ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধুই, তাঁর বিকল্প শুধু তিনি

মো. ফজলে রাব্বী মিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪৪, ৯ মার্চ ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধুই, তাঁর বিকল্প শুধু তিনি

বঙ্গবন্ধুকে দূর থেকে অনেক আগেই দেখেছি। কিন্তু পাশে থেকে কখনও দেখার সুযোগ পাইনি। কিন্তু ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পর বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হয়ে সে সময় উত্তরবাংলা সফরে যান। আমি তখন গাইবান্ধা বার (আইনজীবীদের সংগঠন)-এর অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি। তাঁকে (বঙ্গবন্ধুকে) বগুড়া থেকে গাইবান্ধা আনতে হবে। গাইবান্ধা মহুকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সেক্রেটারি বললেন- তুমি যাও।

বাংলাদেশের প্রথম স্পিকার শাহ আব্দুল হামিদের একটা আধাভাঙ্গা জিপ নিয়ে আমি বগুড়ার দিকে রওনা হলাম। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ফেরার পথে গাইবান্ধা ও বগুড়ার মাঝামাঝি কমরপুর নামে এক জায়গায় বঙ্গবন্ধুর গাড়ি হঠাৎ থেমে যায়। কিছু বুঝতে না পেরে আমি গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নামলাম।

তিনি আমাকে বললেন, তুই যা। আমি এখানে আইজার বিএসসির বাড়িতে যায়া চারটা ভাত খায়া আসতেছি। এই কথা শোনার পর বঙ্গবন্ধুকে বললাম, স্যার একা গেলে তো আমার খবর হয়ে যাবে নে! তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, তুই কিসের পলিটিক্স করবি রে! তুই গিয়ে বলবি, বঙ্গবন্ধুর গাড়ির চাকা পাংচার হয়ে গেছে, আসতে ঘণ্টাখানেক লাগবে। মাথায় একটা বুদ্ধি খাটায়া বলে দিবি। আমি তো আসছি, না হয় এক ঘণ্টা দেরি হবে এই তো... যা।

বুঝুন বঙ্গবন্ধু কত বড় মহান নেতা ছিলেন। পথে নেমেই আইজার বিএসসির বাড়িতে ভাত খেতে চলে গেলেন। সেদিন বঙ্গবন্ধু যখন গাইবান্ধা এলেন আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না। আমি নিজ হাতে তালপাখা দিয়ে বাতাস করেছি। বঙ্গবন্ধুকে তালপাখা দিয়ে বাতাস করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সে সময় বঙ্গবন্ধুর মুখে একান্ত অনেক কথাই শুনেছি, যার কিছু কিছু ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে রয়েছে।

১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আমি আমার এলাকা গাইবান্ধা-৬ আসন থেকে নমিনেশন চেয়েছিলাম। এরপর গণভবনে (এখন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন) ইন্টারভিউ বোর্ডে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু বললেন, এই তুই কেন আসছিস? তোর ফুলছড়ি ঘাটের খবর কী? তোর লাল বাহিনীর খবর কী? আমি বললাম, স্যার আমি নমিনেশন চাই। বঙ্গবন্ধু বললেন, তোকে তো নমিনেশন দেব না, তুই যা। বললেন, এবার মফিজার ভাইকে দেব। তোকে দেব না, যা। আমি বললাম, স্যার ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তো আমি তার জন্য কাঁধে মাইক নিয়ে নিয়ে কাজ করেছি। এবার আমাকে দেন। বললেন, বলছি তো তোকে দেব না, তুই যা।  তোকে সামনের বার দেব। তখন ক্যাপ্টেন মনসুর বঙ্গবন্ধুকে বললেন, নেতা ও কিন্তু জ্বলন্ত অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমাকে মুক্ত এলাকা দিয়ে ঘুড়িয়েছে এবং জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছে।  বঙ্গবন্ধু তখন বললেন, বললাম তো তোকে সামনের বার দেব। এরপর আমি আর কোন কথা বলি নাই। শুধু বললাম, বঙ্গবন্ধু আপনি যা বলবেন তাই হবে।

লাল বাহিনীর খবর জানতে চেয়েছিলেন এজন্য, আমি তখন বাংলাদেশ রেলওয়ে শ্রমিক লীগ তিস্তামুখঘাট শাখার সভাপতি। ফুলছুড়ি ঘাট, বাহাদুরবাদ ঘাট, সিরাজগঞ্জ ঘাট, জগন্নাথগঞ্জ ঘাট- এই চারটি ঘাট মিলে একটা ইউনিট। ওই ইউনিটের আমি নির্বাচিত সভাপতি ছিলাম। তখন কুলি থাকতো লাল পোশাক পরে। কুলিদের সাথে লড়াই করার সাহস কেউ পেত না। এজন্যই বঙ্গবন্ধু লাল বাহিনীর কথা জানতে চেয়েছিলেন।

এরপর ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে বৃহত্তর রংপুর জেলায় গাইবান্ধার সব নেতা এমপি হলেন। এমপি হওয়ার পর গণভবনে সাক্ষাত করতে আমাদের সব এমপিরা গেলেন। তখন আমি একমাত্র ব্যক্তি এমপি না। তারপরও আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যান সবাই। আমরা গণভবনে বসে আছি। বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় তলায় থাকতেন, সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসার সময় আমাদের দেখলেন। বললেন, তোফায়েল সব বাহের দেশের মানুষেরা আসছে। আমার মেয়ের বিয়ে দিছি, বোনের বিয়ে দিছি, ফুফুকে বিয়ে দিছি, এদেরকে তুমি ভালো করে চা নাস্তা খাওয়াও।

এরপর বঙ্গবন্ধু বললেন, বলো, তোমরা আসছো কেন? তখন আর কেউ কথা বলে না। আমি বসেছিলাম বঙ্গবন্ধুর একেবারে পাশেই। বঙ্গবন্ধু আমার দিকে ফিরে বললেন, কিরে! কেউ তো কিছু কয় না। আমি বললাম, বঙ্গবন্ধু তারা ভয়ে আছেন, কখন আপনি কী কন। পরে বঙ্গবন্ধু বললেন, তাহলে তুই বল। আমি বললাম, বঙ্গবন্ধু আপনার মনে আছে আপনি ইসলামী স্কুলের মাঠে বলেছিলেন- আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায় আসে গাইবান্ধায় একটা জুট মিল করে দেব। বঙ্গবন্ধু অনেকটা রেগে গড়গড়িয়ে বললেন, হ্যাঁ বলেছি, কিন্তু আমি গাইবান্ধায় জুট মিল দেব না। তখন সবাই ধরল- কেন?

পরে বঙ্গবন্ধু বললেন, শোন, আমি হেলিকপ্টারে চড়ে নদীর পাড় দিয়ে তোদের এলাকায় ঘুরেছি, আমি মাইনক্যার চরেও গেছি। আমি দেখেছি, তোমরা গাইবান্ধার লোকেরা মাথায় করে, গরুর গাড়িতে করে পাট ভারতে পাচার করছো। পাচার বন্ধ না করলে আমি জুট মিল দেব না। এই কথা বলার পর সবাই একদম চুপ!

এরপর বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি হেলিকপ্টারে ঘুরেছি শুধু তাই না, আমি ওখান থেকে এসেই তেজগাঁও অফিসে গিয়ে মিসেস গান্ধীকে ফোন করেছি। বলেছি, মিসেস গান্ধী ১৯৭১ সালে আপনি আপনার দল ও ভারতবাসী যে সহযোগিতা করেছেন তা আমার  দেশের জনগণ আজীবন স্মরণ করবে। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন স্মরণ করবে। কিন্তু তার মানে এই না যে, আমার দেশের পাট পাচার হয়ে আপনার দেশে যাবে, আর আপনি সেটা বরদাশত করবেন।

মিসেস গান্ধীকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আপনার মানক্যার চরে এত গুদাম ক্যান? আপনার আসামে কয় টন পাট উৎপাদন হয়?

লেখক: ডেপুটি স্পিকার, জাতীয় সংসদ


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়