ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

প্যানডেমিক, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও পরবর্তী পৃথিবী

ফকির ইলিয়াস || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:০৫, ১ মে ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্যানডেমিক, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও পরবর্তী পৃথিবী

চীনকে কঠিন শাস্তি দেবার কথা ভাবছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প! সে শাস্তি হবে খুব দীর্ঘমেয়াদী! কী হতে পারে সেই শাস্তি? কেন এই শাস্তি? চীন কি করোনাভাইরাসের জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছে? চীনকে কি দোষী প্রমাণিত করা গেছে? এমন অনেক প্রশ্ন এখন মার্কিনী রাজনীতিকদের টেবিলে। আসছে নভেম্বরে মার্কিনমুলুকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে বর্তমান ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান পার্টির এই বৈঠক বেশ ভাবিয়ে তুলেছে মার্কিনী সমাজবিজ্ঞানীদের।

এদিকে করোনা সংক্রমণে যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে মৃতের সংখ্যা ৬৩ হাজার অতিক্রম করেছে। মৃতের সংখ্যা কমছে, কিন্তু থামছে না। এই কঠিন সময়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন যা ইচ্ছে তাই বলে যাচ্ছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নীতি নির্ধারকরা আপাতত চীনের বিরুদ্ধে সেংশন জারী করা,বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করা, চীনকে ঘায়েল করা যায় এমন বিশ্ববাণিজ্যের পথ উন্মুক্ত করা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ভাবছেন।

আমেরিকার সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, নিজেদের অর্থনীতির ভীত শক্ত করে দাঁড়ানোর কঠিন পরীক্ষা। কিন্তু এর পাশাপাশি চীনকে ‘শিক্ষা’ দেওয়ার কথাটিও প্রধান বিবেচনায় রাখছে ট্রাম্প প্রশাসন।

মার্কিন গোয়েন্দারা চেষ্টা করেই যাচ্ছেন এই করোনাভাইরাসটি চীনের উহান ল্যাব থেকে এসেছে প্রমাণ করতে। যদিও এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ারম্যান অব দ্যা জয়েন্ট চীফ অব স্টাফস জেনারেল মার্ক মিলে বলেছিলেন, এই ভাইরাস ‘ন্যাচারাল অরিজিন’ থেকে এসেছে বলেই প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে!

কিন্তু এটাই যে শেষ কথা ছিল না, তা ট্রাম্প প্রশাসনের চলতি মুভমেন্ট দেখে দিনে দিনে স্পষ্ট হচ্ছে। গত সপ্তাহে মার্কিনী সেক্রেটারি অব স্টেট মি. মাইক পম্পেও বেশ জোর দিয়েই বলেছেন, ‘আমি খুব দৃঢ় বিশ্বাস নিয়েই বলতে পারি চীনের কম্যুনিস্ট পার্টিকে এজন্য কঠিন মূল্য পরিশোধ করতে হবে।’

এদিকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে ভুল তথ্য দেওয়ার অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য বিশ্বের সকল দেশের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ তুলেছে চীনের বিরুদ্ধে। যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের পক্ষ থেকে এই মামলাটি করা হয়েছে। রাজ্যের অ্যাটোর্নি জেনারেল এরিক শ্মিট বলেছেন, ‘চীনা সরকার বিশ্বের কাছে মিথ্যা বলেছে। এই ভাইরাসের বিপদ ও সংক্রমণ সম্পর্কে সঠিক তথ্য দেয়নি। যারা সতর্ক করার ছিল তাদের মুখে কুলুপ এটে দিয়েছে। এই রোগটি থামাতে তারা সাহায্য করেনি।’ মিসৌরি রাজ্য কর্তৃপক্ষ বলছে, এটা ঐতিহাসিক একটি আইনি পদক্ষেপ।

আমাদের মনে আছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে করোনা মোকাবিলায় চীনের প্রশংসা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এর সূত্র ধরেই শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর টম জিন্সবার্গ বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র সরকার অনেক ভুল করেছে। এখন তারা চীনের দিকে আঙুল তুলে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করছে।’ মামলা নিয়ে আপাতত চীনকে খব বেশি ভাবতে হচ্ছে না। কারণ  যুক্তরাষ্ট্রের আদালতগুলোতে আইন অনুযায়ী বিদেশি কোনো সরকার সুরক্ষিত। চীনের বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে আন্তর্জাতিক আদলতেই মামলা করতে হবে। আর যুক্তরাষ্ট্র বলছে, আমরা মামলার প্রাথমিক ধাপে আছি। ক্রমশ সব কিছুই করা হবে!

চীনে ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা’র কসরত আমেরিকা যে আগে করেনি তা কিন্তু নয়। আমরা স্মরণে নিতে পারি, ১৯৮৯ সালে বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে বিশাল এক বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। যা দমন করতে সক্ষম হয়েছিল চীনের ক্ষমতাসীন কম্যুনিস্ট পার্টি। আশির দশকের মাঝামাঝিতে ছাত্রদের নেতৃত্বে বিক্ষোভটি শুরু হয়েছিল। এসব ছাত্রের অনেকেই ছিলেন যারা একটা সময় বিদেশে কাটিয়েছেন এবং নতুন চিন্তাভাবনা, উন্নত জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিচিত। এরা একটা পরিবর্তন চেয়েছিলেন। আরো বেশি রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবিতে ১৯৮৯ সালের বসন্তে বিক্ষোভ আরো জোরালো হয়ে উঠছিল। সেটি আরো জোরালো হয় হু ইয়াওবাং নামের একজন রাজনৈতিক নেতার মৃত্যুতে, যিনি কিছু অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের বিষয় দেখভাল করতেন। রাজনৈতিক বিরোধীদের কারণে বিক্ষোভের দুই বছর আগে দলের শীর্ষ পর্যায়ের পদ থেকে তাকে নিচে নামিয়ে দেওয়া হয়।

হু'র শেষকৃত্যানুষ্ঠানে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হন। এপ্রিল মাসের ওই অনুষ্ঠানে তারা জড়ো হয়ে বাকস্বাধীনতা এবং কম সেন্সরশিপের দাবি জানাতে থাকেন। এর পরের কয়েক সপ্তাহে বিক্ষোভকারীরা তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে জড়ো হতে শুরু করে। সেই সংখ্যা একপর্যায়ে দশ লাখে পৌঁছেছিল বলে ধারণা করা হয়। প্রথমদিকে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সরাসরি কোন পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। কীভাবে এক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা নিয়ে মতভিন্নতা ছিল দলের নেতাদের মধ্যে। অনেকে কিছুটা ছাড় দেওয়ার পক্ষে ছিলেন, আবার অনেকে ছিলেন কঠোর পন্থা বেছে নেওয়ার পক্ষে। এই বিতর্কে শেষ পর্যন্ত কট্টরপন্থীদের জয় হয়। ১৯৮৯-এর মে মাসের শেষ দুই সপ্তাহে বেইজিংয়ে মার্শাল ল জারি করা হয়। ৩ ও ৪ জুন তিয়েনআনমেন স্কোয়ারের দিকে এগোতে শুরু করে সৈনিকরা। ওই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য তারা গুলি করে, বাধা ভেঙে এবং বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার করতে শুরু করে।

প্রকৃত সত্য এখনও অজ্ঞাত, সেই বিক্ষোভে আসলে কতজন মারা গিয়েছিলেন। ১৯৮৯ সালে জুনের শেষ নাগাদ, চীনের সরকার জানিয়েছিল যে, বেসামরিক ব্যক্তি এবং নিরাপত্তা কর্মী মিলিয়ে বিক্ষোভে দুইশ জন নিহত হয়েছে। সেই সময়ে বিশ্বের মিডিয়াগুলো বলেছিল, কয়েক হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল সেখানে। ২০১৭ সালে একটি গোপন ব্রিটিশ কূটনৈতিক বার্তা প্রকাশ করা হলে জানা যায়, সে সময় চীনে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার অ্যালান ডোনাল্ড বার্তা পাঠিয়েছিলেন যে, সেখানে ১০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, চীন সব সময়ই সত্য গোপনে পারদর্শী। তাই প্যানডেমিক করোনাভাইরাসে চীনে কতজন মারা গিয়েছে- সেই সংখ্যাটিও যে মিথ্যা হতে পারে, সেই সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে!

এ তো গেল চীনের প্রসঙ্গ। কিন্তু কেমন আছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমেরিকা! মার্কিন মুলুকে এখন যে বিষয়টি প্রকট হয়ে দেখা দিতে পারে তা হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্য। আমেরিকায় একজন চিকিৎসকের আত্মহত্যা ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে মিডিয়ায়। প্রতিদিন লাশের পাহাড় দেখতে দেখতে হতাশায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন ডাঃ লরনা ব্রিন নামের এই চিকিৎসক। তার পরিবার এটাই দাবি করছে। উল্লেখ্য, ওই চিকিৎসক নিজেও করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু সুস্থ হয়ে ফের তিনি যোগ দেন কাজে। নিজেও কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েও ভেঙে পড়েননি তিনি। সুস্থ হয়ে ফের হাত লাগিয়েছিলেন করোনা-যুদ্ধে। তিনি ম্যানহাটানের নিউইয়র্ক-প্রেসবাইটেরিয়ান অ্যালেন হাসপাতালে জরুরি বিভাগের ডিরেক্টর ছিলেন।

পুলিশ বলেছে, ভার্জিনিয়ায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন লরনা। কাজ থেকে ছুটি পেয়ে তিনি ভার্জিনিয়ায় যান নিউইয়র্ক থেকে।

এরপর ৪৯ বছর বয়সী এই চিকিৎসক নিজের শরীরে আঘাত করে আত্মহত্যা করেন। মৃত চিকিৎসকের শোকে মূহ্যমান বাবা বলেছেন, ‘মেয়ের কাজই ওঁকে কেড়ে নিলো।’ তিনি জানান, তাঁর মেয়ের কোনো ধরনের মানসিক অসুস্থতার ইতিহাস ছিল না। আমেরিকায় স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশী তিনজন ডাক্তার মারা গিয়েছেন। নার্স ও ডাক্তাররা হেলথ সেক্টরে কাজ করে যাচ্ছেন বীরত্বের সাথে। এভাবেই ৩০ এপ্রিল আমেরিকায় ফেডারেল লকডাউন উঠে যাওয়ার কথা থাকলেও ৩১ টি অঙ্গরাজ্য মে মাসের ৭ তারিখের মাঝে অংশিক রি-ওপেন করবে বলে বলা হচ্ছে। কিন্তু তা কি ফেডারেল গাইডলাইন মেনে চালু করা যাবে? মুক্তি পেয়ে মানুষেরা বিধি-নিষেধ মানবেন কি? এই প্রশ্নটি উত্থাপিত হচ্ছে মার্কিনমুলুকের মতো ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডেও!

প্রথমিকভাবে আমেরিকার সকল নাগরিককেই করোনাভাইরাস টেস্টের মধ্য দিয়ে যেতে হবে বলেই জানানো হচ্ছে। বিভিন্ন ফার্মেসি চেইনগুলো এই টেস্টের আয়োজন করা শুরু করেছে। হোয়াইট হাউস টাস্ক ফোর্সের সদস্য ডা. এন্থনি ফাউচি বলছেন, আসছে জানুয়ারিতে করোনা ভ্যাকসিন বাজারে আনতে পারবে আমেরিকা। অবশ্য এই সময়ে বিশ্বের ১০২টি প্রতিষ্ঠান ও গবেষণাগার এই ভ্যাকসিন বাজারে আনার জোর চেষ্টা করছে বিশ্বস্বাস্থ্য বিধি মেনে। মার্কিনী বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই প্যানডেমিক বিষাদ বিশ্বকে কাতর রাখবে ২০২২ পর্যন্ত! মানুষ মানুষকে সামাজিকভাবে বিশ্বাস করতে পারবে না। রেস্টুরেন্ট, ক্লাব, বার, সিনেমা হল, বড় বড় গ্যাদারিং ইভেন্ট প্রাণ ফিরে পাবে না আরও দেড় বছরের বেশি সময়। তারা আরও বলছে, বিশ্বে খাদ্য সামগ্রীর সংকট দেখা দিতে পারে। মূল্য বেড়ে যেতে পারে। শিক্ষিত বেকারদের মাঝে হতাশা বাড়তে পারে উচ্চহারে।

এমন অবস্থার মধ্য দিয়েই আসছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। রিপাবলিকান পার্টির পক্ষে ডোনাল্ড ট্রাম্প আর ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষে জো বাইডেন লড়বেন। এবসেন্টি ব্যালট, ডাকযোগে ভোট প্রদান ইত্যাদি বিষয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে এরইমাঝে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পই আবার জিতে যাবেন আসছে নির্বাচনে। মার্কিনী বুর্জোয়া শ্রেণীর শিরোমণিরা রিপাবলিকানদেরই পছন্দ করেন বেশি। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ছিলেন মি. রোনাল্ড রিগ্যান। ২০ জানুয়ারি ১৯৮১ ক্ষমতায় আসেন রিগ্যান। ক্ষমতায় ছিলেন ২০ জানুয়ারি ১৯৮৯ পর্যন্ত। তাঁর সময়েই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে খান খান হওয়ার সাইরেন বাজা শুরু হয়। ‘গ্লাসনস্ত আর পরেস্ত্রেইকা’ পেরিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৯১ সালের ২৬শে ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে।

মার্কিন বিশ্লেষকরা বলেন এসব কাজে রিপাবলিকানরাই দক্ষ। স্মরণ রাখা দরকার ১৯৮৯ সালে দুই জার্মানীর মধ্যে থাকা বার্লিন প্রাচীর ভেঙে যাওয়ার পর পূর্ব ইউরোপের বহু দেশে কমিউনিজমেরও পতন ঘটতে থাকে। আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতে এসে ডোনাল্ড ট্রাম্প কি চীনে তেমন কোনো খেলা খেলতে যাবেন- যাতে চীনকেও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাগ্যবরণ করতে হয়! তা এখনই বলা কঠিন। এর আগে ট্রাম্পের সামনে অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জ। তাকে তা মোকাবিলা করেই এগোতে হবে। কারণ তার উপরই নির্ভর করছে গোটা বিশ্বের সমাজ ও অর্থনীতির সূচক ওঠা-নামার ব্যারোমিটার।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়