ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ইস্তাম্বুল: নীল জলে পা ডুবিয়ে যে নগর থাকে অপেক্ষায় || ২য় পর্ব

ফাতিমা জাহান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৮, ২৮ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ইস্তাম্বুল: নীল জলে পা ডুবিয়ে যে নগর থাকে অপেক্ষায় || ২য় পর্ব

ইস্তাম্বুল, বসফরাসের নীল জলে পা ডুবিয়ে যে নগরী অপেক্ষা করে আমাদের পদচারণার। যে নগরী প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যকে আলাদা করেছে বসফরাস নদীর সীমানা দিয়ে। নদী দিয়ে যে সীমানা গড়েছে, সে সকল সীমানা ভাঙতে পারে। নদীর সীমানা যে বড়ই আশা জাগানিয়া, বড় আনন্দের সে সীমানা!

খ্রিস্টপূর্ব ৬৬০ সালে শহরটি প্রাচীণ গ্রিক নগর ‘বাইজেন্টাইন’ নামে পরিচিত হয় পৃথিবীবাসীর কাছে। অবশ্য এর ৩০ মিলেনিয়াম আগেই মানে নিওলিথিক আমলে ইস্তাম্বুল নগরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। ৩৩০ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট কন্সট্যান্টিনো শহরটি দখল করে নেন গ্রিকদের কাছ থেকে। এরপর থেকে শহরটির নতুন নামকরণ করা হয় সম্রাটের নামে ‘কন্সট্যান্টিনোপোল’। এ নামটিই ১৯২৩ সাল অবধি বহাল তবিয়তে টিকে ছিল। ষোলশ সাল ধরে এই মহান নগরী তুরস্কের রাজধানীর ভূমিকা পালন করেছে অবলীলায়, অতি নিষ্ঠার সঙ্গে। মাঝে কয়েকবার রাজ্যবদল, ভাগ্যবদল দেখে দেখে আজকের পরিণত এই নগর। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে অটোম্যান সাম্রাজ্যের দখলে যাবার আগ পর্যন্ত কন্সট্যান্টিনোপোল ছিল খ্রিস্টান ধর্মের প্রাণকেন্দ্র। মাঝে ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে নগরটি ল্যাটিনদের দখলে চলে যায়, আবার ১২৬১ সালে বাইজেন্টাইন সম্রাট কন্সট্যান্টিনোপোল নগরী দখল করেন। ১৪৫৩ সালে অটোম্যান সম্রাট সুলতান মেহমেত (২) শহরে আক্রমণ করেন এবং আট সপ্তাহ যুদ্ধকালের পর দখল করে নেন। অটোম্যান সাম্রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথে তুরস্কে ইসলাম ধর্মের প্রসার বাড়ে, পরিবর্তন হয় স্থানীয় সংস্কৃতির। প্রায় ৪৭০ বছর রাজত্ব করেন অটোম্যান সম্রাটগণ।

১৯১৯ সালে শুরু হয় তুরস্কে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ। শেষ হয় ১৯২২ সালে। ১৯২৩ সালে তুরস্ক স্বাধীন গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীতে পরিচিতি লাভ করে। আর তুরস্কের রাজধানীকে ইস্তাম্বুল থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় আঙ্কারায়। তখন থেকে ‘ইস্তাম্বুল’ নামকরণ হয় ‘কন্সট্যান্টিনোপোল’ নামটি বাতিল করে। ইস্তাম্বুল শব্দের অর্থ ‘ইসলামকে খুঁজে পাওয়া’। সুলতান আহমেদ মসজিদ থেকে বেরিয়ে ঘড়িতে দেখি প্রায় আড়াইটা বাজে। দুপুরের খাবার খাওয়া যেতে পারে গ্র্যান্ড বাজারের কাছাকাছি কোথাও।  রাস্তাটা পার হলেই ট্রাম স্টেশন। ট্রামে চেপে তিনটে স্টেশন পার হলেই গ্র্যান্ড বাজার। নিশ্চয়ই ভাবছেন এত কিছু জানলাম কী করে? কিছুটা অবশ্যই গুগল ঘেঁটে আর বাকিটা হোটেল রিসেপশনে জিজ্ঞেস করে।

ট্রামে চড়তে গেলে স্টেশনের মেশিনে কার্ড স্ক্যান করে ঢুকতে হয়। কার্ডের নাম ‘ইস্তাম্বুলকার্ট’। ট্রাম স্টেশনের সামনের বুথে লিরা ঢুকিয়ে কেনা যায়। ট্রামে চেপে আশপাশ দেখি। পথের দুইধারে কতই না বাহারি দোকানে বিক্রি হচ্ছে টার্কিশ ডিলাইট, স্যুভেনিয়র, চা, মশলা ইত্যাদি। আর পথটা যেন ইউরোপীয় কোনো পুরনো সিনেমায় খুঁজে পাওয়া স্বপ্ন।

ট্রাম থেকে নামলাম বেয়াযিত নামের স্টেশনে, নেমে বাঁ দিকের গলিতে ঢুকে পড়লাম তুরস্কের কিছু লোভনীয় খাবারের আশায়। দু’ চারটা রেস্তোরাঁ দেখে ঢুকলাম একটায়। মেন্যুকার্ড দেখে মাথা খারাপ হবার যোগাড়! এত আইটেমের মাঝে কোনটা রেখে কোনটা যে সিলেক্ট করি। আমি একজন খাদ্য বেরসিক ভ্রমণার্থী। শুধু কুকিজ খেয়ে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতে পারি। যাই হোক, সবচেয়ে সহজ এবং সাধারণ খাবার ‘কোফতে’ বা আমাদের ভাষায় কোফতার অর্ডার দিয়ে বাইরের পথঘাট দেখতে থাকলাম। সরু গলি, দুইধারে দোকান, গলি থেকে বের হলেই ট্রাম লাইন। কোফতা সাধারণত পরিবেশন করা হয় এদেশীয় পিদে বা রুটির সঙ্গে। কোফতের টুকরো মুখে দিতেই মনে হলো স্বর্গের একটি দ্বার যেন অবলীলায় খুলে গিয়েছে। এত মোলায়েম আর মসলার সঠিক সামঞ্জস্য খুব কম রেস্তোরাঁয় পেয়েছি।

খেয়েদেয়ে গ্র্যান্ড বাজারে যাবার জন্য রাস্তা পার হচ্ছিলাম, হঠাৎ মনে হলো পেছনে কে যেন আছে। ঘুরে তাকাতেই দেখি এক বিস্ময়! এ পথটা অনেকখানি খাড়া নিচে নেমে গেছে বহুদূর অবধি, আর পথের শেষে এক অপার নীল জলরাশি। জানি তুমি বসফরাস, যাকে দেখার জন্য কোনো আয়োজন করতে হয়নি। অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের মতো টিকেট কেটে ঢুকতে হয় না, তুমি এতই দয়ালু যে তোমার উদার রং সবাইকে বিলিয়ে বেড়াচ্ছো। তুমি কি জানতে আমি আসব?  কিন্তু আমি যে তোমার প্রতিক্ষায় কাটিয়েছি কয়েক সহস্র কাল অসীম আগ্রহ নিয়ে। 

বসফরাসের একটুকরো দেখে ঘুরে দাঁড়ালাম গ্র্যান্ড বাজারের দিকে। রাস্তা পার হলেই এই প্রাচীন নগরীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিপণিবিতান।             

পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এ বাজারটির বিশালাকৃতির ভবন ৬১টি আচ্ছাদিত গলিতে বিভক্ত, দোকানের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘কাপালি চারশি’। ইস্তাম্বুলে অটোম্যান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবার পরপরই রাজধানীতে একটি বাজারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সুলতান। ১৪৫৫ সালে তাই নির্মিত হয় বিশাল আকারের এই বাজার বা শপিং কমপ্লেক্স যা এখনও পৃথিবীর যে কোনো চাকচিক্যময় মার্কেটের চেয়ে মনোরম। মার্কেটে ঢুকে দিশেহারা হয়ে পড়লাম। এত সুন্দর করে সাজানো সব রঙিন দোকানপাট, কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখব। কি নেই এখানে! তুরস্কের ঐতিহ্যবাহী ল্যাম্প (যা আমাদের দেশে পাঁচগুণ দামে বিক্রি হয়, আর দেশে বসে মানুষ কেনেও পাগলের মতো। আমি দূর থেকে দেখেই খুশি) কার্পেট (এতই নরম আর মনোরম তার কারুকাজ যে এই নকশা দেখতে দেখতেই আমার তিনকাল কেটে যাবে, যেহেতু দরিদ্র ট্রাভেলার তাই কার্পেটের মতো লাখ টাকার বস্তু কেনার সাধ, সাধ্য কোনটাই নেই), চা ( তুরস্কের ঐতিহ্যবাহী চায়ের কথা কি আর বলব! এত ধরনের চা যে আছে তা তুরস্কে না আসলে জানতেই পারতাম না। একেক চায়ের স্বাদ একেকরকম; নামও ভিন্ন। শ খানেকের বেশি ভ্যারাইটির চা পান করতে তো বোধহয় আমার বছর লেগে যাবে, জোর করে দোকানি এক ধরনের হারবাল চা গছিয়ে দিল), মসলা (তুরস্কের মসলার খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। একটি মসলার দোকানে ঢুকে এদিক সেদিক ঘুরছিলাম, দোকানি আমাকে মসলা দেখাতে চাইল। আমি রাজি হতেই যেই না চামচে গুঁড়ো মসলা তুলে আমার কাছে এনেছে, সাথে সাথে- হাচ্চো হাচ্চো! আমার এলার্জির সামনে মসলা পাত্তা পেল না। হাঁচি থামছিলো না বলে ছুটে বেরোলাম মসলার দোকান থেকে। বাংলাদেশী মসলায় তো এমন হয় না। এরা বোধহয় একটু বেশিই খাঁটি জিনিস বেচে)।

সোনা, রুপার গয়না (এগুলোর আমি কিছুই বুঝি না, তাই বেশি কিছু বলার নেই, দেখতে সুন্দর, সুন্দর করে সাজানো রয়েছে শোকেসে আর দোকানিরা ডেকে ডেকে গলা শুকিয়ে ফেললেও আমি জীবনেও ভেতরে যাবো না, কারণ পকেট গড়ের মাঠ), জামাকাপড় (দোকানে যা ঝোলানো আছে যদিও দেখতে আকর্ষণীয়, তবুও তার ধারেকাছে যাওয়া যাবে না। আমি যাযাবর মানুষ, মেলা দিন ট্রাভেলের জন্য যথেষ্ট জামাকাপড় আছে, আরো কিনে এই বোঝা বাড়ানোর ইচ্ছে নেই।   এমনিতেই জামাকাপড়ের আধিক্যে আছি, আর তাকানো যাবে না- পালালাম সেখান থেকে), জুতো (জুতো দেখে আমি সারাদিন কাটিয়ে দিতে পারি। আমার জুতোর শখ। তুর্কীদের দেখেছি বাহারী জুতো পরতে। আর যত জামাকাপড়ের দোকান, ততই জুতোর দোকান। এখানকার নিজেদের তৈরি চামড়ার জুতো বেশ ভালো মান আর ডিজাইনের), সিরামিকের ওপর হাতে আঁকা শো পিস(এই বাহারী বস্তুগুলো যে এত সুন্দর তা লিখে বলা মুশকিল। রঙের খেলা আমাকে বরাবরই আকর্ষণ করে। নানা রঙের, নানা ডিজাইনে সিরামিক দিয়ে তৈরি করা হয়েছে শো পিস। কোনটা প্লেট আকারের, কোনটা বাটি, ফুলদানি ইত্যাদি। তারা যেমন ভিন্ন রঙের তেমনি ভিন্ন তাদের ডিজাইন। কেনার সাধ আছে কিন্তু বহন করার ইচ্ছা নেই), তামা কাসার শো পিস (তামা, কাসার ওপর খোদাই করা বিভিন্ন চিত্র বা আল্লাহর কালাম। এত সুন্দর নকশা আমি আর কোথাও দেখিনি), টি সেট( সিরামিক, কাসা, তামা, রুপার ওপর নকশা করা টি সেট তুরস্কে খুব বিখ্যাত। এসব কাপে চা খেলে একটা রাজকীয় ভাব চলে আসে। এই টি সেট দেখতে তো সিনেমায় দেখা আগেকার আমলের রাজা বাদশাহদের ডাইনিং টেবিলের কথা মনে পড়ে যায়), সিল্ক ( সিল্কের তৈরি স্কার্ফ আর পশমিনা চাদর যেন বাজারের মধ্যমণি)আরো অনেক অনেক হস্তশিল্প আর মনোহর জিনিসপত্র।

গ্র্যান্ড বাজারের ছাদের রং হলুদ আর তাতে নীল রঙের আধিক্যে নকশা করা। আয়া সোফিয়াতে যেমন আছে ঠিক সেরকম। পুরো গ্র্যান্ড বাজার ঘুরে দেখতে দিন পার হয়ে যাবে আর বিকেল সাড়ে ছ’টা/ সাতটার দিকে বন্ধ করে দেয়া হয় পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ এই বাজার। গ্র্যান্ড বাজার বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল আর আমিও বের হয়ে এলাম। এখনো দিনের আলো ঝলমল করছে।  বাইরের দোকানগুলো খোলা।  আমি হাঁটতে থাকলাম আমার হোটেলের দিকে। এখন খুঁজে পেলেই হয়। হোটেলের আশপাশে অনেক পুরনো স্থাপনা আছে। বিকেলটা কাজে লাগানো যাবে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকতে চাই বলে কোনো দেশ ভ্রমণ করতে গেলে আমি সে দেশে মোবাইল কানেকশন নেই না।

হোটেল খুঁজে পেতে বেশি বেগ পেতে হলো না। গ্র্যান্ড বাজার থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটা পথ। হোটেলে ঢুকে লবিতে হোটেল ম্যানেজার অভ্যর্থনা জানালেন। তার নাম ডোগান। আমি স্বভাবসুলভ রাজ্যের প্রশ্ন করতে শুরু করলাম কোথায় কী আছে, কীভাবে যাওয়া যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। লবিতে দুটো আফ্রিকান মেয়ে বসে ছিল, একজন জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি শিক্ষক?’

আমি বললাম, ‘না।’

তারা একই হোটেলে উঠেছে। আড্ডা জমে উঠল। আজ আর আশপাশে বেড়ানো হলো না। (চলবে)


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ আগস্ট ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়