‘শিশুতোষ’ ভুল, বিশ্বমঞ্চে বড় মাশুল!
২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। ভেন্যু লন্ডনের ওভাল। প্রোটিয়া পেসার লুঙ্গি এনগিডিকে পরপর দুই বলে পুল করে দুই চার সৌম্য সরকারের। খেলা তখন শুরু হয়েছে মাত্র। সাজঘরে নড়েচড়ে বসার আগেই ওই দুই চার। তাতে পুরো দল উদ্বেলিত হয়ে বলে উঠে, ‘আজ আমরা জিতব।’
ওই দুটি শট পুরো দলের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়। শারীরিকভাষায় চলে আসে পরিবর্তন। মাঠে সর্বোচ্চটা নিংড়ে দেওয়ার প্রেরণা পেয়ে যায় বাংলাদেশ। ফলাফল বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই জয়। লাল-সবুজের ড্রেসিংরুমটা এমনই। ছোট্ট মুহূর্ত পুরো দলকে এক করে ফেলে। ছোট্ট মুহূর্ত পুরো দলকে ছন্নছড়া করে ফেলে! প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ঝাঁকুনি দিয়ে বিশ্বকাপের উত্তেজনাও বাড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ। ঠিক পরের ম্যাচেও নিউজিল্যান্ডকে প্রায় নামিয়ে এনেছিল মাশরাফির দল। কিন্তু ‘শিশুতোষ’ এক ভুলে সব ওলটপালট হয়ে যায়।
মাত্র ২৪৪ রানের পুঁজি নিয়ে বিশ্বকাপের রানার্সআপ দলকে চেপে ধরেছিল বাংলাদেশ। মাত্র ২ উইকেটে জয় পায় কিউইরা। অথচ ম্যাচের ভাগ্য এমন নাও হতে পারত যদি মুশফিক ‘শিশুতোষ’ ভুল না করতেন! তামিমের সরাসরি থ্রোতে যদি কেন উইলিয়ামসন রান আউট হতেন, তাহলে রস টেলরের সঙ্গে তার ১০৫ রানের জুটিটি হতো না। ৬ রানে শেষ হতো তাদের লড়াই। কিন্তু ওই জীবনে খাদের কিনারা থেকে দলকে যেভাবে তারা উদ্ধার করেছেন তাতেই যেন সব পাওয়া হয়ে যায় কিউইদের।
স্কোরবোর্ডে বড় পুঁজি ছিল না। তাই বোলিংয়ে শুরুতেই দরকার ছিল উইকেট। সেটাও হয়নি প্রথম ৫ ওভারে। ষষ্ঠ ওভারে বোলিংয়ে আসা দুর্দান্ত সাকিব এসেই তুলে নেন গাপটিল ও মুনরোর উইকেট। ৫৫ রানে দুই ওপেনার সাজঘরে। নতুন দুই ব্যাটসম্যান কেন উইলিয়ামসন ও রস টেলরের জন্য আক্রমণাত্মক ফিল্ডিং সাকিবের। ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে এ জুটি ভেঙেছিল রান আউটে। বোঝাপড়ার একটা ঝামেলা থাকতেও পারে! নইলে ২০১৯ বিশ্বকাপে একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে একই ভুল কিভাবে হয়।
দুই ডানহাতির জন্য সাকিবের সেটআপ ছিল দারুণ। শর্ট লেগে মোসাদ্দেক। পয়েন্টের খুব কাছে মিরাজ, কাভারে মাশরাফি, মিড অফে তামিম, মিড অনে মাহমুদউল্লাহ। সাকিবের থেকে ‘বাঁচতে’ অধিনায়ক উইলিয়ামসনকে বিপদেই না ঠেলে দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের ৪০০তম ম্যাচ খেলতে নামা টেলর। আলতো টোকা দিয়ে বল তামিমের কাছে পাঠিয়ে ভোঁ দৌড় টেলরের। শুরুতে সাড়া না দিলেও পরবর্তীতে বেরিয়েছিলেন উইলিয়ামসন। ফিল্ডিংয়ে থাকা তামিম বল লুফে চোখের পলকে থ্রো করলেন। উইলিয়ামসন ভেতরে প্রবেশের আগেই ভাঙল স্টাম্প। কিন্তু উল্লাস নেই বাংলাদেশ শিবিরে! সাকিবের মাথায় হাত, পেছনে মাহমুদউল্লাহ। তামিম বসে পড়লেন মাটিতে। অধিনায়ক মাশরাফির মুখ বিমর্ষ। মুশফিকের মুখে নেই হাসি।
তৃতীয় আম্পায়ার জোয়েল উইলসন রিপ্লে দেখে জানালেন নট আউট। সবকিছুই তো পারফেক্ট হলো! তাহলে? তামিমের থ্রোতে স্টাম্প ভাঙার আগে মুশফিক শরীর দিয়ে ভাঙেন স্টাম্প। বেল পড়ে যাওয়ায় রান আউটের জন্য স্টাম্প উঠানোর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল। হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়া হৃদয়ে প্রাণ ফিরে পান উইলিয়ামসন। বাংলাদেশের ম্যাচ ওখানেই শেষ!
রস টেলর মাইলফলক ছোঁয়া ম্যাচটিতে করেন ৮২ রান। উইলিয়ামসনের ব্যাট থেকে আসে ৭২ বলে ৪০। রান আউটের সহজতম সুযোগটি হাতছাড়া করে কঠিনতম মুহূর্তে নিজের আয়ত্বের বাইরের ক্যাচ ধরে (রস টেলর) বাংলাদেশকে ম্যাচে ফিরিয়েছিলেন মুশফিক। কিন্তু শেষ হাসিটা হাসতে পারেননি। স্বল্প পুঁজি নিয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ পর্যন্ত লড়াই করেছিল বাংলাদেশ। হারার আগে হারেনি। হতে পারে এটাই ওই ম্যাচে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
তবে বিশ্বমঞ্চে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে যেই ‘শিশুতোষ’ ভুল করলেন তার ব্যাখ্যা নেই কোনো। স্ট্যাম্পের ওপরে থাকা বল সব সময়ই লুফে নিতে হয় বিহাইন্ড দ্য উইকেট। উইকেট রক্ষকদের হাতেখড়ি হয় এ শিক্ষাতেই। মুশফিকের ছোট্ট ভুলে বাংলাদেশ বড় মাশুল দেয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তবে ওই রান আউট নিয়ে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার কোনো আক্ষেপ ছিল না। মুশফিককে দোষও দেননি তিনি। অধিনায়ক বলেছিলেন, ‘এটা খেলার অংশ। এটা হতে পারে। রান আউটের সুযোগ হাতছাড়াটা ভুলে হয়েছে । আমাদের তার (মুশফিকের) ওপর চড়াও হওয়া ঠিক হবে না। এটা যে কারো সাথেই হতে পারে। ও ওর সর্বোচ্চটা দিয়েই মাঠে চেষ্টা করে। থ্রো’ টা ভালো ছিল। কিন্তু কিপার হিসেবে সব সময়ই এটা আবিষ্কার করা কঠিন যে বল স্ট্যাম্পে আছে কিনা। ও বল পিক করতে চেয়েছিল। কিন্তু ওর শরীরে লেগে স্ট্যাম্প ভেঙেছিল। এরকম ভুল হতে পারে। এই ভুলে জন্য তার ওপর চড়াও হওয়ার কিছু নেই।’
মুশফিকের ওপর নিজের আস্থা রেখে মাশরাফি আরও বলেছিলেন, ‘আমার কাছে মনে হয় মুশফিকের ব্যাপারে আমাদের কোন ব্লেইম নেই। আমি নিশ্চিত মুশফিক সেটা জানে। ওই ভুল করার পর মুশফিক রস টেলরের যে ক্যাচটা ধরেছে, গ্র্যান্ডহোমের ক্যাচটা ধরেছে ওটাই হয়তো টার্নিং পয়েন্ট হতে পারতো।’
২০১৯ সালের আজকের দিনেই ম্যাচটি হয়েছিল ওভালে। ক্রিকেটপ্রেমিদের টাইমলাইনে ভেসে আসছে পুরোনো আফসোস। অনেকেই মনে করে ওই একটা রান আউট হয়ে গেলে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পারফরম্যান্সই পাল্টে যেত। বিশেষ করে বড় দুই দলকে হারানোর পর স্বাভাবিকভাবেই আত্মবিশ্বাস দ্বিগুন হয়ে যেত মাশরাফি ব্রিগেডের। সেমিফাইনালে খেলার আশায় থাকা বাংলাদেশ হয়তো আরও একধাপ এগিয়ে যেত। হয়নি তাইতো এখন অনেক আফসোস। ‘শিশুতোষ’ ভুলে বিশ্বমঞ্চে দিয়েছে বড় মাশুল!
ঢাকা/ইয়াসিন
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন