ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

দ্বিতীয় পর্ব || টোকিও ইজ এক্সপেন্সিভ

শাকুর মজিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২৮, ২৬ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দ্বিতীয় পর্ব || টোকিও ইজ এক্সপেন্সিভ

‘আকা-১৮’ লেখা একটা টেবিলে একজন সত্তর বছর বয়সী লোক বসে আছেন, তিনি  ইংরেজি জানেন না। তার সাথে আওয়ার বাস, হোটেল গো- এই টাইপের কথা বলা হচ্ছে এবং কেউ কোনো ভালো জবাব পাচ্ছেন না। আমি মন খারাপ করে ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করতে ব্রত হই। অনেকক্ষণ টেপাটেপি করে আমি এয়ারপোর্টের ফ্রি ওয়াই-ফাই কানেকশন পেয়ে যাই। আমি জানি অনেক দূরে সিম কার্ড কেনার জন্য কয়েকজন লাইনে আছেন, কিন্তু কেউই হাতে সিম কার্ড পান নি। আমি পেয়ে গেলাম এয়ারপোর্টের ফ্রি ওয়াই-ফাই। এবার আমাকে ঠেকায় কে?

আমার প্রথম কাজ হচ্ছে একটা সেলফিসহ স্ট্যাটাস দিয়ে দুনিয়াকে জানানো যে, আমি এখন টোকিওতে পৌঁছে গেছি। বাংলাদেশের ঘড়িতে যদিও এখন বেলা পৌনে চারটা, টোকিওতে এখন তিন ঘণ্টা পিছিয়ে পৌনে সাতটায় গড়িয়েছে। ঢাকা থেকে বেরুনোর কুড়ি ঘণ্টা পার হয়ে গেছে এর মধ্যে। এখন কত দ্রুত হোটেলে যেতে পারি, সেই চিন্তায় আছি।

আমি বড় দলের কাছে যাই। দেখি বড় বড় দলনেতারা সবাই বাইন মাছের মতো মুখ চোখা করে এ-ওর দিকে তাকাচ্ছেন।
আমি বলি, জেআইএ-র লোকজন কই?
কেউ কথা বলে না।
একজন দূরে আঙুল দেখিয়ে বলেন- ঐ যে।

ওটানি হোটেল। আমরা এই হোটেলে এসে উঠেছি

আমি দেখি এক দোকানের ডেস্কের উপর ACA-18 (Asian Congress of Architect’s-2018) লেখা একটা সাইনবোর্ড সামনে রেখে সেই দুই বৃদ্ধ বসে আছেন। তাদের সামনে কেউ নেই। নেতারা গিয়ে কথা বলে এসেছেন। কোনো অনুরোধ, আবদারে কাজ হচ্ছে না। ১০৩ বছর আগে জাপানিদের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রথম লিখেছিলেন তাঁর জাপানি জাহাজের কাপ্তানকে নিয়ে। খিদিরপুর ডক থেকে জাহাজ ছাড়ার পরের দিন সকালবেলার কাহিনী। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: ‘আমাদের এই জাপানি কাপ্তেনের একটু বিশেষত্ব আছে। মেলামেশায় ভালো মানুষিতে হঠাৎ মনে হয় ঘোরো লোকের মতো। মনে হয়, এঁকে অনুরোধ করে যা-খুশি তাই করা যেতে পারে; কিন্তু কাজের বেলায় দেখা যায় নিয়মের লেশমাত্র নড়চড় হবার জো নেই। আমাদের সহযাত্রী ইংরেজ বন্ধু ডেকের উপরে তাঁর ক্যাবিনের গদি আনবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষের ঘাড় নড়ল, সে ঘটে উঠল না। ব্রেকফাস্টের সময় তিনি যে-টেবিলে বসেছিলেন সেখানে পাখা ছিল না; আমাদের টেবিলে জায়গা ছিল, সেই দেখে তিনি আমাদের টেবিলে বসবার ইচ্ছা জানালেন। অনুরোধটা সামান্য, কিন্তু কাপ্তেন বললেন, এ বেলাকার মতো বন্দোবস্ত হয়ে গেছে, ডিনারের সময় দেখা যাবে। আমাদের টেবিলে চৌকি খালি রইল, কিন্তু তবু নিয়মের ব্যাত্যয় হল না। বেশ বোঝা যাচ্ছে অতি অল্পমাত্রও ঢিলেঢালা কিছু হতে পারবে না।’

এখানেও তাই । একসময় সবাই বুঝে ফেলি যে, এখানে কিছুই ফ্রি পাওয়া যাবে না। সবই নিজের করে নিতে হবে। জিনিসপত্রের দামের দিকে তাকিয়ে বুঝে ফেলি- জাপান বেশ ব্যয়বহুল হবে। আমরা ৭ হাজার ইয়েন (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় সাড়ে ৫ হাজার টাকা) দিয়ে ১০ দিনের আনলিমিটেড ইন্টারনেট কিনে নিলাম। শুধু ইন্টারনেট, নো ফোন কল, নো টেক্সট। সমস্যা নাই- ম্যাসেঞ্জার, ভাইবার, হোয়াটস আপ থাকলেই হয়। এখন হোটেলে যাবার পালা।

এর আগে কলম্বো, ব্যাংকক, কাঠমান্ডু, জয়পুর, কলকাতা নেমেই ডেলিগেটরা যেরকম আদরযত্ন করেছিল, তাতে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল খাতির যত্ন পাওয়ার। তারপরও এবার সবচেয়ে বেশি দামে, মানে সাড়ে চারশো ডলারের রেজিস্ট্রেশন ফী দিয়ে কনফারেন্সে যাওয়া বাংলাদেশের প্রায় একশো স্থপতির মধ্যে ৩৫ জন এসেছেন এই ফ্লাইটে। এরা ৪-৫টা হোটেলে থাকবে।

হোটেল কামরা থেকে দেখা প্রথম সকালের টোকিও

আমি এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়ে দেখি একটা বেঞ্চির মধ্যে শুকনো মুখে বসে আছেন আমাদের দলনেতা, স্থপতি ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট নাসির ভাই, সাবেক তিন বারের প্রেসিডেন্ট মোবাশ্বের ভাই। তাদের নাকি আয়োজকদের দায়িত্বে হোটেলে নেবে। এই আয়োজনটা এমন যে, বাসে করে টোকিও স্টেশনে নিয়ে যাবে, সেখান  থেকে ট্যাক্সি করে হোটেলে পৌঁছাবে। বাকীদের জন্য আকা-১৮’র দুই বৃদ্ধ পরামর্শ দিয়েছেন, বাসে করে টোকিও স্টেশনে চলে যেতে, খরচ পড়বে জনপ্রতি ১০০০ ইয়েন। সেখান থেকে ৭-৮০০ ইয়েনে হোটেলে যেতে পারবে ট্যাক্সিতে ৪জন। ১২০০ ইয়েনের মধ্যে হয়ে যাবে। এটাই সবচেয়ে সস্তা।

আমাদের কেউ কেউ ট্যাক্সি খোঁজার চেষ্টা করলো। ট্যাক্সির ভাড়া নির্ধারণ করা নেই। মিটারে যা আসবে তাই। তবে কাউন্টার থেকে বলা হলো, ২৬০ ডলারের মতো ভাড়া পড়বে ট্যাক্সিতে। ভাড়ার কথা শুনে ট্যাক্সির খায়েশ মিটে গেল। জানা গেল আমাদের জন্য বুক করা হোটেলটির একটা শাটল বাস আছে এক ঘণ্টা পর, সাড়ে আটটায় সেটাতে আমরা যেতে পারি, তবে এজন্য বাস ভাড়া লাগবে জনপ্রতি ৩১০০ ইয়েন। বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২৫০০ টাকা! পাঁচতারা হোটেলেও অগ্রিম ৫ রাতের কনফার্ম বুকিং-এর পরেও ফ্রি শাটল নেই!

জাপানে ঢুকেই দেখি খালি ইয়েন আর ইয়েনের বেসাতি। বুঝে ফেলি বেশ ব্যয়বহুল একটা শহরে এসে ঢুকে পড়েছি। মাথা যখন ঢুকেই গেছে, শরীরটা আর দিতে বাকি কেন? আমরা বাসে উঠে পড়ি। ইন্টারনেট চালু হয়ে গেছে আমাদের ফোনে। গুগল ম্যাপ বলছে এখান থেকে টোকিও নিউ ওটানি হোটেল ৮৭ মাইল। যেতে সময় লাগবে ১ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট। আমাদের বাস ছুটে চলছে। আমরা খুব ক্ষুধার্থ।এমন সময় আমার ইনবক্সে একজন নক করল। নাম দাশ নিরুপম। লিখেছে: ‘Tokyo te kothay achen? Koto din thakben?’

বাসের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া স্থপতিকুলের একাংশ

আমি নামের উপর চাপ দিয়ে দেখি- এড ফ্রেন্ড। তারপর দেখি তার অবস্থান- টোকিও। আমি প্রথমেই একটা ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়ে তার কথার জবাব দেই।
: এখনো টোকিও যাই নি। পথে আছি। হোটেল ওটানিতে উঠবো। ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টোকিও আছি।
: Ami dekha korbo hotel e. .........amar number.
: টোকিও এসে হোটেল থেকে ফোন দিব। এই সিম থেকে ফোন দেয়া যায় না।
: Sure. Amr office apnar hotel er kacha kachi.
: ঠিক আছে। দেখা হবে।
: Afnara khaisoinni
: (আরে! এ দেখি সিলেটী মাতে!)  আমি লিখি: ডিনার করি নি।

বাসে এখন আলোচনা একটাই। রাতের খাবার কোথায় হবে? আমি জানাই আমার নতুন ফেইসবুক বন্ধুর কথা। পেছন থেকে আরিফ ভাই আওয়াজ দেন,  তারে দিয়া খবর লাগাও, ফার্স্ট ক্লাস একটা রেস্টুরেন্টের ঠিকানা দিতে। নেমেই খাবো আগে।
আমি নিরুপমকে বলি, আমরা খুব ক্ষুধার্থ। আমাদের হোটেলের আশেপাশে কোন হোটেলে খেতে পারি?
নিরুপম জানায়, টোকিওতে রাত ৯ টার পর কোনো রেস্টুরেন্ট খোলা থাকে না। সে জানতে চায় আমরা যা খেতে চাই তাকে জানালে সে হোটেলে নিয়ে আসবে।
নারিতাতে বলেছিল ১০টা ১৫তে এই হোটেলে নিয়ে আসবে। বাস থেকে নেমেই দেখি- ১০টা ১৬ বাজে।
এই হলো জাপান!

হোটেলের কামরা থেকে দেখা টোকিওর প্রথম দৃশ্য

এস্কেলেটর দিয়ে উপরে উঠে রিসিপশন লাউঞ্জ। সে এলাহি কারবার! আমি একটা সোফায় ক্লান্ত হয়ে বসি। আমার পাসপোর্ট নিয়ে যাওয়া হয়েছে হোটেল রিসিপশনের কাউন্টারে। মজার মজার এক্সেন্টে ইংরেজি বলা হচ্ছে, আমি শুনছি। এর মধ্যে দেখি এক যুবা এসে আমার পাশে দাঁড়াল। তার হাতে ৮ প্যাকেট বিরিয়ানী। আমি অবাক বিস্ময়ের সাথে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। মানি ব্যাগে হাত দেই। নিরুপম দুই হাত জোড় করে আমাকে দেখায়। আমি বুঝে ফেলি। এটা সিলেটী বিষয়-আশয়। এখানে এভাবে দিতে চাওয়া আপ্যায়কের জন্য অপমানের। নিরুপমের সঙ্গে দলের লোকজনের পরিচয় হয়। সে বলে, আপনারা এখন ক্লান্ত। কাল সাড়ে পাঁচটা থেকে আমি ফ্রি আছি। আমাকে ফোন করলেই চলে আসবো। নিরুপম চলে যায়। আমরা রুমে যাবার জন্য লিফট খুঁজি। জাপান বুঝে ওঠার অনেক কিছুই এখনও বাকী।

ওটানি বেশ নাম করা হোটেল টোকিওর। আয়তনে বেশ বড়। ৩-৪ একর জায়গা নিয়ে হবে। নেটে এই হোটেলের খবর নিয়েছি। টিকেট কেটে পর্যটক আসে এই হোটেলের আশপাশের পরিবেশ দেখতে। হোটেলটিতে সারাদিন কাটিয়ে দেয়ার মতো নানা বন্দবস্ত আছে। চারশ বছরের পুরনো জাপানি বাগান এই হোটেলের প্রাণ। স্থাপত্য কংগ্রেসের অফিশিয়াল এই হোটেল। ভাড়া কমিয়ে যা রাখা হয়েছে, তা বাংলাদেশি টাকায় রাত প্রতি ২৪ হাজার টাকা। ৫ রাতের জন্য বুক করা এই হোটেলে এসেছি আমরা বাংলাদেশি ১২ জন। অন্যরা আছে অন্য হোটেলে।

হোটেলটিতে ঢুকেই জাপানি গন্ধ পেয়ে যাই। মখমলি কার্পেট, যেনো তাজা ফুলের পাপড়ি ছিটানো। দীর্ঘ করিডোর মাড়িয়ে আরেকটা ৫৬ তলা টাওয়ারের ২৮ তলায় পড়লো আমাদের ঘর। ঘরে ঢুকেই আরিফ ভাই জানালার টানা পর্দা সরিয়ে দিলে ২৮ তলার উপর থেকে দেখা হয় টোকিও ডাউন টাউনের আকাশ রেখা। বেশ শিহরণ লাগে এটা দেখতে। কল্পকাহিনীর মতো যে জাপানের কথা এতোদিন শুনেছি বা পড়েছি, কাল থেকে তাকে বোঝার জন্য বেরিয়ে পড়বো। বাকী রাত আমাদের ঢাকাইয়া আড্ডা চলবে এই ঘরেই। কাল আমাদের টোকিওর ঘ্রাণ নেবার দিন। পরশু থেকে কংগ্রেসের সেমিনার। কাল সকালে সাড়ে আটটায় শেষ বাস ছাড়বে এই হোটেল থেকে। এই বিবেচনায় মাঝ রাতের একটু পরে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। (চলবে)

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ জুন ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়