ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

শরীরে কালশিটে দাগের যত অদ্ভুত কারণ

এস এম গল্প ইকবাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২৭ জুলাই ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শরীরে কালশিটে দাগের যত অদ্ভুত কারণ

প্রতীকী ছবি

এস এম গল্প ইকবাল : সাধারণত শরীরের কোথাও আঘাত লাগলে কালশিটে হয়ে থাকে। কিন্তু কালশিটে কি? এ প্রসঙ্গে ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের ফ্যামিলি মেডিসিন ফিজিশিয়ান কোরি ফিশার বলেন, ‘কালশিটে হলো ত্বকের পৃষ্ঠের নিচে অবস্থিত রক্তনালিতে ছোটখাট ইনজুরির প্রতিবিম্ব। এসব রক্তনালি ড্যামেজ হলে অল্প পরিমাণে রক্ত লিক করে, যার ফলে আমরা ত্বকে নীল, কালো বা পার্পল দাগ দেখি- এ দাগকেই কালশিটে বলে।’

অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় যে খুব অল্প আঘাতে কিংবা হালকা ঘষাতেও সহজে কালশিটে পড়েছে, কিন্তু আঘাতটি কালশিটে পড়ার মতো গুরুতর নয়। আবার কেউ কেউ শরীরে কোনো আঘাত ছাড়াই কালশিটে লক্ষ্য করে থাকেন। কিন্তু এ ধরনের কালশিটে হওয়ার কারণ কি? কেন কিছু লোকের সহজেই কালশিটে পড়ে? এসব কালশিটে কি খুব দুশ্চিন্তা করার মতো বিষয়? এ বিষয়ে জানতে এ প্রতিবেদনে আলোচিত কালশিটের অদ্ভুত কারণগুলোর ওপর চোখ বুলাতে পারেন।

* কিছু সাপ্লিমেন্ট

কিছু সাপ্লিমেন্ট অনাকাঙ্ক্ষিত কালশিটের উৎপত্তিতে অবদান রাখতে পারে, যেমন- ফিভারফিউ সাপ্লিমেন্ট, গার্লিক সাপ্লিমেন্ট, জিনজার সাপ্লিমেন্ট, জিংকো সাপ্লিমেন্ট, জিনসেং সাপ্লিমেন্ট, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড বা ফিশ অয়েল সাপ্লিমেন্ট, পালমেট্টো সাপ্লিমেন্ট, ভিটামিন ই সাপ্লিমেন্ট- এসব সাপ্লিমেন্ট রক্তের প্লাটিলেটের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যেকোনো সাপ্লিমেন্ট সেবনের পূর্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া ভালো- এটি শুধুমাত্র একারণে নয় যে সাপ্লিমেন্ট প্রেসক্রিপশন ওষুধের কার্যকারিতা কমায়, সাপ্লিমেন্টগুলো এফডিএ কর্তৃক অনুমোদিতও নয়। তাই আপনি যে আশা নিয়ে সাপ্লিমেন্ট সেবন করছেন সেটা পূরণ নাও হতে পারে, এমনকি উল্টো আপনার শরীর বিরূপভাবে প্রভাবিত হতে পারে।

* নারী

আনফেয়ার, কিন্তু সত্য: নারীদের কালশিটে হওয়ার প্রবণতা পুরুষদের তুলনায় বেশি। পুরুষদের ত্বকের পুরুত্ব বেশি এবং তাদের কোলাজেনও বেশি থাকে, যা ত্বকের রক্তনালিকে অধিক নিরাপদে রাখে ও ট্রমা থেকে রক্ষা করে। ইস্ট্রোজেনও সহজে কালশিটে হওয়াতে ভূমিকা রাখে, কারণ এই হরমোন রক্তনালির প্রাচীরকে দুর্বল করে রাখে। এই হরমোনটি ভেসোডিলেটর হিসেবেও কাজ করে, যার মানে হলো এটি সরু রক্তনালিকে প্রশস্ত করে। এর ফলে ট্রমা ঘটলে রক্ত জমাট বাধার আগেই অধিক রক্ত বেরিয়ে যায়।

* বার্ধক্য

মাউন্ট সিনাই হসপিটালের অন্তর্গত আইকান স্কুল অব মেডিসিনের ডার্মাটোলজি বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট ক্লিনিক্যাল প্রফেসর গ্যারি গোল্ডেনবার্গ বলেন, ‘৬০+ লোকদের সহজে কালশিটে হওয়ার প্রবণতা অবিশ্বাস্যভাবে বেশি। বুড়োকালে অল্প ট্রমাতেই কালশিটে হওয়ার প্রবণতা যৌবনদীপ্ত সময়ের তুলনায় অনেকগুণ বেশি।’ কেন? এ প্রসঙ্গে ডা. ফিশার বলেন, ‘বয়স বাড়ার সাথে সাথে ত্বক পাতলা হতে থাকে এবং রক্তনালি অধিক ভঙ্গুরপ্রবণ হয়ে পড়ে- উভয়টাই একজন বুড়ো মানুষকে সহজে কালশিটে প্রবণ করে তোলে। পাতলা ত্বকে ফ্যাট ও কোলাজেনের পরিমাণ কমে যায়, কিন্তু রক্তনালিকে সুরক্ষিত রাখতে পর্যাপ্ত ফ্যাট ও কোলাজেনের প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়া বুড়ো মানুষের রক্তনালি নমনীয়তা হারায় বলে এগুলো সহজে ফেটে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।’

* রক্ত পাতলাকারী ওষুধ

যদি আপনি হার্ট অ্যারিদমিয়া অথবা ব্লাট ক্লট বা রক্ত জমাটবদ্ধতার চিকিৎসায় রক্ত পাতলাকারী ওষুধ সেবন করেন, তাহলে কালশিটে হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়, বলেন ডা. ফিশার। রক্ত পাতলাকারী ওষুধ ছাড়াও কিছু ওষুধ রক্তকে পাতলা করতে পারে, যেমন- ইবুপ্রোফেন অথবা অ্যাসপিরিন। এসব ওষুধ সঠিকভাবে রক্ত জমাট বাধার ক্ষমতা কমিয়ে ফেলে। একারণে কৈশিল জালিকা (রক্তনালি) ড্যামেজ হলে সচরাচরের তুলনায় বেশিক্ষণ রক্তক্ষরণ হয়, এর ফলে রক্ত লিক করে ও কালশিটে গঠিত হয়।

* রক্তরোগ

হিমোফিলিয়া ও ভন উইলিব্রান্ড উভয়েই হলো রক্তরোগ, যা সহজে কালশিটে তৈরি করতে পারে, বলেন ডা. ফিশার। হিমোফিলিয়া হলো একটি বিরল স্বাস্থ্য সমস্যা যেখানে শরীরের রক্ত জমাট বাধার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, এর ফলে এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি সামান্য ইনজুরিতে তীব্র রক্তক্ষরণের ঝুঁকিতে থাকে। অন্যদিকে ভন উইলিব্রান্ডের ক্ষেত্রে হালকা থেকে মাঝারি মাত্রায় রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে এবং এ রোগটি হিমোফিলিয়ার চেয়ে বেশি কমন। দাঁত মাজার সময় রক্তক্ষরণ, নাক থেকে দীর্ঘমেয়াদে রক্তক্ষরণ, মূত্র বা মলে রক্তের উপস্থিতি ও ভারী পিরিয়ড থেকে ভন উইলিব্রান্ডের আভাস পাওয়া যেতে পারে।

* বিষণ্নতা-বিরোধী ওষুধ

সিলেক্টিভ সেরোটোনিন রিআপটেক ইনহিবিটরস (এসএসআরআই) হলো অ্যান্টিডিপ্রেস্যান্ট বা বিষণ্নতা-বিরোধী ওষুধের কমন ক্লাস- এসব ওষুধের প্রভাব মস্তিষ্কের বাইরেও পড়তে পারে। ফ্লুওক্সেটিন, সারট্রালিন, সিটালোপ্রাম ও বুপ্রোপিওনের মতো এসএসআরআই নিয়ে পরিচালিত গবেষণায় পাওয়া যায়, এসব ওষুধ রক্তের প্লাটিলেটের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে, কিন্তু প্লাটিলেট রক্ত জমাট প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে সহজে কালশিটে হতে পারে, বলেন ডা. ফিশার।

* করটিকোস্টেরয়েড

করটিকোস্টেরয়েড হলো টপিক্যাল বা সিস্টেমিক ওষুধ যা বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। এসব ওষুধও আপনাকে সহজে কালশিটে প্রবণ করতে পারে, কারণ এগুলো ত্বককে পাতলা করে তোলে। ফোলা, লালতা, চুলকানি ও অন্যান্য অ্যালার্জিক টাইপ উপসর্গ উপশম করতে প্রায়শ এসব ওষুধ ব্যবহার করা হয়। একজিমা ও সোরিয়াসিসের মতো ত্বকের সমস্যায় টপিক্যাল করটিকোস্টেরয়েড প্রেসক্রাইব করা হয়ে থাকে, অন্যদিকে হাঁপানি, অ্যালার্জি ও অন্যান্য প্রদাহমূলক সমস্যায় ওরাল করটিকোস্টেরয়েড প্রেসক্রাইব করা হতে পারে।

* ভিটামিন ঘাটতি

অপ্রত্যাশিত কালশিটের অন্যতম কারণ হতে পারে ভিটামিন সি ও ভিটামিন কে ঘাটতি। ক্ষত শুকাতে ও কোলাজেন (ত্বকের গুরুত্বপূর্ণ গাঠনিক উপাদান) উৎপাদনে ভিটামিন সি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। শরীর পর্যাপ্ত ভিটামিন সি না পেলে রক্তনালি ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে। আয়রন ঘাটতি জনিত রক্তস্বল্পতা বেশ কমন এবং এটিও সহজে কালশিটে তৈরি করতে পারে, যেহেতু হিমোগ্লোবিন (যা শরীর জুড়ে অক্সিজেন সরবরাহ করে) তৈরি করতে শরীরের আয়রন প্রয়োজন হয়। লক্ষ্য করার জন্য অন্যান্য উপসর্গ হলো শুষ্ক ও ফাটা ঠোঁট, অদ্ভুত খাবার আকাঙ্ক্ষা ও ভঙ্গুর নখ।

কিভাবে কালশিটে দ্রুত দূর করবেন?

একটি কালশিটে নিরাময় হতে দু’সপ্তাহ পর্যন্ত লাগতে পারে এবং এটিকে দ্রুত অদৃশ্য করার জন্য প্রচুর উপায় নেই। ডা. ফিশার বলেন, ‘শরীরে ক্ষরিত রক্ত শোষিত হওয়ার পর এটি কয়েকটি ধাপের মধ্য দিয়ে যায়। কিছুদিন পর এই নীল/কালো/পার্পল দাগ (কালশিটে) ও ফোলার উন্নতি হয় এবং দাগটি সবুজ অথবা হলুদে পরিবর্তিত হয়। তারপর পুরোপুরি নিরাময় হওয়ার পূর্বে কালশিটেটি হালকা বাদামী দেখাতে পারে।’

আপনি ঠান্ডা সেঁক দিয়ে কালশিটের নিরাময় দ্রুত করতে পারেন। একটি পুনর্ব্যবহারযোগ্য আইস প্যাক কালশিটের ওপর দশ মিনিট ধরে রাখুন, এভাবে দিনে কয়েকবার করুন। এটি রক্তনালিকে সংকুচিত করে, এর ফলে শুরু থেকেই কালশিটে ধীরে ছড়াবে।

আপনার কালশিটে কি বিপজ্জনক মনে হচ্ছে? তাহলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কথা বিবেচনা করুন। কালশিটে দীর্ঘস্থায়ী হলে অথবা খুব যন্ত্রণাদায়ক হলে অথবা নড়াচড়া সীমিত করে ফেললে অথবা হঠাৎ করে দেখা দিলে অথবা ঘনঘন আবির্ভূত হলে চিকিৎসক দ্বারা মূল্যায়ন করুন। সার্জারির পর তীব্র, স্ফীত কালশিটের উৎপত্তি হলেও চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিন।

তথ্যসূত্র : প্রিভেনশন


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ জুলাই ২০১৯/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়