ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

করোনাকালে থিয়েটারের নতুন পথ ভাবতে হবে

আমিনুর রহমান মুকুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ১৯ মে ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
করোনাকালে থিয়েটারের নতুন পথ ভাবতে হবে

আমরা যারা থিয়েটারকর্মী অথবা থিয়েটারের মানুষ, তারা এই সময়ে অনেক কিছুই করছি। বিশেষ করে, করোনার গৃহবন্দি সময়ে আমাদের হাতে কিছু অবসর এসেছে। আমরা বই পড়তে পারছি, সিনেমা দেখছি, কেউ ঘরের টুকটাক কাজ করছি, গাছগাছালি লাগাচ্ছি, সেসবের পরিচর্যা হচ্ছে, নাটকের নতুন পাণ্ডুলিপি পড়ছি, কেউ পাণ্ডুলিপি লিখছি, আরো অনেক রকমভাবে একটা ফ্রুটফুল সময় পার করছি। কেউ কেউ আবার সোশ্যাল ডিসটেন্স মেনটেন করতে বসে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সোশ্যাল এটাচমেন্ট বাড়াচ্ছি। অনলাইন আড্ডা দিচ্ছি,  টক-শো করছি, ইন্টারভিউ নিচ্ছি, কিছু শো ভিডিও করছি, অনলাইন ক্লাস চালাচ্ছি- সবকিছুই করছি, কিন্তু থিয়েটার করছি না। বলা ভালো, করতে পারছি না।

আমরা কি লক্ষ্য করছি, বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে থিয়েটার বিশাল এক হুমকির মুখে পড়েছে? থিয়েটার থাকবে কি থাকবে না, টিকবে কি টিকবে না, এ নিয়ে কেউ কথা বলছেন না। কিন্তু আমাদের থিয়েটার মহাসংকটের মুখে! এটা অস্বীকার করবার উপায় নেই। কারণ বলা হচ্ছে, করোনা যাবে না, করোনা থাকবে। ইতোমধ্যে ডব্লিউএইচও পরিষ্কার জানিয়েছে করোনাকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের চলতে হবে। আমিও ব্যাক্তিগতভাবে মনে করি, যতদিন না এর কোনো প্রতিষেধক তৈরি হচ্ছে, ততদিন করোনা সঙ্গে নিয়েই আমাদের জীবন চালাতে হবে। কারণ অর্থনীতির চাকা ঘুরছে না, তাকে গতিশীল করতে হবে; এটাই বাস্তবতা। তাই বিশ্বের অনেক দেশেই এখন লকডাউন তুলে দেওয়া হচ্ছে। করোনা সঙ্গে নিয়ে নতুনভাবে বাঁচার চেষ্টা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশেও সীমিত পরিসরে সব কিছু খুলে দেওয়া হয়েছে। ধীরে ধীরে মানুষের জীবনযাত্রা ও অর্থনীতিকে সচল এবং স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি কিছু গুরুত্বপূর্ণ জীবনচর্চার কথা বলা হচ্ছে, যা পালন করলে করোনা সঙ্গে নিয়েই বেঁচে থাকা সম্ভব। সেই সূত্র ধরেই সোশ্যাল ডিসটেন্সিং, মতান্তরে ফিজিক্যাল ডিসটেন্সিংয়ের কথা বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে পারসোনাল প্রোটেকশনের কথা। সঙ্গে সঙ্গে লিভিং স্পেসও নিয়মিত জীবাণুমুক্ত রাখার কথা বলা হচ্ছে। সুতরাং এসব মেনে ব্যবসা-বাণিজ্য বা জীবনযাত্রা চললেও, থিয়েটার চলবে না। কারণ থিয়েটার দলবদ্ধ কাজ, সমন্বিত শিল্প মাধ্যম, এটা জনসমাগমের কথা বলে। একদল জীবন্ত মানুষ নিয়ে আরেকদল জীবন্ত মানুষের সামনে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটানোর কথা বলে। কিন্তু করোনা বলছে উল্টো কথা। বলছে, মানুষের কাছে ঘেঁষ না, দলবদ্ধ হয়ো না। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই থিয়েটার করা এখন সবচেয়ে মুশকিলের বিষয়।

তাহলে কি এতো শক্তিশালী একটি শিল্প মাধ্যম, এতো সহজেই কি মুখ থুবড়ে পড়বে? নিশ্চয়ই না। পৃথিবীজুড়ে এতো এতো মেধাবী থিয়েটারের মানুষ, তারা সহজে হাল ছাড়বেন না- এ জানা কথা। এ নিয়ে অনেকেই হয়তো ভাবনা-চিন্তা শুরু করেছেন, কিন্তু আমাদের থিয়েটারের অবস্থা কি দাঁড়াবে তা নিয়ে কেউ ভাবছেন বলে শুনি না। তাই করোনার এই সময়ে আমাদের দেশের থিয়েটার চর্চার চিত্র কি দাঁড়াবে, সে সম্পর্কে আমার সাম্প্রতিক কিছু ভাবনা এখানে তুলে ধরলাম। আমার প্রিয় নাট্যকর্মী ও বন্ধুগণ এ থেকে হয়তো নতুন কোনো পথ খুঁজে বের করতে সচেষ্ট হবেন।

প্রথমতো আমার মনে হয়, এই সময়ে এসে থিয়েটার আরো ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে। ফল হবে মারাত্মক! অনেকগুলো থিয়েটার দলকে বসে যেতে হবে, তাদের নাট্যচর্চায় পরিণতি টানতে হবে। কীভাবে? আসুন সে হিসেবটা দেখি। এখন থিয়েটার যারা করবেন, তাদের প্রত্যেককে পারসোনাল সেইফটি প্রোটেকশান নিয়ে থিয়েটার করতে হবে। থিয়েটার দেখতে যে দর্শক আসবেন, তাদের পারসোনাল সেইফটি যেমন নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি ফিজিক্যাল ডিসটেন্স মেনটেন করবার সুযোগও রাখতে হবে। অর্থাৎ এখন শিল্পকলার জাতীয় নাট্যশালায় যেখানে ৭০০ দর্শক বসানো যায়, সেখানে বসাতে হবে ২০০-২৫০ দর্শক। দ্বিতীয়ত প্রতি প্রদর্শনীর পূর্বে পুরো মিলনায়তন জীবাণুমুক্ত করাও হবে একটি বড় চ্যালেঞ্জ এবং ব্যয়সাপেক্ষ। একই ব্যয় নাটকের মহড়াকালীনও বাড়বে।

কেউ কেউ হয়তো ভাবছেন, টিকিটের দাম বাড়িয়ে দিলেই হবে। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা তা বলে না। অভিজ্ঞতা বলে, বিনে পয়সায় অনুষ্ঠান দেখতে পাওয়া দর্শক, পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে নাটক দেখা না। সুতরাং এতদিন আমরা থিয়েটারে যা ব্যয় করতাম, তা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এই অবস্থায় কতগুলো থিয়েটার দল, তাদের নিয়মিত চর্চা ধরে রাখতে পারবে, সে সন্দেহ থেকেই যায়।

এ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় যে বিষয়টি আমাকে ভাবাতে শুরু করলো, সেটা স্পেস। স্পেস থিয়েটারের আরেকটি প্রধান শর্ত। আমরা এখন যে স্পেসে থিয়েটার করি, সে স্পেস থেকে আমাদের বেড়িয়ে আসতে হবে। অর্থাৎ শিল্পকলা বা মহিলা সমিতিতে বোধহয় আর থিয়েটার করা যাবে না। একেবারে যাবে না, তাও বলছি না। হয়তো যাবে। তবে মিলনায়তন বা হলগুলোকে আবার করোনা বাস্তবতা মাথায় নিয়ে সাজাতে হবে। মোটকথা এতোদিনের ব্যবহার্য স্পেস বদলাতে হবে। বিকল্প স্পেস তৈরি করতে হবে, সাজাতে হবে। যেখানে দর্শক ফিজিক্যাল ডিসটেন্স মেনটেন করে থিয়েটার উপভোগ করতে পারবেন। এজন্য জাতীয় পর্যায়ে, প্রয়োজনে ব্যক্তিগত পর্যায়ে এখনই  কাজ শুরু করা দরকার বলে আমি মনে করি। তা না হলে আমাদের বহু গৌরবের এই থিয়েটারকে বাঁচিয়ে রাখা মুশকিল হবে।

তৃতীয় যে চিন্তাটি আমার মাথায় ঘুরছে, সেটা দর্শকের থিয়েটার দেখার এক্সপেরিয়েন্স। এখন আমরা যেভাবে, একপাশে দর্শক বসিয়ে আরেকপাশে পারফরমেন্স করি, এতে দর্শকের যে এক্সপেরিয়েন্স হয়, সেখানেও একট বড় পরিবর্তন আনতে হবে। কারণ, করোনা আমাদের নতুন কিছু শিক্ষা দিয়েছে। সেই শিক্ষাগুলোর একটি হলো, ঘরে থাকা। কারণে-অকারণে বাইরে বের হবার ফলে প্রকৃতিতে যে বিপুল বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়, তা এবার আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। সকলে ঘরে থাকার ফলে আমাদের প্রকৃতি আজ নিজস্ব রূপে অপরূপ হয়ে আছে। শহর হয়েছে দূষণমুক্ত। ময়লা-আবর্জনার স্তূপ জমে নেই রাস্তার ওপর। ঘরে থাকার অভ্যাস একটি সুন্দর অভ্যাস, নাগরিক মানুষ তা কিছুটা বুঝেছে। আমরা সকলেই সকলকে ঘরে থাকতে উৎসাহিত করছি। অযথা বাইরে ঘোরাফেরা করতে নিরুৎসাহিত করছি। এটা চালিয়ে যেতে হবে। আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্যে এ এক শুভ আচরণ। আচরণগত এইসব পরিবর্তনে সকলকে উজ্জীবিত করা নাট্যকর্মী হিসেবে আমাদের দায়িত্বও বটে।

সুতরাং যে মানুষটিকে আপনি ঘরে থাকতে উৎসাহ দিচ্ছেন, তাকে আবার থিয়েটার দেখতে বাইরে ডাকবেন কী করে? আর ডাকলেই সে আসবে কেনো? ঘরে বসে সে যখন হাতের কাছে হাজারো বিনোদন ও শিক্ষার উপাদান পাচ্ছে, সেখানে কেনো সে রিস্ক নিয়ে আপনার থিয়েটার দেখতে আসবে? সেকারণেই আমি মনে করি, থিয়েটারের প্রসেস ও এপ্লিকেশনে এক ধরনের পরিবর্তন আনা জরুরি। যা থেকে দর্শক পাবে থিয়েটারের এক নতুন অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতাই তাকে টেনে আনবে থিয়েটার দেখতে।

থিয়েটারের নানারকম প্রসেস এবং অ্যাপ্লিকেশন আমাদের জানা। আমরা পিসকাটর, ব্রেখট, বোয়াল, বারবারার মত বিখ্যাত সব নাট্যমনীষীদের কাজের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা রাখি। বিশেষ করে আমাদের দেশে এখন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত নাট্যকর্মী রয়েছে। সুতরাং নতুন কোন পদ্ধতিতে থিয়েটারকে গতিশীল করা যাবে, তা ভেবে বের করা খুব কঠিন কাজ নয়। তবে এ নিয়ে খুব দ্রুতই ভাবনা-চিন্তা শুরু করা জরুরি বলে আমার মনে হয়।

আমার এই ছোট্ট কিছু ভাবনা আপনাদের মনোজগতে কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে কিনা জানা নেই। তবু এখান থেকে ভাবতে শুরু করলে, এবং দ্রুত ছোট ছোট পদক্ষেপ নিতে শুরু করলেই, করোনার এই সময়ে  আমরা আমাদের থিয়েটারকে আপন শক্তিতে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হবো; এই আমার বিশ্বাস। সকল নাট্যবন্ধু এবং নাট্যকর্মীদের নতুন থিয়েটারের পথে পা ফেলার আহ্বান।


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়