ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ইস্তাম্বুল: নীল জলে পা ডুবিয়ে যে নগর থাকে অপেক্ষায় || সূচনা পর্ব

ফাতিমা জাহান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩০, ৯ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ইস্তাম্বুল: নীল জলে পা ডুবিয়ে যে নগর থাকে অপেক্ষায় || সূচনা পর্ব

সুলতান আহমেদ মসজিদ

|| ফাতিমা জাহান ||

ইস্তাম্বুল, যে শহরকে না দেখে কল্পনা করা যায় হাজার বার, হাজার রঙে। যে শহর শিল্প সংস্কৃতির আধার হয়ে কথা বলছে নতুন ও পুরাতনের। যে শহর আপন করে নিতে জানে, আপন ভেবে। যার জন্য ফিরে গেলেও ফিরে আসতে ইচ্ছে করে।

লম্বা ফ্লাইট ধরে এসেছি ইস্তাম্বুলে। অনলাইনে খুঁজে খুঁজে হোটেল বুক করেছি পুরনো শহরে। বিমানবন্দর থেকে বাসে পৌঁছুতে সময় লেগেছে এক ঘণ্টা। বাস থেকে যখন নামি তখন স্থানীয় সময় বিকেল আটটা; দিনের আলো ঝলমল করছে। এখানে নাকি সন্ধ্যে হয় ন’টায়। একটু খুঁজেই হোটেল পেলাম। চারদিকে গোলাপের ঝাড়ে আবৃত পুরনো বাড়িঘর, কোনোটা সিমেন্টের, কোনোটা কাঠের- এ যে দেখছি স্বপ্নপুরী!

হোটেলের চাবি আর রুম ফ্যাসিলিটি বুঝিয়ে দিতে যে ছেলেটি এলো, সে বুঝিয়ে দিতে দিতে আমি বারান্দার দরজা খুলে দাঁড়াতেই একটা ধাক্কা খেলাম। সামনেই পুরনো অতি সুন্দর একটি গির্জা বা মসজিদ। কারণ এ শহরে গির্জা, মসজিদ প্রায় একই আদলের দেখেছি। সবে সন্ধ্যা তার আলো হারাচ্ছে। হালকা সাদা আর নীল রঙা ভবন যেন রূপের পশরা সাজিয়েছে। জিজ্ঞেস করে জানলাম সেটা আঠারোশ’ শতাব্দীতে নির্মিত অর্থডক্স গির্জা। গির্জার পাশেই আরেকটি প্রাচীন ভবন খা খা করছে। এমনটিই তো চেয়েছিলাম। পুরনো শহরে হোটেল আগেভাগে বুক করেছি এ কারণেই। যেন প্রাচীন ইস্তাম্বুলের রূপ যখন ইচ্ছে তখন দেখতে পারি।
শহরের প্রধান আকর্ষণীয় স্থান সুলতান আহমেদ স্কয়ার। এখানেই বেশ কয়েকটি প্রধান ট্যুরিস্ট স্পট। আমার হোটেল থেকে হাঁটা দূরত্ব। আয়া সোফিয়া আর সুলতান আহমেদ মসজিদের মাঝে বিশাল বাগান, ফুটে রয়েছে নানা রঙের গোলাপ, ভ্রমণার্থীদের জন্য বসার জায়গা, আরেকপাশে রাস্তায় ট্রামলাইন। খুব ভোরে চলে এসেছি বলে দেখলাম সেই বাগানের বেঞ্চে বসে স্থানীয় মানুষজন চা-পান করছেন, খবরের কাগজ পড়ছেন আর কেউ বা নেহাতই আড্ডা দিচ্ছেন। একটু পরেই আর এ দৃশ্য দেখা যাবে না। তখন চত্বর মুখরিত হবে ভ্রমণার্থীদের উপস্থিতিতে।

আয়া সোফিয়া দেখার ইচ্ছে লালন করছি বহুদিন ধরে। মধ্যযুগ হতে এক হাজার বছর অবধি দাপিয়ে বেড়ানো পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ গির্জা, তারপর অটোম্যান রাজত্বের মসজিদ, আরো কত ইতিহাস আঁকা রয়েছে এই স্থাপনার গায়ের খাঁজে খাঁজে। বাইরে থেকে দেখলে ছোটখাটো মনে হলেও উচ্চতায় ৫৫ মিটার। গায়ের রং ধূসর আর গম্বুজগুলো নীল। তুরস্কের যে কোনো মসজিদ বা গির্জার নকশা প্রায় একই আকৃতির, রঙও এক। খুব সুচারুভাবে না দেখলে বোঝা যায় না কোনটা মসজিদ আর কোনটা গির্জা। পায়ে পায়ে ঢুকে পড়লাম গির্জার অন্দরমহলে। ভেতরে যা দেখব তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। আমার দেখা যে কোনো রাজপ্রাসাদকে হার মানায় গির্জার প্রধান কক্ষ। বাইজেন্টাইন শিল্পকলায় নির্মিত এ গির্জার ছাদ অবধি শুধু কারুকাজ আর নানা জাতের নকশা। প্রধান হলটির ছাদের গোলাকার প্রধান গম্বুজের কেন্দ্রবিন্দুতে আল্লাহর কালাম লেখা, তার চারপাশে নানান নকশা- যার রং নীল, হলুদ আর লাল। অন্যান্য গম্বুজেও অন্য ডিজাইনের হলুদ রঙের ওপর লাল, নীল নকশা আঁকা। ঢোকার বারান্দার ভেতরের ছাদেও একই হলুদ রঙের ভিন্ন ভিন্ন নকশা আঁকা।

ধীর পায়ে ভেতরের দিকে চললাম। গির্জাটি এত বড় যে পুরো দিন লেগে যাবে দেখে শেষ করতে। দোতলা থেকে বারান্দা ঝুলছে পুরো গির্জার ভেতরদিকে যেখান থেকে রানীরা প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করতেন। সেও হবে চৌদ্দ পনেরশ’ বছর আগেকার কথা। বারান্দার রেলিং আর থামের পাথরে খোদাই করা রয়েছে নানান নকশা। শ্রেষ্ঠ গির্জার উপাধি যে পায় তার সব কিছুই হবে রাজকীয়। ছাদ থেকে ঝুলছে বেশ কয়েকটি ঝাড়বাতি যা পুরো গির্জাকে কোমল কমলা আলোয় উজ্জীবিত করে আমাদের মতো সাধারণ ভ্রমণার্থীদের বিস্ময়ের পরিধি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সেকালে ঝাড়বাতিগুলো নাকি সোনা আর নানা মূল্যবান হীরে জহরতে আবৃত ছিল।

আয়া সোফিয়ার ভেতরের কারুকাজ 

গির্জা সংস্কারের কাজ চলছে তাই প্রধান প্রার্থনা কক্ষের অর্ধেকটা ঢাকা। যতখানি পারা যায় দেখার চেষ্টা করেছি। আরো খানিকটা এগিয়েই অটোম্যান আমলের মিহরাব চোখে পড়ল। সম্ভবত গির্জার সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান ভ্রমণার্থীদের কাছে। বেশ ভিড় দেখলাম। আমি ভিড়ের মাঝে অস্বস্তি বোধ করি। এক কোনায় দাঁড়িয়ে পড়লাম। চোখ জুড়ানো এমন মিহরাব আগে কখনো দেখিনি। মিহরাবজুড়ে সোনালি রঙের কারুকাজ। মাথার ওপর কোরআনের আয়াত লেখা। যেন আয়া সোফিয়ার সোনার মুকুট পরে মধ্যমণি হয়ে বসে আছে মিহরাব। মিহরাবের পেছনের দেয়ালজুড়ে রঙিন কাচের নকশায় জানান দিচ্ছে কৌতূহলী জানালা। সে আমলে কাচের ওপর আঁকা নকশা খুব বিখ্যাত ছিল, আর সর্ববৃহৎ গির্জার জানালা তো হবে সবচেয়ে সুন্দর। জানালার ওপরের লাইনে লেখা কোরআনের আয়াত নীল জমিনে। মিহরাবের ডানপাশে মিম্বারেও মিহরাবের মতো কারুকাজখচিত। দেয়ালের রং ধূসর। মাথার ওপরে ছাদের কাছাকাছি স্থানে একপাশে বড় করে গোলাকারে লেখা ‘আল্লাহু’, অন্যপাশে ‘মুহাম্মাদ’ আর ঠিক তার মাঝখানে মা মেরীর ছবি; শিশু যিশুখ্রিষ্টকে কোলে নিয়ে শান্তভাবে বসে আছেন। এমন সাম্যের ছবি তুরস্ক ছাড়া আর কোথায় দেখা যাবে!

একই উচ্চতায় উল্টোপাশে একই আকারে চার খলিফার নাম লেখা, একই তার রং সবুজের ওপর সোনালি কারুকাজ। যে শিল্পীর নিপুণ ছোঁয়ায় আরবি অক্ষরগুলো অমর হয়ে আছে তার নাম কাদিয়েস্কের মুস্তাফা ইযযেত ঈফেনদি। এই ক্যালিগ্রাফিগুলো আজ অবধি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ আরবি ক্যালিগ্রাফি হিসেবে ইতিহাসের ধারা অব্যাহত রেখেছে। অভিজাত মিহরাবকে বিদায় জানিয়ে চললাম আরো বিস্ময়ের খোঁজে। খানিক এগিয়ে মূল ভবনেই কয়েকটি সমাধি চোখে পড়ল যা সোনালি কারুকাজমণ্ডিত লোহার দরজা দিয়ে ঘেরা। মূল সমাধিটি সুলতান মুস্তাফা (১) এর। তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ১৬৩৯ খ্রিষ্টাব্দে। আর গির্জার ব্যাপ্টিজমের জায়গায় সমাহিত আছেন সুলতান ইব্রাহিম, মৃত্যু সাল ১৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দ। এছাড়া মূল ভবনে আর কোনো সুলতানের সমাধি নেই। গির্জার বাইরে অত্যন্ত মনোরম স্থাপত্যকলায় নির্মিত কয়েকটি সমাধি রয়েছে কয়েকজন সুলতানের।

এবার চলে গেলাম গির্জার নিচতলার বাঁ পাশে। সেদিকটায় মর্মর পাথরের তৈরি, লম্বায় আমার মতো তিনজন মানুষের সমান বিশালাকৃতির পানির পাত্র রাখা আছে। পাত্রটি একপ্রস্ত পাথরে নির্মিত। সেখান থেকে খানিক এগুলেই আরেকটি প্যাসেজ যার ভেতরের অংশে জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ। দ্বাররক্ষী তাড়িয়ে না দিলে ভেতরে ঢুকে দেখে নিতাম কি এমন স্থান যেখানে প্রবেশ নিষেধ। সেখান থেকে এগিয়ে গেলে হাতের ডানপাশে সিঁড়ি দোতলায় যাবার। এ গির্জার অনেক কিছু বদলানো হয়েছে কিন্তু সিঁড়ি রয়েছে সেই নির্মাণ কালের অবয়ব ধরে। পাথর সিমেন্টের সাথে গেঁথে রাখা হয়েছে। সিঁড়ি নেমেছে ঢালু হয়ে। এতে কোনো ধাপ নেই। সিঁড়ি বলাও ঠিক হবে না এক ধরনের স্লোপ বা ঢাল। সিঁড়ি দেখে সতেরোশ’ সাল পেছনে চলে গেলাম ভাবনায়। কেমন ছিল সেসময়কার নির্মাণ কৌশল আর অভিজ্ঞতা? 

আয়া সোফিয়া গির্জা মোট তিনবার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল রোমান সম্রাটদের শাসনামলে বিভিন্ন সময়ে একই স্থানে।

প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন সম্রাট কন্সট্যানটিওন ৩৬০ খ্রিষ্টাব্দে। গির্জার নাম তখন রাখা হয়েছিল ‘বিগ চার্চ’ বা ‘বড় গির্জা’।

আয়া সোফিয়া 

তখন থেকেই এ গির্জা উপাসনা ও সকল বড় বড় রাজকীয় অনুষ্ঠানের প্রাণকেন্দ্র। ৪০৪ খ্রিষ্টাব্দের দাঙ্গায় গির্জাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ৪১৫ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট থিওডোসিস গির্জাটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। ৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট জাস্টিনিয়ান শেষবারের মতো মজবুত ভিত্তিতে একই স্থানে গির্জা প্রতিষ্ঠা করেন। সেসময় স্থাপত্যবিদ ছিলেন ইসিডোরোস এবং এন্থেমিওস। এবং এর হাজার বছর পর অবধি গির্জাটির খ্যাতি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের আশ্চর্য এবং সর্ববৃহৎ গির্জা হিসেবে। বিভিন্ন স্থান থেকে দামি আর ভালো মানের পাথর আনা হয়েছিল গির্জা নির্মাণের জন্য। মর্মর পাথরের আধিক্য দেখা যায় গির্জার ১০৪টি স্তম্ভে। ভেতরের মোজাইকের চিত্রকর্ম করা হয়েছিল সোনা, রূপা, রঙিন কাচ আর পোড়ামাটি ব্যবহার করে। পাথর এবং মূল্যবান রত্নাদি আনা হয়েছিল সিরিয়া, আনাতোলিয়া, এসপেন্দোস, ইফেসোস, মিশর, আফ্রিকা ইত্যাদি স্থান হতে। সম্রাট জাস্টিনিয়ান গির্জা প্রতিষ্ঠার পর অহঙ্কার করে জেরুজালেমে সুলায়মান (আঃ) এর উপাসনালয়ের সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলেন, ‘সুলায়মান, তোমার উপাসনালয় কিছুই নয় আমারটার সামনে।’     

কথাটি নেহাতই মিথ্যে নয়। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই আয়া সোফিয়া উপাসনাসহ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান যেমন নতুন সম্রাটের অভিষেক ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করে আসছে।

১২০৪ সালে ল্যাটিন সম্রাট ইস্তাম্বুল দখল করার সাথে সাথে রোমান সম্রাট পিছু হটে। পরে ১২৬১ সালে রোমান সম্রাট ইস্তাম্বুল দখল করে নেয়। কিন্তু এর মাঝে ল্যাটিনরা আয়া সোফিয়ার সকল মূল্যবান পাথর, অর্থ লুট করে নেয়। ১৪৫৩ সালে অটোম্যান সম্রাট রোমানদের হটিয়ে তুরস্ক দখল করে নেয়। সেইসঙ্গে অবসান হয় তুরস্কে খ্রিস্টান সাম্রাজ্যের। সুলতান মেহমেত আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরিত করার ঘোষণা দেন। গির্জাকে মসজিদে রূপান্তরিত করতে কিছু সময় লাগে আর ভেতরকার নকশায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়। সব চিত্রকর্ম মুছে ফেলা হয় বা প্লাস্টার দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়। গির্জার চারপাশে চারটি মিনারাত স্থাপিত হয়। পাশে একটি মাদ্রাসা নির্মাণ করা হয়। মসজিদের ভেতরে নির্মিত হয় মিহরাব আর মিম্বার। ক্যালিগ্রাফি দিয়ে সাজানো হয় অন্দরমহল। অটোম্যান সাম্রাজ্যেও ভবনটি ইস্তাম্বুলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ হিসেবে পরিচিত ছিল।  সেসময় আয়া সোফিয়া ছিল ইস্তাম্বুলের সবচেয়ে সম্মানিত মসজিদ, ইসলামিক জ্ঞান অর্জন, আলোচনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বোচ্চ পীঠস্থান। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দ অবধি ভবনটি মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এরপর এটি বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৯৩৫ সালে কামাল আতাতুর্কের নির্দেশে ভবনটিকে মিউজিয়াম হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে ভবনটি তুরস্কে সর্বাধিক (ভবন হিসেবে) ভ্রমণার্থীর পদচারণায় ধন্য হয়।

আমি ওপরে ওঠার প্যাসেজে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। অন্যান্য ভ্রমণার্থী একের পর এক ওপরে গেল। আমি ভাবছিলাম এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে ষষ্ঠ শতাব্দীর নকশা করা প্যাসেজ দিয়ে হেঁটে যাব আর এখান দিয়ে হেঁটে যাবার সময় সম্রাট জাস্টিনিয়ান-এর কী মনে হয়েছিল সেকালে!

প্যাসেজের ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দুই পাশে যদিও বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানো ছিল তবুও তা যথেষ্ট ছিল না।  দোতলার প্যানেলের বারান্দার ছাদ জ্বলজ্বল করছে সোনালি হলুদ জমিনের ওপর লাল নীল নকশায়। দোতলা ঘুরে দেখা শুরু করলাম বাঁ দিকের বারান্দা ধরে। অশ্বখুরাকৃতি এ বারান্দার যে কোনো পাশ থেকেই গির্জার মূল হল দেখা যায়। একদম মাঝখানে রানীর বসবার স্থান, যেখান থেকে সোজা নিচে তাকালেই গির্জার মূল কক্ষ অনায়াসে চোখে পড়ে। বাঁ পাশ হয়ে ডানপাশের গ্যালারিতে প্রবেশ করলাম। এখানের দেয়ালে পরপর বেশ কয়েকটি মোজাইকে নির্মিত চিত্রকলা রয়েছে। প্রথমটির নাম দিইসিস- যিশু দাঁড়িয়ে আছেন, একপাশে মা মেরী ও অন্যপাশে জন দাঁড়িয়ে। এ চিত্রকলাটি প্রায় বিলীন হতে চলেছে। খুব ভালোভাবে খেয়াল করলে মেরী ও জনকে দেখা যায় যিশুখ্রিষ্টের দুই পাশে। এরপর মার্বেল পাথরের তৈরি বিশালাকায় দরজা। এরপরেও বেশ কয়েকটি মোজাইক চিত্রকর্ম রয়েছে যার প্রধান হয়ে আছেন যিশুখ্রিষ্ট বা মা মেরী। চিত্রকর্মগুলো সোনা, রূপা, মূল্যবান হীরে জহরতে খোদাইকৃত ছিল। কিন্তু এখন তার কিছুই নেই। আছে রঙিন মোজাইকে শুধু তাদের স্মৃতিচারণ। তৃতীয় তলায় যাওয়া বারণ। সংস্কার কাজ চলছে। তাই এ যাত্রায় আয়া সোফিয়া দর্শন শেষ করতে হলো।

 ব্যাসিলিকা সিস্টার্ন

আয়া সোফিয়া থেকে বের হয়ে রাস্তা পার হলেই ‘বেসিলিকা সিসটার্ন’। জলের সংকট মেটানোর জন্য সে আমলে ভূগর্ভে বিশালাকৃতির পানির রিজার্ভার নির্মাণ করা হতো। আর এই জলাধারটি ইস্তাম্বুলের সবচেয়ে বড় রিজার্ভার। আরো শ’খানেক সিস্টার্ন গোটা ইস্তাম্বুলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সম্রাট জাস্টিনিয়ানোর নির্দেশে প্রায় ৭ হাজার শ্রমিকের অংশগ্রহণে ষষ্ঠ শতাব্দীতে রিজার্ভারটি নির্মাণ করা হয়। সিস্টার্নে ঢুকতে হল ৫২টি সিঁড়ি পেরিয়ে নিচে যেতে হয়। নিচে তো ঘুটঘুটে অন্ধকার, অন্য ভ্রমণার্থী না থাকলে ভূতের বাড়ি বলে ভ্রম হতো। কয়েক সেকেন্ড পর চোখ অন্ধকার সয়ে নেবার পর আস্তে আস্তে মনে হলো ভেতরে কিছু আলো তো আছে দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে। মার্বেল পাথরের তৈরি ৩৬২টি স্তম্ভ সিস্টার্নের ভীত মজবুত করে আজও দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা প্যাসেজটি পার হতে হতে মনে হলো এটি জলাধার না হয়ে যদি গোপন কোনো দুর্গ হতো বা সুরঙ্গ! জল আছে তবে অল্প, আগে নিশ্চয়ই ভরা ছিল কানায় কানায়। আর আমি এখনো ষষ্ঠ শতাব্দীর ঘোরে ডুবে আছি। শেষ মাথায় দুটি স্তম্ভের গোড়ায় দেবী মেডুসার মাথা খোদাই করা রয়েছে। এর পাশে ‘ক্রায়িং কলাম’ নামে একটি স্তম্ভ। স্তম্ভটি নাকি সবসময় জলে সিক্ত থাকে। ইতিহাস বলে সিস্টার্ন তৈরির সময় নিহত শ্রমিকদের কথা স্মরণ করে নাকি স্তম্ভটি কাঁদে সারাবেলা। কাছে গিয়ে ছুঁয়ে দেখলাম। আসলেই স্তম্ভটি ভেজা। এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই আছে। নাই বা জানলাম তা। কিছু ব্যাপার থাকুক না অজানা।

ব্যাসিলিকা সিস্টার্ন দেখে বের হয়ে মোলাকাত হলো দিনের আলোর সাথে। ভুলেই গিয়েছিলাম যে দুপুর হতে চলেছে। আসলে অন্ধকারে থাকলে সেখানকার মানুষকে অন্ধত্ব জেঁকে ধরে। হাতের কাছেই সুলতান আহমেদ মসজিদ। সেদিকে হাঁটা দিলাম। রাস্তা পার হলেই কয়েকটা স্যুভেনিয়রের দোকান, পাশে একটা ফুল বাগান। তারপর পার হলাম আরেকটা গোলাপ বাগান। এত ফুল চারিদিকে! আমি কি তবে এলিসের ওয়ান্ডারল্যান্ডে চলে এসেছি? না তো, আমি তো এসেছি সুলতান আহমেদ মসজিদের পায়ের কাছে। তাকে শ্রদ্ধা জানাতে। সুলতান আহমেদ মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন অটোম্যান বাদশাহ সুলতান আহমেদ (১)। প্রতিষ্ঠাকাল ১৬০৯- ১৬১৭ খ্রিষ্টাব্দ। মসজিদটিকে ব্লু মস্ক বা নীলাভ মসজিদও বলা হয়ে থাকে। কারণ এর প্রতিটি গম্বুজ নীল রং করা আর ভেতরের টাইলসে নীল রঙের প্রাধান্য। রাতের বেলা চারদিক থেকে নীল আলোর ফোয়ারা ছোটে অবশ্য সে আলো কৃত্রিম, বাইরের বৈদ্যুতিক আলো।

প্রত্যেক অটোম্যান বাদশাহ্‌কেই যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকতে হতো ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য। আর প্রত্যেকে নিজের ক্ষমতা ও জৌলুশ প্রদর্শনের জন্য একটি হলেও বিশালায়তনের মসজিদ নির্মাণ করে গেছেন। যিতভাতোরোক চুক্তির (পনেরো বছর দীর্ঘ অটোম্যান ও আস্ট্রিয় রাজার যুদ্ধ) পর সুলতান আহমেদ (১) নিজের নামে ইস্তাম্বুলে মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। সেসময় তার হাতে যথেষ্ট অর্থ ছিল না মসজিদ নির্মাণের জন্য। সেজন্য রাজকীয় খাজাঞ্চি থেকে অর্থ উত্তোলন করা হয়েছিল। ঐতিহাসিক আয়া সোফিয়ার পাশে অনেকখানি জায়গাজুড়ে মসজিদ নির্মাণের স্থান নির্বাচিত হয়। সেসময় আয়া সোফিয়া ছিল ইস্তাম্বুলের সবচেয়ে সম্মানিত মসজিদ, ইসলামিক জ্ঞান অর্জন, আলোচনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বোচ্চ পীঠস্থান। আয়া সোফিয়াকে টপকে সুলতান যে তার পাশেই আরেকটি মসজিদ নির্মাণ করতে যাচ্ছেন এতে তদানীন্তন ওলামাগণ নাখোশ ছিলেন।

সুলতান আহমেদ মসজিদ নির্মাণ করতে সময় লেগেছিল প্রায় আট বছর। আয়তনে এবং সীমানায় ইস্তাম্বুলের যে কোনো মসজিদের চেয়ে বড়। আকাশ সীমানার অনেকখানি অংশ সুলতান আহমেদ মসজিদের দখলে চলে যাওয়া আর বাইজেন্টাইন রাজকীয় প্রাসাদের দক্ষিণাংশের জায়গার অনেকখানি জুড়ে থাকা মসজিদটি যা সেসময়ে অনেকেরই ছিল না পছন্দের।

বসফরাসের তীর ছোঁয়া সুলতান আহমেদ মসজিদে রয়েছে পাঁচটি প্রধান গম্বুজ, ছয়টি মিনারাত এবং আটটি মাঝারি আকারের গম্বুজ। স্থাপত্য কৌশল অনুসরণ করা হয়েছে বিগত দুইশ’ বছরের অটোম্যান ক্লাসিকাল, ইসলামিক নকশার আদলে এবং কিছুটা পার্শ্ববর্তী আয়া সোফিয়ার অনুকরণে। আর এই মসজিদটিই ছিল ক্লাসিকাল আদলে নির্মিত শেষ মসজিদ। স্থাপত্যবিদ ছিলেন সেদেফকার মেহমেত আগা।

সুলতান আহমেদ মসজিদের ভেতরের কারুকাজ

প্রবেশপথের দরজায় মাথার ওপরে খোদাই করা আছে কুরআনের আয়াত। ক্লাসিকাল ধাঁচের মসজিদগুলো যেমন বড় তেমনি তার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মাঝখানে একটি বিশাল উঠোন, উঠোনের মাঝখানে পানির ফোয়ারা। মসজিদের ভেতরের উপরাংশ সাজানো রয়েছে বিশ হাজার সিরামিক টাইলস দিয়ে, যার ওপর টিউলিপ ফুলের নকশা করা। তার নিচে ২৬০টি রঙিন কাচের জানালা। হাতে আঁকা কাচগুলো সুলতান উপহার পেয়েছিলেন ভেনিসের রানীর কাছ থেকে। কাচের রঙের কারণে মসজিদের ভেতরাংশ আরো উজ্জ্বল দেখায়। মসজিদের থামগুলো মর্মর পাথরের তৈরি। ভেতরের ছাদ গম্বুজের সাথে তাল মিলিয়ে ভেতর থেকে দেখতে গোলাকার। ছাদে সুচারু নকশা করা লাল, নীল, সবুজ, খয়েরী, সোনালি রং ব্যবহার করা হয়েছে। রঙগুলো অটোম্যান সময়কার চিত্রকলার মূল বৈশিষ্ট্য। মাঝখানে গোল করে কুরআন শরীফের আয়াত ক্যালিগ্রাফি করা, যা করেছিলেন সে সময়কার বিশিষ্ট শিল্পী সাইয়েদ কাসিম গুবারি। আর সে আয়াতকে কেন্দ্র করে চারপাশে ফুলের নকশা। মসজিদের মিহরাব পুরোটাই মর্মর পাথরের তৈরি। মিহরাবের সবচেয়ে ওপরে ফুল, লতা-পাতা খোদাই করা নকশা, তার একটু নিচে সবুজ রঙের ওপর সোনালি হরফে আল্লাহ্‌র কালাম লেখা। ঠিক তার নিচেই ঈমাম সাহেবের দাঁড়াবার স্থান, তাও রাজকীয় খোদাই করা, সোনালি রঙে ঢাকা। যেন কেউ সোনা দিয়ে মুড়ে দিয়েছে মিহরাবটি। মিহরাবের দু'পাশে রঙিন কাচের জানালা, বাহারী তার রং আর নিখুঁত নকশা। সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার কাছাকাছি, মানে মসজিদের নিচের অংশ আর আমাদের মাথার ঠিক ওপরে যে সিরামিক টাইলসগুলো মসজিদের দেয়ালে স্থাপন করা হয়েছে তার রং নীল আর সমুদ্রাভ সবুজ। সেগুলোও নিপুণ শিল্পীদের গুণী হাতের ছোঁয়ায় এখনো জ্বলজ্বল করছে আর জানান দিচ্ছে দেয়ালের অংশ হয়ে। প্রতিটি গম্বুজের কেন্দ্রবিন্দু থেকে ঝুলে আছে বিশালাকৃতির ঝাড়বাতি।

দরজার কথা আর কি বলব! কাঠের ওপর মাদার অফ পার্ল দিয়ে খোদাই করা একেকটা বিশালায়তনের দরজা। অবশ্য খুব ভালোভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। দেখে বোঝার উপায় নেই যে এরা কয়েকশ বছর ধরে প্রার্থনায় রত। মসজিদের কার্পেটের রং টকটকে লাল, নামাজী ধারণ ক্ষমতা দশ হাজার। নারীদের জন্য আলাদা স্থান রয়েছে নামাজ পড়ার। স্থানটি খাজকাটা কাঠের দেয়াল দিয়ে আবৃত। মসজিদের পাশেই মাদ্রাসা। মসজিদ প্রাঙ্গনের বড় একটা অংশে দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধ যা আগে সুলতানের নিজস্ব প্রার্থনার স্থান ছিল। মসজিদের ভেতর অমুসলিম নারীপুরুষ প্রবেশে বাধা নেই। নারীদের মাথা, পা ঢেকে যেতে হয়। মাথা, পা ঢাকার জন্য প্রবেশদ্বারেই রাখা আছে স্কার্ফ আর লম্বা স্কার্ট। নামাজের সময় নামাজি ছাড়া অন্য কারো নামাজের কাতারের সামনের দিকে ঘোরাফেরা করা নিষেধ। কিছুক্ষণ মসজিদের ভেতরে ঘুরেফিরে যোহর নামাজ অবধি অপেক্ষা করলাম। যোহরের আজানের পর আশপাশের দোকান থেকে অনেক মুসল্লি আসলেন নামাজ আদায় করতে। তাঁদের সঙ্গে কিছু ট্যুরিস্ট নারীপুরুষও জড়ো হলেন পূণ্য লাভের আশায়। চারশ’ বছরের পুরনো মসজিদ আর তার রাজকীয় সাজসজ্জা একসঙ্গে বলে উঠলো- ‘আল্লাহু আকবার’। 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ আগস্ট ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়