ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

করোনাভাইরাস ইমিউনিটি: যা জানি, যা জানি না

এস এম গল্প ইকবাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫১, ২ মে ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
করোনাভাইরাস ইমিউনিটি: যা জানি, যা জানি না

ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্যানুসারে, ২ মে সকাল পর্যন্ত কোভিড-১৯ সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাসে প্রায় ৩৪ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। ২ লাখ ৪০ হাজার ৫০০ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। পাশাপাশি আরোগ্যলাভ করেছেন ১০ লাখ ৮১ হাজার ৫০০ রোগী।

সাধারণত যেসব লোক সংক্রামক রোগ থেকে সেরে ওঠেন তারা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ওই রোগের প্রতি ইমিউনিটি পেয়ে থাকেন, অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যে তারা পুনরায় আক্রান্ত হন না। কিন্তু কোভিড-১৯ থেকে নিরাময় পাওয়া রোগীরা নতুন করোনাভাইরাস থেকে কতদিন সুরক্ষিত থাকবেন তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

বার্মিংহামে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব আলাবামার মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান ফ্রান্স লান্ড বলেন, ‘নতুন করোনাভাইরাস সম্পর্কে এখন অবধি আমরা যা জানি না তা হচ্ছে: ভাইরাসটির প্রতি ইমিউনিটি কতদিন স্থায়ী হবে, এ ইমিউনিটির মান কেমন এবং সকল লোকেরাই দীর্ঘস্থায়ী উচ্চ ইমিউন রেসপন্স বা অনাক্রম্য প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারবে কিনা।’

নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর ইমিউনিটি অর্জিত হয়?

দুটি ভিন্ন উপায়ে একজন মানুষের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ তন্ত্র নতুন করোনাভাইরাসকে আক্রমণ করে। একটি হলো ইনেট ইমিউন রেসপন্স বা সহজাত অনাক্রম্য প্রতিক্রিয়া ও অ্যাডাপ্টিভ ইমিউন রেসপন্স বা অভিযোজিত অনাক্রম্য প্রতিক্রিয়া।

ইনেট ইমিউন সিস্টেম হচ্ছে আমাদের শরীরের জন্মগত স্বাভাবিক রোগপ্রতিরোধ তন্ত্র যা অপরিচিত ভাইরাস ঠেকাতে অবিলম্বে সক্রিয় হয়। এ তন্ত্রের মধ্যে ত্বকের মতো শারীরিক বেষ্টনি, অশ্রু ও পিত্তরসের মতো প্রতিরক্ষা পদ্ধতি ও প্রদাহের মতো কোষীয় প্রতিক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত।

অ্যাডাপ্টিভ ইমিউন সিস্টেম বা অভিযোজিত রোগপ্রতিরোধ তন্ত্র হচ্ছে শক্তিশালী দ্বিতীয় স্তর। এটির ঘাতক টি-কোষ, ম্যাক্রোফেজ কোষ ও বি-কোষ রয়েছে। ঘাতক টি-কোষ সংক্রমিত কোষকে ধ্বংস করে, ম্যাক্রোফেজ কোষ কোষের ধ্বংসাবশেষ দূর করে ও বি-কোষ অ্যান্টিবডি উৎপাদন করে।

অ্যান্টিবডি হচ্ছে একপ্রকার প্রোটিন যা ভাইরাসের অনন্য গঠন অনুসারে তাকে ধ্বংস করে। নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর যে অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হয় তা কিছুসময়ের জন্য রক্তপ্রবাহে থাকে, কিন্তু গবেষকরা সময়ের দৈর্ঘ্য সম্পর্কে নিশ্চিত নন।

কোভিড-১৯ এর কেস গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ করোনাভাইরাস রোগীর শরীরে অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হয়। চীনা বিজ্ঞানীদের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৭৫ জন কোভিড-১৯ রোগীদের মধ্যে ১০ জনের (প্রায় ৬ শতাংশ) শরীরে অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হয়নি এবং ৩০ শতাংশ রোগীর শরীরে অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হলেও তা উচ্চ মাত্রার ছিল না। গবেষকরা আরো দেখেছেন যে অ্যান্টিবডির মাত্রা ও বয়সের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল। মধ্যবয়সি ও বয়স্ক রোগীদের শরীর অল্প বয়সি রোগীদের তুলনায় উচ্চ মাত্রায় অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হয়েছিল।

নতুন করোনাভাইরাস ও ইমিউন সিস্টেমের মধ্যকার প্রতিক্রিয়া ভালোভাবে জানতে আরো গবেষণার অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু ইতোমধ্যে প্রাপ্ত তথ্য আমাদেরকে এ ধারণা দিচ্ছে যে সেরে ওঠা কিছু রোগী পুনরায় সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন।

নতুন করোনাভাইরাসের প্রতি ইমিউনিটি কতক্ষণ স্থায়ী হয়?

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজের পরিচালক অ্যান্থনি ফসি এপ্রিলের প্রথমদিকে বলেন, ‘কোভিড-১৯ থেকে আরোগ্যলাভ করা লোকদের ইমিউনিটি বছরখানেক পর্যন্ত কার্যকর থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। সাধারণত আমরা জানি যে এ ধরনের সংক্রমণে অন্তত যুক্তিসংগত সময়ের দৈর্ঘ্য পর্যন্ত ইমিউনিটি পাওয়া যায়। এ সুরক্ষা আসে শরীরে উৎপন্ন অ্যান্টিবডি থেকে।’

কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সুরক্ষিত থাকা যাবে কিনা তা এখনো অজানা। ২০০২ সালে আরেকটি করোনাভাইরাস জনিত সংক্রমণ সার্স থেকে আরোগ্যলাভ করা স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর পরিচালিত চীনা গবেষণায় দেখা গেছে, এসব রোগীদের রক্তপ্রবাহে কিছু বছর পর্যন্ত অ্যান্টিবডি ছিল- ২০০৪ সালে সর্বোচ্চ ছিল এবং এরপর কমতে থাকলেও ২০১৫ সালে গবেষণাটি সমাপ্তি পর্যন্ত অ্যান্টিবডির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এখনো পর্যন্ত গবেষণাটি পিয়ার-রিভিউ হয়নি। নতুন করোনাভাইরাসের সঙ্গে সার্স সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাসের ৭৯.৫ শতাংশ জেনেটিক কোড মিল রয়েছে বলে এটা সম্ভব হতে পারে যে কোভিড-১৯ সংক্রমণে উৎপন্ন অ্যান্টিবডি একইরকম আচরণ করবে।

এ সম্ভাবনাও রয়েছে যে ভাইরাসটি যথেষ্ট পরিবর্তিত হলে একটি স্ট্রেইনের ইমিউনিটি আরেকটি নতুন স্ট্রেইন থেকে সুরক্ষা দেবে না। কিন্তু ডা. ফসি আশাবাদী যে করোনাভাইরাস এত বেশি পরিবর্তিত হবে না যাতে ইমিউনিটির ওপর প্রভাব পড়ে। তিনি বলেন, ‘যদি কেউ করোনাভাইরাস এ-তে আক্রান্ত হন, তাহলে তিনি পরবর্তীতে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হলে তা হবে সম্ভবত করোনাভাইরাস বি। কিন্তু এখনো পর্যন্ত মনে হচ্ছে ভাইরাসটি খুব বেশি পরিবর্তিত হবে না। ভাইরাসটির ছোট পরিবর্তনে এর সংক্রমণতা ও উপসর্গ প্রকাশের ধরনে তেমন প্রভাব পড়বে না।’

লোকজন নতুন করোনাভাইরাসে পুনরায় সংক্রমিত হচ্ছেন?

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন যে কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠেছেন এমন রোগীদের আপাতত পুনরায় সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

এপ্রিলের প্রথমদিকে কোরিয়ার রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (কোরিয়ান সিডিসি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১০০ এরও বেশি কোভিড-১৯ রোগীর নিরাময় ও নেগেটিভ রেজাল্টের পর পুনরায় টেস্টে পজিটিভ রেজাল্ট এসেছে। কোরিয়ান সিডিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জিয়ং ইউন-কিয়ং বলেন, ‘আরোগ্যলাভের পর অল্প সময়ের মধ্যে পুনরায় সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। পুনরায় টেস্টে পজিটিভ রেজাল্টের অন্যতম কারণ হতে পারে, সংক্ষিপ্ত সময়ের ব্যবধানে ফলো-আপ টেস্ট করা।’ নিবিড় পর্যবেক্ষণের পর দেশটির সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞরা ৩০ এপ্রিল জানান যে সম্ভবত টেস্টিং প্রক্রিয়ায় খুঁত থাকার কারণে টেস্টে ভাইরাসের ধ্বংসাবশেষ শনাক্ত হয়েছে।

সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হসপিটালের সংক্রামক রোগ বিভাগের প্রধান অহ মিয়াং-ডন বলেন, ‘রোগীরা পুনরায় সংক্রমিত হয়েছেন অথবা তাদের শরীরে ভাইরাসটি পুনরায় সক্রিয় হয়েছে এটা বিশ্বাস করার মতো উল্লেখযোগ্য কারণ গবেষকরা খুঁজে পাননি।’ তবে সন্দেহজনক কেসও রয়েছে। এক জাপানি ট্যুর গাইড নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি সেরে ওঠার তিন সপ্তাহ পর আবার টেস্ট করা হলে পজিটিভ রেজাল্ট আসে। তিনি পুনরায় সংক্রমিত হয়েছেন নাকি প্রথম সংক্রমণ থেকে সম্পূর্ণ নিরাময় পাননি তা সম্পর্কে চিকিৎসকেরা নিশ্চিত হতে পারেননি। এছাড়া ডায়াগনস্টিক টেস্টে ফলস পজিটিভ অথবা ফলস নেগেটিভ রেজাল্টও আসতে পারে।

শরীরে অ্যান্টিবডি আছে কিনা কিভাবে জানা যাবে?

শতাধিক স্বাস্থ্যসেবা কোম্পানি রক্তের অ্যান্টিবডি শনাক্ত করতে টেস্ট উদ্ভাবনে কাজ করে যাচ্ছে। যেহেতু সংক্রমিত লোকেরা উপসর্গবিহীন থাকতে পারে, তাই জনসাধারণের জন্য অ্যান্টিবডি টেস্ট উদ্ভাবন করা গেলে জনস্বাস্থ্য গবেষকরা এ বিষয়ে আরো ভালো চিত্র পাবেন যে কারা নিরাময় পেয়েছেন। এতে স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা অনাক্রম্য ব্যক্তি ও মৃত্যুর হার আরো নির্ভুল শতাংশে পরিমাপ করতে সক্ষম হতে পারেন। জরুরি ব্যবহারের জন্য আটটি অ্যান্টিবডি টেস্ট যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন থেকে অনুমোদন পেয়েছে। কিন্তু কোম্পানিগুলো অনুমোদন ছাড়াই তাদের টেস্টের ডিস্ট্রিবিউশন কার্যক্রম শুরু করতে পারবে। কিন্তু এসব টেস্ট নতুন ও উদ্ভাবনের প্রাথমিক পর্যায়ে আছে বলে গবেষণায় বিভিন্ন মাত্রার নির্ভুলতা দেখা গেছে। চ্যান জাকারবার্গ বায়োহাবের পৃষ্ঠপোষকতায় সম্পন্ন একটি গবেষণায় নতুন করোনাভাইরাসের ১২টি অ্যান্টিবডি টেস্ট মূল্যায়ন করে ৯০ শতাংশের কম নির্ভুলতা পাওয়া গেছে।

বিজ্ঞানীরা নতুন করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টা করছেন। ভাইরাসটির সংস্পর্শে সবসময় অ্যান্টিবডি রেসপন্স সৃষ্টি না হলে এটা দুশ্চিন্তার বিষয় যে এর ভ্যাকসিন সবসময় ইমিউনিটি তৈরি নাও করতে পারে। অধিক সংখ্যক মানুষের মধ্যে ইমিউনিটি তৈরি করতে একটি কার্যকর ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে যথেষ্ট বিজ্ঞানীকে একসঙ্গে কাজ করতে হয়। নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমাতে জনসংখ্যার ন্যূনতম ৫০ শতাংশকে ইমিউনিটি অর্জন করতে হবে।

 

ঢাকা/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়