ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

সাংবাদিকতা ও শেষ পুরোহিত কঙ্কালের পাশা খেলা

অলাত এহ্‌সান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৫১, ৩ মে ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সাংবাদিকতা ও শেষ পুরোহিত কঙ্কালের পাশা খেলা

হায়! ‘বিশ্ব’ কবেই বাদ পড়েছে, ছুটে গেছে ‘গণ’। স্রেফ ‘মাধ্যম’ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রতিষ্ঠানগুলো। বরং প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, কার মাধ্যম? কেন মাধ্যম? এই দ্বন্দ্ব যে খুব পুরোনো, তা কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’র প্রতিবেদন আর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ম্যাজিস্ট্রেসি রিপোর্ট পাশাপাশি পড়লেই বুঝতে পারা যায়।

সংবাদ মাধ্যমগুলো খুব সামান্যই তুলে ধরতে পারে, আড়ালে থেকে যায় সবটা। জলমগ্ন হিমশৈলর উদাহরণ দিয়ে সবটুকু বোঝানো যাবে না। ওই যেমন চোখের সামনে মুষ্ঠি দূরের পাহাড় ঢেকে ফেলে, আঙুল দিয়ে দুই চোখ চেপে ধরলে দুনিয়া অন্ধকার। এখন তো চোখের ওপর থ্রি-ডি স্ক্রিন লাগালে এই দুনিয়ায় থেকেও আরেক দুনিয়ায় চলে যায় মানুষ। হ্যাঁ, এটাই, এই দুনিয়া থেকে আরেক দুনিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যাপার। ইদানিং পত্রিকা দেখলে পাঠকদের তা-ই মনে হয়। চারপাশে যা দেখছি, তার সবই অস্বীকার করা খবর! তাই নেহায়েত খবরের কাগজ পড়ে যারা শিক্ষিত হতে চান, দুনিয়া বুঝতে চান, তারা পড়ে আছেন মহাকালের মহা ফাঁড়ায়।

শুরুতেই যে ‘বিশ্ব’র কথা বলা হলো, তার মানে ‘সামগ্রিক বোধ’। খণ্ডিত খবর পড়ে তা কখনোই পাওয়া যাবে না। সমগ্রকে ধারণ করতে জরুরি মুক্তি। আর মুক্তি ছাড়া গণ হয় কি করে! তা আমরা এনে দেবো কোন সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে? তাই এটা নিতান্তই সংবাদ মাধ্যম। কার সংবাদ, কিসের সংবাদ, কেন সংবাদ— সে তো আরেক মহাকাব্যিক উপখ্যান!

এদিকে শুনি, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হচ্ছে সংবাদমাধ্যম; জাতি পচন এখান থেকেই শুরু হবে। আরেক দিকে শুনি, সংবাদমাধ্যম হচ্ছে যুদ্ধের জন্য মগজের পদাতিক বাহিনী। কোনো দেশ আক্রমণ করার আগে ওই দেশের মানুষের মগজকে টার্গেট করে পরাশক্তিগুলো প্রথমে খবরাস্ত্র ছোড়ে। গণমানুষই যদি রাষ্ট্রের পক্ষে না থাকে, অস্ত্রের লড়াই আর কতক্ষণ চলে? করোনা সংকটে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হওয়ায় তেমন খবরাস্ত্র কম খরচ হচ্ছে কি? আমরা কোন দিকে ঢাল দেই, বলুন।

সংবাদ কোনটা আর কোনটা নয়, তা নিয়ে জার্নালিজমের মাস্টার মশাই প্রথম যে লেকচার দেন, তার প্রথম উদাহরণ হলো— কুকুর মানুষকে কামড়ালে তা খবর নয়, বরং মানুষ কুকুরকে কামড়ালে খবর। একইভাবে ভারতবর্ষের দুর্ভিক্ষ কোনো খবর নয়, ইংল্যান্ডের সংরক্ষিত (পড়া যায়: পরিত্যক্ত) রাজপরিবারে কোনো কুকুর পালতে আনা হচ্ছে খবর। যেমন ডাক্তারদের নিম্নমানের পিপিই কারা দিলো, তার অনুসন্ধানের চেয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাজে কথাই বেশি চাউর হয়। আর এদিকে না খেয়ে মানুষ মরার চেয়ে ধান ক্ষেতে হাতির পাড়া, থুক্কু, এমপির পাড়া বড় খবর! তারা কি শুধু পাকাধানে মই দিলেন, শুনলাম কে যেন কাঁচা ধানে মই (পড়ুন: কেটে) দিয়ে পাকা বলে চালিয়ে দিয়েছেন! এক ছবিতে দেখলাম, এমপি মহোদয় ক্ষেতের এক কোণায় এক গোছা ধান কাটতে না-কাটতে পঙ্গপালের মতো একঝাঁক লোক তার ছবি ধারণ করতে গিয়ে গোটা ক্ষেতের ধানই পাড়িয়ে মারাই করে ছেড়েছেন। সেই ছবিও সংবাদ মাধ্যমে প্রচার হয়! তাহলে ‘গণ’ রইলো কোথায়? তারপরও শুনি কে যেন বংশী হেঁকে গলা ফাটাচ্ছেন, তাদের নাকি সাংবাদমাধ্যম সহযোগিতা করছে না! হায় খোদা, পাতের ভাত তুলে দিয়ে খালি থালা বাজিয়ে বুড়োকালেও যার অন্নপ্রাশন করলাম, সে-ই বলে কিনা এই কথা! তা, এই যারা খালি থালা বাজাল, মানে সাংবাদিকরা, তাদের কী অবস্থা?

শুনলাম, সাংবাদিকরাই আছেন সবচেয়ে বাজে অবস্থায়। ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলির খই ফুটানোর মতো, ছাটাইয়ের যেন খই ফুটছে এই সময়। হঠাৎ বেশি কেন আওয়াজ উঠছে? ব্যাটা যখন মাঝ দরিয়ায় ফুটো নৌকা সেচতেই হয়রান, তখনই তো নৌকার গুলুইয়ে চাপ দিয়ে ডুবিয়ে দেওয়ার মোক্ষম সময়। মার ঠেকাবে কি, প্রাণ বাঁচাতেই কাহিল! ছাত্র বেলা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে একবার শুনেছিলাম, মানুষ খুন করলেই কি? সাংবাদিক সংগঠনের নেতাদের হাতে রাখলেই শেষ, ব্যাপারটা গায়েব হয়ে যাবে। সত্যি তাই নাকি? অবশ্য সাগর-রুনি হত্যা, এখানে-সেখানে সাংবাদিক নিখোঁজের পর তা আর অবিশ্বাস করি কী করে? গায়েব তো হলোই। তা, কোথায় সেই ডাকা-বুকো নেতারা? শুনলাম এই করোনোয় সাংবাদিকরা খুব কষ্টে আছেন।  এই দুনোবর্ষার কথা বাদ দিন, সেই উনোশীতেই সালেই দেখেছিলাম, এক সাংবাদিক বেতন না পাওয়ায় শিশুর দুধের পয়সার জন্য নিউজরুমে হাউমাউ করে কাঁদছেন- এ তো নস্যি! অফিসে সবার সামনে একজন শিক্ষিত বোধসম্পন্ন মানুষ যখন কর্তার অজস্র গালি অপমানের মধ্যেও দম খিঁচে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে, সেই দৃশ্য আরো পীড়াদায়ক; চোখ মেলে দেখা যায় না। অনেক সময় মনে হয়েছে, তখন তিনি কি পোড়া কাগজ, না মরা মানুষ, একবার হাত দিয়ে দেখি।

বিপরীত চিত্র দেখি ডাকা-বুকোদের ক্ষেত্রে। আজকাল কোনো কোনো ক্ষুব্ধ সাংবাদিক ফুট-ফাট নেতাদের একটা-দুইটা কেলেঙ্কারি ফাঁস করে ঘরের কথা পরকে জানিয়ে দিচ্ছেন। বড্ড বেরসিক দেখায়, কিন্তু কি আর করা, পাতলুন জুটে না, আবার পাগড়ির চিন্তা! এতো ঢাকার কীর্তি, মফস্বলের সাংবাদিকদের দিকে যাওয়ার উপায় নেই। ও আমি পারবো না। তারপরও ওই নেতারা প্রেসক্লাব নির্বাচনের সময় কি করে জেলায় জেলায় ঘুরে ভোট চান, ভেবে বুকে থুথু ছিটিয়ে ধুকপুক কমাতে হয়। এর চেয়ে কোনো কোনো সংবাদ সম্মেলন শেষে ঘন হয়ে বসা তাদের প্রশ্নের বিনোদনটুকু উপভোগ করার মতো। সে যাক, দুই চারজন ভালো সাংবাদিক নেতার দিকে তাকিয়ে বাকি কথা না হয় গিলে ফেললাম। উদাহরণ হিসেবে নির্মল সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, সন্তোষ গুপ্ত, ফয়েজ আহমদের মতো বরেণ্যদের এখানে ডেকে নাইবা আনলাম। তারা তো সংবাদপত্রের পুরোহিত জন। কিন্তু এই ‘ঘরে ঘরে পত্রিকা-জনে জনে সম্পাদক’ হওয়ার যুগে ভালো-মন্দ বাছাই করা চাট্টিখানি কথা নয়। কে যেন ‘সবখানে ভালো-মন্দ দুই-ই থাকে’ বলে ব্যাপারটা মিমাংসা করেছিলেন, আমিও তাই মেনে নিলাম। এখনো যে বিচার পাওয়ার আশায় মানুষ প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়ায়, সে-ই এই পেশাকে মর্যাদা দিয়েছে। আগে তো মিডিয়া নেতাদের পেছনে দৌড়াতো, এখন নেতারাই মিডিয়ার পেছনে দৌড়ায়, সে-ই বা কম কি! এতে কে যে কাকে ছোট করছে, তাই-বা আমি বিচার করি কী করে?

এতো গেলো মূলধারার সংবাদমাধ্যমে কথা। তা তো মানুষকে তুষ্ট করতে পারছে না। তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ব্লগ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ক্ষমতার রাজনীতির দুনিয়ায় সাংবাদিকরা যে খুব আদরে থাকবে না, তা ভাবাই যায়। বিকল্প গণমাধ্যম ইউকিলিকস-এর প্রতিষ্ঠাতা অস্ট্রেলিয়ার জুলিয়ান পল এসেঞ্জ বন্দি, মার্কিন আমেরিকার এডওয়ার্ড যোসেফ স্নোডেন দেশান্তরিত এবং পানামা পেপার ফাঁস করা সাংবাদিকদের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়েই তা প্রমাণ হয়। এই তো কিছুদিন আগে, চীনে করোনা শুরুর প্রথমে নিষেধ উপেক্ষা করে উহান প্রদেশের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছিলেন এক সাংবাদিক। তিনি নাকি গুম হয়ে গেছেন। সবচেয়ে বড় উদাহরণ জামাল খাসুগির হত্যাকাণ্ড। প্রবাসে কনসুলেটগুলোকে সবচেয়ে নিরাপদ ও ন্যায়ানুগ প্রতিষ্ঠান মনে করে সবাই। যুদ্ধের সময়ও তা নিরাপদ থাকে। অথচ তুরস্কে সৌদি কনসুলেটের ভেতরই খাসুগিকে হত্যা করে ফরেনসিক ডাক্তারদের দিয়ে পিচ পিচ করে পাঠিয়ে দেয়া হলো বাইরে। শুধু সৌদি নয়, ক্ষমতার প্রয়োজনে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি অস্বাভাবিক নয়। তাহলে রাষ্ট্রের কাছে সাংবাদিকের নিরাপত্তা থাকে কোথায়? রাষ্ট্র যদি তার দায়িত্বপূর্ণ চরিত্র প্রমাণ করতে চান, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সে দায় তার আছে; আন্তর্জাতিক অনেক চুক্তির কারণেই তিনি তা করবেন। তাই বলে সাংবাদিকরা লেজুড় হতে পারেন না।

‘গণ’ শব্দের সঙ্গে ‘মুক্ত’ শব্দের সহ অবস্থান। কিন্তু আইসিটি আইন প্রবর্তনের ফলে সেই মুক্তিটা রইলো কোথায়? কারা যেন প্রবোধ দিয়ে বলেছিল, আইসিটি আইনে সাংবাদিকদের ভয় নেই। এখন তো কথায় কথায় মামলা হচ্ছে সাংবাদিকদের নামে। সেই অভয় দাতারা এখন কোথায়? সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচার তো ছাড়, পুলিশি প্রতিবেদনই পাওয়া গেল না এতো দিনে। তাদের আগেও অনেক সাংবাদিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। বিচার নেই। একজনের হাত-পা বেঁধে সমুদ্রের মাঝে ফেলে দিয়ে বলা হলো, যদি সাঁতরে কূলে ফিরতে পারো, তবেই মুক্তি পাবে। তা কী করে সম্ভব! একে তো তলিয়ে যাওয়া অবস্থা, তার মধ্যে হাঙর এসে খুবলে খায়। প্রতিবেদন প্রকাশ করায় সাংবাদিকরা যে মামলার তলে ডুবছে তাদের কী হবে? নেতার মতো আমিও বলি, ‘আপনারা আসুন, দেখুন, বিচার করুন।’ কিন্তু যথারীতি, আমার কথা তারা শুনবেন কেন?

এবার একটা শপথের কথা বলি। তবুও যদি হুঁশ ফেরে। কথাটা বলেছিলেন আমেরিকান কূটনীতিক, পরবর্তী সময়ে তৃতীয় প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন—

“The basis of our governments being the opinion of the people, the very first object should be to keep that right; and where it left to me to decide whether we should have a government without newspapers or newspapers without a government, I should not hesitate a moment to prefer the latter. But I should mean that every man should receive those papers & be capable of reading them.”

সেটাই তো কথা। পত্রিকার পক্ষে দাঁড়াব তো অবশ্যই, পত্রিকাও গণমানুষের ভাষ্য হয়ে উঠতে হবে। সেই যে শুরুতে বলেছিলাম ‘সামগ্রিক বোধ’, সে তো আর শুধু পত্রিকা থেকে হয় না, অনেক পড়াশোনা, চিন্তা করে তা অর্জন করতে হয়। কিন্তু বাঙালি বড় আবেগী। হোক তিনি সাংবাদিক। এসব কথা শুনবেন কেন? আবেগে তিনি আবৃত্তি করেন—

‘আমি কি রকম ভাবে বেঁচে আছি

তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ, একি মানুষ জন্ম,

নাকি শেষ পুরোহিত কঙ্কালের পাশা খেলা

প্রতি সন্ধ্যা বেলা আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে

হৃদয়কে অবহেলা করে রক্ত’

আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে থাকি

তার ভেতরের কুকুরটা দেখবো বলে

আমি আক্রোশের হেসে উঠি না’

(আমি কি রকমভাবে বেঁচে আছি / সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)

নানা দিকে পত্রিকা বন্ধের খবর। বিশ্বের পরিসংখ্যান নিয়ে হাজির হয় কোনো কোনো প্রতিবেদন। তবু শিক্ষিত কেউ কেউ স্বাগ্রহে এই পেশায় আসছে, সে-ই কথা। যেন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে প্রাণ ফেরানোর চেষ্টা। দখলের দুনিয়ায় এ-ই কেবল জবাবদিহিতার ক্ষেত্র। সাংবাদিকতা সেখানে প্রায় ‘শেষ পুরোহিত কঙ্কালের পাশা খেলা’ ছাড়া আর কী!

লেখক: গল্পকার, প্রাবন্ধিক, একটি দৈনিকে কর্মরত

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ