ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

১৫ বছর পরও রক্ত ঝরছে রুমার পা থেকে

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২১ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
১৫ বছর পরও রক্ত ঝরছে রুমার পা থেকে

এসকে রেজা পারভেজ : একুশ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ১৫ বছর পর এখনো পা থেকে রক্ত ঝরে হামলার শিকার রাশিদা আক্তার রুমার। হাড়ের মধ্যে থাকা স্প্রিন্টার ঘা শুকাতে দেয় না।  অনেক চেষ্টা করেও পা রক্ষা করা যাচ্ছে না। বললেন, পা কেটেই ফেলতে হবে।

রুমা জানান, হাড়ের মধ্যে থাকা স্প্রিন্টার এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নড়াচড়া করে।  আর তখনই  অসহ্য যন্ত্রনায় কয়েকবার আত্মহত্যা করার কথা চিন্তা করেন তিনি।

একুশে আগস্টের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রাইজিংবিডিকে রুমা জানান সেই দিনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা।

ওইদিন সমাবেশে জয় বাংলা বলে আপা (শেখ হাসিনা) নামতে যাবেন এমন সময় বিকট শব্দ। এরপর কোথায় যেন উড়ে গিয়ে পরলাম। কখন, কতক্ষণ ছিলাম জানি না। সন্ধ্যার দিকে আমার কানে কোলাহলের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। তখন আমি চোখ খুলে দেখি রক্ত আর রক্ত।  আমার আঙ্গুল, বা হাত, দুটো পা ভেঙে গিয়েছিলো। পা ভেঙে হাড় বাইরে বেড়িয়ে গিয়েছিলো। হাতির পায়ের মতো ফুলে গিয়েছিলো আমার পা দুটো।  পরে আমি আমার বাম হাতের ওপর ভর দিয়ে কোনো রকম উঠে দেখি আইভি আন্টি ওখানে পড়ে আছে।  আমি ওনার পাশেই ছিলাম।  আমি উঠে যে কাউকে কিছু বলবো তা পারছিলাম না। কিছুক্ষণ পর মাথা ঘুরে পড়ে আবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই। পরে কেউ একজন আমাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।

শুনেছি সেখানে আমাকে লাশের সঙ্গে রেখে চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছিলো। পরে নাকি আমার হেচকি ওঠে। তখন সেখানে থাকা চায়না নামের এক নেত্রী সাবের ভাইকে (সাবের হোসেন চৌধুরী) বলেছিলো, ‘ভাই এই মেয়েটা মনে হয় বেঁচে আছে। চাদরের ভেতর থেকে আমি হেচকির শব্দ শুনতে পেয়েছি।’ সাবের ভাই তার গাড়িতে করে ঢাকা মেডিক্যাল থেকে বাংলাদেশ মেডিক্যালে নিয়ে যান আমাকে।

হাসপাতালের অপারেশন টেবিলে নিয়ে যাওয়া হয় দুই পা কেটে ফেলার জন্য।  আমার সঙ্গে যাওয়া ওই মেয়েটাকে ডাক্তার বলেছিলো, আপনি সই করেন। তখন ওই মেয়েটা বলেছে, আমি তো তাকে চিনি না, কেউ নেই তাই সঙ্গে এসেছি। পরে আমার পা আর কাটলো না। নোয়াখালীর জাহাঙ্গীর ভাই তখন আপার পিএ ছিলো সে আমাকে চিনতো। তিনি আমাকে দেখে ডাক্তারদের বললেন ওনার পা কাটবেন না। ওনার চিকিৎসার দায়িত্ব নেত্রী (শেখ হাসিনা) দেখবেন।  ওনাকে আমার কাছে হ্যান্ডওভার করেন।  তখন ডাক্তাররা বললো, ওনার অবস্থা ভালো না।

পরে জাহাঙ্গীর ভাই আমাকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু পঙ্গু হাসপাতালের অবস্থা আরো খারাপ হওয়ায় আমাকে নিয়ে আসেন শিকদার মেডিক্যালে। তখনও আমার জ্ঞান ছিলো না। এরপর ২৪ ঘন্টার মধ্যে আমার পাসপোর্ট তৈরি করে ভারত পাঠানো হয়।  আমাকে যখন ভারত নেয়া হয় তখনও আমার জ্ঞান ছিলো না। কলকাতার প্যারালাইজড হসপিটালে চিকিৎসা চললো।  তারাও মনে করেছিলো আমি বোধহয় মারা গেছি। ২০ ব্যাগের মতো রক্ত লেগেছিলো আমার অপারেশনে।

অপারেশনের পর সাতদিন কোনো জ্ঞান ছিলো না আমার।  শরীরের ব্যাথা অনুভব করছি আমি বলতে চাচ্ছি, কিন্তু বলতে পারছি না।  সাতদিন পর আমার জ্ঞান আসলো। কিন্তু চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। ভাবলাম বোধহয় অন্ধ হয়ে গেছি। কিন্তু ডাক্তার বললো যে ওনার বেশি রক্তক্ষরণ হয়েছে তাই এই সমস্যা হচ্ছে। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।

পাঁচ মাস সেখানে চিকিৎসা শেষে দেশে আসলাম।  কিন্তু আমার সেখানে আরো চিকিৎসা দরকার ছিলো।  স্বামী নেই, আমাকে না দেখে বাচ্চা দুটোর অবস্থাও খারাপ হয়ে গেলো। নাসিম ভাই বললেন তিনি আমাকে দেশে এনে বাংলাদেশ মেডিক্যালে ভর্তি করিয়ে দেন। সেখানে ১৮ দিন চিকিৎসা নিয়ে আবারো কলকাতা পাঠালেন ডাক্তাররা। সেখানে ‍দুই বছর চিকিৎসা নিয়েছি।

পায়ের বর্তমান অবস্থা জানাতে গিয়ে রুমা পা দেখিয়ে বলেন, ১৫ বছরের আঘাতের রক্ত এখনো শুকায়নি। শত শত স্প্রিন্টারের যন্ত্রনা। এক্সরে দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার শরীরের মধ্যে যেসব স্প্রিন্টার এগুলো চামড়ার মধ্যে না, হারের মধ্যে। এজন্য ক্ষত শুকায় না। স্প্রিন্টারগুলো হাড়ের মধ্যে মুভ করে। তখন মনে হয় নিজের পা নিজে কেটে ফেলি। ডাক্তাররাতো আগেই কেটে ফেলতে চেয়েছিল। আমিও সই করে দিয়েছেলাম। কিন্তু আপা (শেখ হাসিনা) দেন নি।  যখন দেখতে এসেছিলেন আপাকে বলেছিলাম, আপা আমার পা আর রাখতে চাই না। তখন তিনি বলেছিলেন, একটু কষ্ট সহ্য করো, আমি সব দেখছি।  দুটো পাই কেটে ফেলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। এখন বাম পা মোটামুটি ঠিক হলেও ডান পায়ের ক্ষত শুকায়নি।  গত ১৫ বছর ধরে অসহ্য যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছি।  এখন পা কেটে ফেলতেই হবে।

প্রধানমন্ত্রীর অনুদান কয়েকবার পেলেও দলের পক্ষ থেকে কোনো সহায়তা না পাওয়ায় নেতাদের প্রতি ক্ষুব্ধ রাশিদা আক্তার রুমা। তিনি বলেন ‘চিকিৎসার অনেক খরচ এখন প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে আমাদের দেওয়া হয়। কিন্তু ১২/১৪ হাজার টাকা খরচ যাচ্ছে, নিজের জায়গা বিক্রি করে চিকিৎসা করেছি, বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছি। দলের কোন নেতা আমার খবর নেয় না। আমি মরে যাচ্ছি, কেউ খবরও নেয় না। এককালীন দশ লাখ টাকা দিয়েছে যা ব্যংকে রাখা আছে ওখান থেকে যে টাকা পাই তা দিয়ে সংসার চললেও চিকিৎসা করা কঠিন। এখন উন্নত চিকিৎসা ছাড়া আমার পা কাটতে হবে।’

সরকারি হাসপাতালে গেলে নানা লাঞ্চনা বঞ্চনার স্বীকার হতে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যেহেতু আমার পায়ে ঘাঁ, সব সময় পানি ঝড়ে সুতরাং দু-দিন পর পর হাসপাতালে যেতে হয়, হাসপাতালে গেলে গ্রেনেড হামলার রোগী বললে তারা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, ঠিকমত চিকিৎসা করে না। বিছানা তো দুরের কথা ফ্লোরে শুয়ে থেকে চিকিৎসা করতে হয়। আমি গত কয়েকদিন আগেও ঢাকা মেডিক্যালে গিয়ে এমন লাঞ্চনা বঞ্চনার স্বীকার হয়েছি।’

ভিডিও:




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ আগস্ট ২০১৯/রেজা/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়