় টিকে যেতে পারেন তিনি। সুতরাং অভিশংসন মানেই প্রেসিডেন্টকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেয়া নয়।

লেখক: ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়