ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

সিক্রেট ফরেস্টে দীর্ঘশ্বাস

সুমন্ত গুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৩, ২১ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সিক্রেট ফরেস্টে দীর্ঘশ্বাস

সুমন্ত গুপ্ত : আমরা আছি মেঘালয় কন্যার আশ্রয়ে; ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ছয়টা। বেশ ভালো ঠাণ্ডা লাগছে। শীত নিবারণের কাপড় গায়ে দেয়ার পরও ঠাণ্ডা যাচ্ছে না। আমরা উঠেছি শিলং শহরে পুলিশ বাজারের কাছে হোটেল সেরিনে। সকালবেলা উঠেই আমি জানালার পাশে বসেছি। আজ শিলং ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন। তাকিয়ে আছি দূর আকাশে। মনে পড়ছে অনেক কথা। নিচে মানুষের চলাচল কম, তবে ধীরে ধীরে বাড়ছে। ভালোই লাগছে দেখতে। পুলিশ বাজার আমাদের ঢাকার ফার্মগেইটের মতো। সকাল হতেই মানুষ ব্যস্ত হয়ে ওঠে যে যার কাজে। ভাবলাম নিচে নেমে একটু হেঁটে আসি। মাকে ডাকবো ভেবে আর ডাকলাম না। ঘুমিয়ে আছে থাক।

শীতের কাপড় পরে নিলাম দুই প্রস্ত যেন কাবু করতে না পারে। আমাদের অস্থায়ী ডেরা থেকে বের হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। বাইরে বের হতেই শীত জড়িয়ে ধরল। সবাই শীতের কাপড় পরে বের হয়েছে, কিন্তু আমার মতো এতো মোটা কাপড় কেউ পরেনি। সম্ভবত এটি অভ্যস্ততার ফল। প্রাকৃতিক এই আবহাওয়া অঞ্চলের মানুষের সয়ে গেছে, ফলে তাদের হয়তো এতো ঠাণ্ডা লাগে না। আমি পুলিশ বাজারের এক প্রান্ত থেকে হাঁটা শুরু করলাম। ইচ্ছা শেষ পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে আবার ফিরে আসবো। ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল সাতটা। অথচ এলাকাজুড়ে মানুষের ভিড় লেগে গেছে! বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে বসেছে বিক্রেতারা। হরেক রকমের পণ্য সামগ্রী- শীতের কাপড়, জুতা, খাবার সামগ্রী, ভোগ্য পণ্য- কি নেই বলা কঠিন। উপজাতি সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের খাবার নিয়ে বসেছে। খাবারের দোকানগুলোতে লাইন দিয়ে মানুষ খাবার কিনে খাচ্ছে। সবাই সকালের নাস্তা করছে দেখে আমারও পেটে রাম রাবণের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল- কি আর করা- পেটের যুদ্ধ থামানোর জন্য ভাবছিলাম কোথায় ঢুঁ দেয়া যায়। প্রায় সব দোকানেই ভিড় লেগে আছে।

শেষমেশ পুলিশ বাজারের শেষে অবস্থিত বাঙালি হোটেল সুরুচিতে ঢুকে পড়লাম। সেখানেও লোকে লোকারণ্য। কোনোমতে জায়গা করে নিলাম। লুচি আর আলুর দম নিলাম- অসাধারণ স্বাদ! হিং-এর গন্ধে এক অন্য রকম রসায়ন তৈরি হয়েছে। পেট পূজা চলছে, এর মাঝে বাপ্পিদা’র ফোন- আমি হোটেলের নিচে আছি চলে আসো। আমি বললাম, আমি পুলিশ বাজারে আছি, একটু পর আসছি। দ্রুত আহার পর্ব সেরে ফিরে চললাম অস্থায়ী ডেরার দিকে। রুমে গিয়ে দেখি মা তৈরি হয়ে বসে আছে। কাল ক্ষেপণ না করে রওনা দিলাম নতুন গন্তব্য পানে।

আঁকাবাঁকা পথ ধরে আমরা এগিয়ে চলছি। আমাদের গন্তব্য কোথায় জানতে চাইলে বাপ্পিদা বললো- সিক্রেট ফরেস্ট।  মেঘালয়ের একমাত্র ফরেস্ট যেখানে বিভিন্ন প্রজাতির অর্কিড দেখা যায়। সঙ্গে আছে বিরল রুদ্রাক্ষের গাছ। বাপ্পিদা’র কথা শুনে দেখার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে উঠলো। আঁকাবাঁকা পথ পেড়িয়ে প্রায় এক ঘণ্টার মধ্যে আমারা পৌঁছে গেলাম  সিক্রেট ফরেস্টে। বাপ্পিদা বললেন, গাইড নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে হবে। না হলে রাস্তা খুঁজে বের করা কঠিন! কিন্তু আমরা পড়লাম এক জটিল সমস্যায়- সেখানে যারা গাইড আছেন তারা কেউই ইংরেজি বলতে পারেন না। আর হিন্দি যা পারেন তাও ভাঙ্গা ভাঙ্গা। তাদের নিজস্ব ভাষা আছে, যা বোঝা আমাদের জন্য দুঃসাধ্য। এরপর মুখের আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে বললাম, আমরা ভেতরে ঘুরতে যেতে চাই কতটুকু সময়ের ট্রেলার আছে। উপস্থিত মানুষের কথা শুনে বুঝলাম, এক ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট, তিন ঘণ্টার আর সাড়ে চার ঘণ্টার ট্রেলার আছে। সাথে যেহেতু মা আছেন তাই এক ঘণ্টা চল্লিশ মিনিটের ট্রেলার আমরা বেছে নিলাম। এখন কতো টাকা দিতে হবে আগেই ঠিক করে নেয়া ভালো। ঠিক হলো ৫০০ রুপি দিতে হবে। একবার ভেবেছিলাম দরদাম করবো কিন্তু তাদের ভাষাই তো বোঝা যায় না, তাই আর ঝামেলায় না গিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলাম সিক্রেট ফরেস্টের গহীনে।

সামনে বড় মাঠ পেড়িয়ে আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম। আমাদের মত অনেকেই এসেছেন ফরেস্টে ঘুরতে। বেশ কিছুটা পথ পেড়িয়ে আমরা বনে প্রবেশ করলাম। বনের ভেতরে প্রবেশের পর অন্য রকম পরিবেশ। বড় বড় গাছের ছায়ার মাঝে রোদের ঝিলিক বেশ ভালো লাগছিলো। আমরা এগিয়ে চলছি- পথি মধ্যে ঝরা পাতা কাব্যগাঁথা রচনা করছে। একদিকে গাছের ছায়া তার মাঝে শীতের ছোঁয়া- অসাধারণ! কথায় কথায় জানতে চাইলাম আমাদের গাইড সাহেবের নাম। যা বুঝলাম তা হলো মারি মং। হরেক রকমের গাছের সমারোহ, মাঝ দিয়ে আমরা চলছি এগিয়ে। আমাদের গাইড তার ভাষায় আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করছে। আমরা প্রায় কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে প্রকৃতির নিজস্ব যে ভাষা আছে, সেটুকু বুঝতে পারলে আর কী লাগে!

আমরা চলতি পথে বিভিন্ন প্রজাতির ক্যাকটাসের দেখা পেলাম। ব্যাঙের ছাতা ছিলো দৃশ্যমান হরেক রকমের। এই ব্যাঙের ছাতা আবার খুব সুস্বাদু খাবার।  দেখতে দেখতে আমরা উপস্থিত হলাম রুদ্রাক্ষ গাছের সামনে। গাছের নিচে বেশ কয়েকটা রুদ্রাক্ষ পরে রয়েছে। আমি চাইলাম রুদ্রাক্ষ সংগ্রহ করার জন্য, কিন্তু গাইড মহোদয় চোখের ভঙ্গিমায় না করলেন।  আমি নিলাম না। আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি হঠাৎ একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে গেলেন গাইড মহোদয়। তার কথায় বোঝা গেলো এই জায়গাটি তাদের প্রার্থনার জায়গা। মারি মং দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করলেন। আমরাও মৌন রইলাম। অসাধারণ পরিবেশ বনের ভেতরে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য একেবারে অন্যরকম- এ এক অন্য অনুভূতি! মারি মং আমাদের কাছে জানতে চাইলো আমরা আর সামনে যাবো না কি? আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ঠিক ঠিক এক ঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট পাড়ি দিয়ে ফেলেছি আমরা। আরো সামনে যাবো ভাবছিলাম কিন্তু মারি মং বললো, সামনে যেতে হলে আরো এক ঘণ্টা হাঁটতে হবে। তার মানে ফিরতে ফিরতে আমাদের সব মিলিয়ে তিন ঘণ্টা লেগে যাবে। মা এতো সময় হাঁটতে পারবে না। আমরা ফিরে চললাম। মং আমাদের অন্য পথ ধরে নিয়ে গেলো। আঁকাবাঁকা পথ, পথে আবার বিশাল বড় বড় গাছ পরে আছে। এই পথটি পাড়ি দিতে একটু কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু  সিক্রেট ফরেস্টের পরিবেশ সব ক্লান্তি দূর করে দিচ্ছিল। আমরা ফিরে এলাম গাড়ির কাছে। বাপ্পিদা জলের বোতল হাতে দিয়ে বললো, জল খাও, অনেক পথ হেঁটে এসেছো। বনের ভেতরে প্লাস্টিকের পণ্য নিয়ে প্রবেশ করা যায় না, তাই আর তোমাদের জলের বোতল নিতে বলিনি। আমি মনে মনে ভাবলাম ঐ অঞ্চলের লোকজন কত সচেতন পরিবেশ সুরক্ষিত রাখার জন্য। আমাদের এখানকার লোকেরা যদি এমন হতো! আমরা ফিরে চললাম পরবর্তী গন্তব্যপানে।

প্রয়োজনীয় তথ্য : শিলং যাওয়ার জন্য মেঘালয়ের ডাউকি বর্ডার সহজ মাধ্যম। সিলেটের তামাবিল বর্ডার পার হলেই ডাউকি বর্ডার। ডাউকি থেকে ট্যাক্সি পাওয়া যায়। শিলংয়ের ভাড়া নিবে ৩০০ রুপি। ট্যাক্সি নিয়ে শিলং বা আশপাশ যেতে পারবেন। ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ রুপিতে ট্যাক্সি পাবেন সারাদিনের জন্য। এক ট্যাক্সিতে ৪ জন ঘুরতে পারবেন। অথবা মেঘালয় ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন লিমিটেডের বাসেও ঘুরতে পারবেন।

থাকার জন্য শিলং পুলিশ বাজারে অনেক হোটেল আছে। হোটেলে থাকার জন্য পাসপোর্টের ফটোকপি ও ছবির প্রয়োজন হবে। ডলার ভাঙানোর জন্য পুলিশ বাজারে মানি এক্সচেঞ্জও পাবেন। ভাড়া ডবল রুম ১০০০ থেকে ৫০০০ রুপি পর্যন্ত। এ ছাড়াও কমবেশি মানের হোটেল আছে।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ আগস্ট ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়