ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

করোনাকালের শিক্ষা বাজেট

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৫ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
করোনাকালের শিক্ষা বাজেট

করোনাসৃষ্ট মহামারির প্রভাবে যখন আমরা নাভিশ্বাস ফেলছি, ঠিক এমন সময় এবার আমাদের ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করতে হলো। শত বাধা বিপত্তির মধ্যেও পৃথিবী থেমে থাকে না, আপন গতিতে চলতে থাকে। প্রতিবছর জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ও বাড়ে। স্বাভাবিক কারণেই পেছনের বছরের চেয়ে পরের বছরের বাজেট একটু বেশি হয়। পারিবারিক বাজেটের ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করলে এ কথার প্রমাণ পাওয়া যাবে।

শিক্ষা খাতে বাজেট নিয়ে প্রতি বছর শুভঙ্করের ফাঁকি থেকেই যায়। যেমন শিক্ষাপ্রযুক্তি খাতের বাজেটে এখানে দেখানো হয়- প্রতিটি ক্যান্টনমেন্টে একটি করে বোর্ড স্কুল থাকে, সেগুলো এমপিওভূক্ত। এদের বাজেট প্রতিরক্ষা বাজেট থেকে আসার কথা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মেডিকেল কলেজ, কিছু মন্ত্রণালয়ের প্রশিক্ষণ একাডেমির বাজেটও শিক্ষা থেকে নির্বাহ করা হয়। ফলে দেখা যায়, শিক্ষায় বাজেট বিশাল কিন্তু শিক্ষার মানে এর খুব বেশি প্রভাব আমরা দেখতে পাই না। ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেটে প্রাথমিক ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় মিলে এবার ৬৬ হাজার ৪০১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। গত বছরের বরাদ্দের চেয়ে এবার ৫ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা বেশি প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২৪ হাজার ৯৪ কোটি টাকা। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা।

দেশে মানসম্পন্ন কারিগরি শিক্ষা বাস্তবায়নের উদ্যোগের কথা জানিয়ে বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে মাথায় রেখে উপযুক্ত প্রযুক্তি ও উপযুক্ত স্কিলগুলোকে চিহ্নিত করা এবং সে অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত করে তুলতে আমরা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন সরকারি ও বেসরকারি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ কোর্স বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান কার্যক্রমের মাধ্যমে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতি সাধারণ জনগোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান হারে আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে। যদিও এবার কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পাবলিক পরীক্ষা ফল তা বলে না। মাদ্রাসা শিক্ষার কথা তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী বলেন, অমাাদের দেশে মাদ্রাসাগুলোর একটা বড় অংশ নিয়মিত স্কুল কলেজগুলোর তুলনায় অবকাঠামোর দিকে থেকে অনেকটা পিছিয়ে। এ অবস্থার উত্তরণে দেশব্যাপী এক হাজার ৮০০টি মাদ্রাসার নতুন ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। বিদ্যমান ৫৬৩টি মাদ্রাসায় আধুনিক মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে স্থাপন করা হবে।

দেশের প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে করোনার সরাসরি প্রভাবে। সরকার এ পরিস্থিতি উত্তরণে  টেলিভিশন, রেডিও, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট-ভিত্তিক শিক্ষা কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা পুনরুদ্ধারে করোনা ঝুঁকি প্রশমন ও এডুকেশন রিকভারি কার্যক্রমের আওতায় বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দসহ কমপক্ষে দুই-তিন বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনা হাতে নেওয়া প্রয়োজন। ওই বিশেষ পরিকল্পনায় পাঠদান, শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া, শিক্ষক ও অভিভাবকদের আশ^স্ত করা, অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষাগুলো বাদ দেওয়া এবং পাঠদানের রুটিন সমন্বয় করা প্রয়োজন। করোনা পরিস্থিতির পরে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য শিক্ষার্থী ও তার পরিবারের মধ্যে সচেতনতা তৈরিতে অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন। কিন্তু সেরকম উদ্যোগ আমরা দেখছি না।

অন্যদিকে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নতুন এমপিওভুক্তি নিয়ে সরকারের বিশেষ কোনো পরিকল্পনার প্রতিফলনও এই বাজেটে নেই। অথচ এবার বাজেট বক্তৃতায় শিক্ষা অংশে এমপিওভুক্তি নিয়ে কথা হবে- সংশ্লিষ্ট সবাই আশা করেছিলেন। এমনিক বাজেট বরাদ্দের সংক্ষিপ্তসারেও এ ব্যাপারে উল্লেখ নেই। ফলে লক্ষাধিক নন-এমপিও শিক্ষকের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। প্রায় দশ বছর পর চলতি অর্থবছরে নতুন এমপিওভুক্তির জন্য বাজেট বরাদ্দ করা হয়। একাধিক শর্ত পেরিয়ে দুই হাজার ৬১৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়। এখনো সাত হাজারের অধিক প্রতিষ্ঠান এমপিওর জন্য অপেক্ষা করছে। এ ছাড়া অনার্স-মাস্টার্স কলেজের শিক্ষক, স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসাগুলোও এমপিওভুক্তির অপেক্ষায় আছে। ফলে তাদের প্রত্যাশা ছিল আগামী অর্থবছরে এমপিওভুক্তির জন্য বরাদ্দ থাকবে। কিন্তু সেই প্রত্যাশার প্রতিফলন বাজেটে পাওয়া যায়নি। তবে, শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণ একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। কিন্তু আলাদা বাজেট ছাড়া সেটি কিভাবে সম্ভব?

অর্থনৈতিক কিংবা ব্যবস্থাপনার কারণে যদি সরকার মাধ্যমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করতে না চায় তাহলে বৃহৎ কোনো সংস্থার কাছে মাধ্যমিকের দায়িত্ব অর্পণ করা যেতে পারে। দেশে তাহলে একদিকে থাকবে সরাকরি বিদ্যালয়, অন্যদিকে সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত বিদ্যালয়, যেখানে শিক্ষকদের চাকরিবিধি থাকবে, সরকারি চাকরি কিংবা তার চেয়েও বেশি সুযোগ-সুবিধা থাকবে। আর কিছুসংখ্যক বিদ্যালয় থাকবে যারা নিজের অর্থায়নেই চলতে পারে। এটি করা হলে শিক্ষকদের পেট নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। শিক্ষকতায় তারা পুরোপুরি মনোনিবেশ করতে পারবেন। তখন সরকারি ও সংস্থা পরিচালিত বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতাও থাকবে। 

সরকার মাধ্যমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করছে না, তার কারণ কি শুধুই অর্থনৈতিক নাকি শিক্ষার মান আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা নাকি এতো বেশি পরিমাণ অযোগ্য লোক শিক্ষকতায় ঢুকে গেছে যাদের দায়িত্ব রাষ্ট্র নিতে চাচ্ছে না, নাকি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা? বিষয়টির গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা প্রয়োজন। এমপিও দেশের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এক ধরনের বিশেষ রাষ্ট্রীয় সহায়তা। ফলে শিক্ষকদের চাকরি বেসরকারিই থেকে যায়, সরকারি চাকুরেদের মতো সুযোগ-সুবিধা তারা পান না। তবে রাষ্ট্রীয় তরফ থেকে মূল বেতনের শতভাগ পেয়ে থাকেন। কিন্তু শতভাগ এমপিও পেতে শিক্ষক সমাজকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। দেশের মোট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে তিন শতাংশের কাছাকাছি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এর কারণ কী? অর্থনৈতিক?

সরকার কি ভয় পাচ্ছে যে, মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোকেও যদি সরকারি করা হয় তাহলে শিক্ষার মান থাকবে না? যদি এ রকম চিন্তা হয় তাহলে সেটি ভালো কিন্তু বিকল্প তো কিছু একটা করতে হবে। এমপিও নামক রাষ্ট্রীয় অনুকম্পার জন্য শিক্ষকদের সব কাজ বাদ দিয়ে প্রতি বছর আন্দোলন করতে হবে আর সরকার বিষয়টিকে সেভাবে আমলে নেবে না সেটি কেমন করে হয়? তার মানে মাধ্যমিক শিক্ষা এভাবে রাষ্ট্রীয় অনুকম্পার ওপর বেঁচে থাকবে? মাধ্যমিক শিক্ষার এই এলোমেলো অবস্থার মধ্যে সরকার বৃহৎ পাঁচটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরির পরিকল্পনা করছে। এটিই বা কেমন চিন্তা? দেশে বর্তমানে রাষ্ট্র পরিচালিত ও বেসরকারি মিলে ১৫০টির মতো বিশ^বিদ্যালয় আছে। রাষ্ট্র পরিচালিত বিশ^বিদ্যালয়গুলোকে আরও সম্প্রসারণ করা যায়। সেগুলো বাদ দিয়ে নতুন করে বিশ^বিদ্যালয় স্থাপনের কতটা যুক্তি আছে তা বোধগম্য নয়। তারচেয়েও বড় কথা হচ্ছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে যদি মানসম্পন্ন শিক্ষাদান করা না হয় তাহলে উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কারা পড়বে, কীভাবে সেগুলো চালানে হবে? তবে, জাতীয় স্কুল মিল নীতিমালা-২০১৯ এর আলোকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুপুরে গরম খাবারের কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী, এর প্রশংসা না করে পারছি না।

লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়