‘ড্যান্ডি খাইলে রাজা মনে হয়’
কমলাপুর বিআরটিসি বাস ডিপোর বিপরীত পাশে কয়েকজন পথশিশুর জটলা। ওদের মুখ থেকে গানও শোনা যাচ্ছে। প্রত্যেকের হাতে পলিথিন। মুখে পলিথিন লাগিয়ে তারা ড্যান্ডি টানছে।
কাছে গিয়ে বসতেই বলে, মামা কী চাও?
-তোমার নাম কী?
-রায়হান।
-বয়স?
-আট।
-বাবা, মা আছে?
-‘বাবা-মা থ্যাইকাও নাই। ট্রেনে করে দুই বছর আগে নরসিংদী থেকে কমলাপুর আসি। মাল টানতে টানতে এখানে থাকা। বন্ধুদের সঙ্গে প্রথমে সিগারেট খাই। তারাই ড্যান্ডি ধরাইয়া দেয়। ড্যান্ডি খাওয়ার পর নিজেকে রাজা মনে হয় মামা।’
আরেক শিশু রিমন। সে বলে, ‘ড্যান্ডি বানাইয়া খাই। এটি খাইলে মনের দুঃখ থাকে না। ক্ষুধাও লাগে না।’
প্রশ্ন করা মাত্রই মুচকি হেসে রিমন বলে, ‘মানুষের মাল টানা, রিকশা, ঠেলাগাড়ি ঠেলে, কেউ ভিক্ষা করে ড্যান্ডির টাকা জোগাড় করে।’
শুধু কমলাপুর নয়, কমলাপুর স্টেশনের সামনের রাস্তা, ব্রিজের ওপর, আট নম্বর প্ল্যাটফর্ম, ছয় নম্বর বাস কাউন্টার সংলগ্ন ফুটপাত এবং খালি জায়গায় প্রতিদিন প্রায় ২০০ পথশিশু ড্যান্ডি খেয়ে বসে বসে ঝিমায়। মুখে পলিথিন দিয়ে শ্বাস নিতে মগ্ন থাকে।
মালিবাগ কাঁচাবাজার সংলগ্ন ফুটপাত। বুধবার দুপুরে ড্যান্ডি খাওয়ার এক ফাঁকে এ প্রতিবেদককে দেখে পালানোর চেস্টা করছিল রমজান। বয়স সাত বছর। পিছু নিয়ে অভয় দেয়ার পর বলে, ‘স্যার বাবা-মা কোথায় থাকে জানি না। দোকান এবং ভ্যানের মাল ওঠানামা করে যে টাকা পাই, তা দিয়ে ড্যান্ডি কিনি। ৬০ টাকা লাগে কিনতে। দুই বেলা ড্যান্ডি খাইলে হয়। খাবার না খাইলেও চলে। ড্যান্ডি খাইলে ক্ষুধা লাগে না।’
সরেজমিনে রাজধানীর গুলিস্তান, সচিবালয় সংলগ্ন ফুটপাত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকা, যাত্রাবাড়ী, ফার্মগেট, বিভিন্ন ফুটওভার ব্রিজের নিচে ওপরে, বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকা, মিরপুর স্টেডিয়ামের আশপাশ, বস্তি, রমনা পার্ক, পলাশী মোড়, দোয়েল চত্বর, চানখারপুল, শহীদ মিনার, ঢাকা মেডিক্যাল চত্বর এলাকায় সবচেয়ে বেশি তৎপর মাদকাসক্ত এসব পথশিশু। অনেকেই আবার নেশার টাকা জোগাড় করতে চুরি-ছিনতাইয়েও জড়িয়ে পড়ছে।
জুতা কিংবা ফোমে ব্যবহৃত সলিউশন (আঠা) পলিথিনে ভরে সেই পলিথিনের মধ্যে শ্বাস ফেলা ও সেই বাতাস আবার প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে টেনে নেয়ার মাধ্যমে নেশা করে তারা।
জানা গেছে, ৩০ থেকে ৪০ টাকায় এক ধরনের জুতার গাম কেনে শিশুরা। নগরীর প্রায় সব এলাকাতেই এসব গাম পাওয়া যায়। পলিথিন ব্যাগে আঠাল ওই পদার্থ নিয়ে কিছুক্ষণ ঝাঁকানো হয়। তারপর পলিথিন থেকে নাক বা মুখ দিয়ে বাতাস টেনে নেয়। এই নেশা ‘ড্যান্ডি’ নামে পরিচিত।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ৮ থেকে ১০ বছর বয়সের শিশুরা সাধারণত গাঁজা, সিগারেট ও গাম সেবন করে। অধিকাংশ পথশিশু ড্যান্ডিতে আসক্ত।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক ফজলুর রহমান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘জুতার আঠা নিষিদ্ধ কোনো বস্তু নয়। এ কারণে এ বিষয়ে কিছু করতেও পারছি না। এটি একটি নতুন নেশা। অনেক পথশিশু এই নেশায় জড়িয়ে পড়ছে। সচেতনতাই পারে তাদের ফিরিয়ে আনতে।’
অভিযোগ আছে, পথশিশুদের মধ্যে কেউ কেউ আবার মাদক পরিবহন ও সরবরাহকারী। পথশিশুদের ব্যবহার করে মাদক ব্যবসা পরিচালনা করে কিছু সিন্ডিকেট। লুঙ্গির আড়ালে, শার্ট-প্যান্টের পকেটে, কখনো বা বাদাম বিক্রি করার ছলে তারা মাদক বিক্রি করে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) মাসুদুর রহমান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘শিশুদের ব্যবহার করে কিছু লোক মাদক ব্যবসা করছে। আবার শিশুদের বেলায় আইনের বাধ্যবাধকতা না থাকায় আমরা তেমন কিছু করতেও পারছি না।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, বঞ্চিত শৈশবে সাময়িক সুখের প্রত্যাশায় অন্ধকারের চোরাবালিতে হারিয়ে যাচ্ছে এসব শিশুরা। জরাজীর্ণ হয়ে পড়ছে তাদের জীবন। এখনই তাদের সুপথে ফিরিয়ে না আনলে এরাই এক সময় বড় অপরাধী হয়ে পড়তে পারে।
ঢাকা/মাকসুদ/সাইফ
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন