ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বায়ুদূষণ কি জরুরি অবস্থা জারির পর্যায়ে যাচ্ছে?

আহমদ নূর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩০, ২৫ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বায়ুদূষণ কি জরুরি অবস্থা জারির পর্যায়ে যাচ্ছে?

বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ এখন বাংলাদেশ। বায়ুদূষণের দিক দিয়ে বাংলাদেশের ধারে কাছেও নেই কোনো দেশ।  আশঙ্কাজনকহারে দূষিত হচ্ছে ঢাকার বাতাস।  এতে উদ্বেগ ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে নগরবাসীর মধ্যে।

এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) দেখে গেছে সোমবার সন্ধ‌্যা ৬টার দিকে ঢাকার বায়ুর সূচক ছিল ১৬৯। গত ৫ দিনের ঢাকার বায়ুর সূচক সর্বনিম্ন ১০৯ থেকে সর্বোচ্চ ২৮৬ পর্যন্ত ছিল ।

বায়ুদূষণের এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে, ঢাকায় বায়ুদূষণ জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরি অবস্থার দিকে যাচ্ছে কী? পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ডা. আব্দুল মতিন রাইজিংবিডিকে বলেছেন, ‘জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা জারি করা দরকার। ’

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন সোমবার বিকেলে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ঢাকার বায়ু ও শব্দদূষণ বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার শুরুতে বলেন, ‘ঢাকা সিটিতে বায়ুদূষণের মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে।  মূলত তিন কারণে ঢাকাসহ সারা দেশে বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়ছে।  সেগুলো হলো- ইটভাটা, মোটরযানের কালো ধোঁয়া এবং যথেচ্ছ নির্মাণকাজ।’

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী জানান, প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন’র এ দেশীয় পরিচালক রাকিবুল আমিনের মতে, বায়ুদূষণ মোকাবিলার প্রথম কাজ হচ্ছে দূষণের উৎস বন্ধ করা। দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে, শহরের বিভিন্ন স্থানে সবুজ বেষ্টনি গড়ে তোলা এবং জলাশয়গুলো রক্ষা করা। এ দূষিত বায়ুর মধ্যে নগরের মানুষ কীভাবে নিরাপদ থাকবে, সে ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা।  তবে সবার আগে বায়ু দূষণকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সংকট হিসেবে দেখতে হবে।

চলতি মাসের শুরুতে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির বাতাসের দূষণের সূচক ৫০০ বা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছায়। ওই সময় সেখানে জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা জারি করা হয়।

এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের মান অনুযায়ী বায়ুর সূচক ৫০ এর নিচে থাকলে সেটিকে স্বাস্থ্যকর ধরা হয়। ৫০ থেকে ১০০ এর ভেতরে থাকলে সেটিকে মধ্যপন্থী বা সহনীয় পর্যায় ধরা হয়।  ১০০ থেকে ১৫০ এর মধ্যে থাকলে সেটিকে সেনসিটিভ মানুষের জন্য অসাস্থ‌্যকর হিসেবে ধরা হয়। ১৫০ থেকে ২০০ এর মধ্যে অসাস্থ‌্যকর বায়ু হিসেবে ধরা হয়।  ২০০ থেকে ৩০০ পর্যন্ত খুবই অস্বাস্থ্যকর বায়ু।  বায়ুর মান ৩০০ এর উপরে উঠে গেলে সেটিকে বিপজ্জনক বা ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়।

ঢাকায় বায়ুদূষণের বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি। এর মূলে ঢাকায় চলমান উন্নয়নে ব্যবস্থাপনার অভাব, ইটভাটা, অপরিকল্পিত কলকারখানা, গাড়ির কালো ধোঁয়া দায়ী। এর স্বাস্থ্যঝুঁকিও মারাত্মক। এ সমস্যা নিরসনে সরকারেক কার্যকরি ও দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবীদ ড. আদিল মোহাম্মদ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘ঢাকার বায়ু উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এর কারণে কনস্ট্রাকশন ও সবুজের সমন্বয়হীনতা। চারদিকে তাকালেই দেখা যায় ঢাকা যেন সবুজ শূন‌্য এক শহর। দিন দিন সবুজায়নের হ্রাস পাচ্ছে। এছাড়া ঢাকার চারপাশে ইটভাটা, মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন উন্নয়ন, প্রচুর গাড়ির ধোঁয়া, ঘনবসতি, অপকরিকল্পত শিল্পকারখানা বায়ুদূষণের জন্য দায়ী।’

তিনি বলেন, একটি শহরের অন্তত ২৫ শতাংশ অপেন স্পেস থাকতে হয় যেখানে সবুজায়ন হবে।  কিন্তু ঢাকায় তা নেই। আমাদের এখানে কোনো ডেভেলপমেন্ট হলে পরিবেশের কথা বিবেচনা করে কোনো পরিকল্পনা করা হয় না।

প্রায় একই কথা উঠে আসে বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের নেতা আব্দুল মতিনের কথায়ও। তিনি বলেন, ঢাকায় বায়ুদূষণের প্রধান কারণ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড।  তবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখা যাবে না।  কিন্তু এর সঠিক ব্যবস্থাপনা দরকার।  জাপানে কোনো কনস্ট্রাকশন হলে সেখানে নীল প্লাস্টিক দিয়ে ঢাকা থাকে। এতে ধুলা বাইরে আসে না। কিন্তু আমাদের কনস্ট্রাকশনগুলো সব সময় অরক্ষিত থাকে।

বাংলাদেশে মাটির বৈশিষ্ট‌্য তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা ডেল্টা ল্যান্ডে বসবাস করি। আমাদের ভূমি মূলত নদীর পলি মাটি এসেছে।  ফলে এখানে ধুলো বালির মাত্রা বেশি। কিন্তু পাহাড়ের মাটি শক্ত থাকায় সেখানে ধুলো বালি কম থাকে।

তিনি বলেন, ঢাকা ও এর আশপাশে যে পরিমাণ কলকারখানা, ইটভাটা, সেখান থেকে যে কী পরিমাণ বর্জ্য উৎপাদন ও কার্বন তৈরি করছে- সেদিকে কোনো নজর নেই।

বায়ু দূষণ থেকে উত্তরণের বিষয়ে আদিল মোহাম্মদ বলেন, এ সমস্যা একদিনে বা বুলেট গতিতে সমাধান সম্ভব নয়।  বছরের পর বছর ধরে তৈরি করা সমস্যা সংক্ষিপ্ত পথে বা উপায়ে সমাধান করা সম্ভব হবে না। তবে ঢাকার আশপাশ থেকে ইটভাটাগুলো সরানো ও ঢাকা থেকে গাড়ি কমানো গেলে এবং  উন্নয়ন প্রকল্পগুলো থেকে যেন ধুলার পরিমাণ কম হয় সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।  প্রয়োজন ছাড়া ঢাকায় নতুন কনস্ট্রাকশন বন্ধ করে সবুজায়নের দিকে গুরুত্ব দেয়া দরকার।  এক্ষেত্রে ব্যক্তি পর্যায়ে অনেকে রুফ গার্ডেনিং করতে পারেন।  যদিও রুফ গার্ডেনিং চাহিদার তুলনায় কিছুই না। তবে ছোট ছোট এক একটি অংশগ্রহণ পরবর্তীতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

বায়ুদূষণের স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা তুলে ধরে ডা. আব্দুল মতিন বলেন, প্রথমে মানুষের শ্বাসনালী ও ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া নিউমোনিয়া, যক্ষা, ক্যানসারের মতো রোগ হতে পারে।  এজন্য ঢাকায় জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা জারি করার আহ্বান জানান ডা. আব্দুল মতিন।

তিনি বলেন, বাতাসের সূচক যে জায়গায় পৌঁছেছে, সেখানে ঢাকায় জরুরি অবস্থা জারি করা উচিত।  পাশাপাশি ওই সময়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন এবং কীভাবে এ জায়গা থেকে উত্তোরণ পাওয়া যায়- সে বিষয়ে সরকারের চিন্তা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ এবং আমরা সরকারের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত আছি।

পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ড. মল্লিক আনোয়ার হোসেন বলেন, বায়ুদূষণ উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ বিষয়ে আমরা কাজ করছি। 

উল্লেখ‌্য, বৈশ্বিক বাতাসের গুনাগুণ নিয়ে তথ্য সংগ্রহকারী সুইজার‌ল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার ভিজুয়াল ও গ্রিন পিসের গবেষণা তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের দূষিত বায়ুর দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ।  আর রাজধানী ঢাকা রয়েছে দূষিত বায়ু শহরের তালিকার দ্বিতীয় অবস্থানে। 




ঢাকা/নূর/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়