ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ইস্তাম্বুল: নীল জলে পা ডুবিয়ে যে নগর থাকে অপেক্ষায় || ৪র্থ পর্ব

ফাতিমা জাহান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫১, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ইস্তাম্বুল: নীল জলে পা ডুবিয়ে যে নগর থাকে অপেক্ষায় || ৪র্থ পর্ব

সুলতানের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালাটি আপাদমস্তক ইযনিক টাইলস দিয়ে আবৃত। ঢুকতেই হাতের বাঁ পাশে প্রথম কাচের বিশাল শোকেসে লম্বালম্বিভাবে রাখা আছে হযরত দাউদ (আঃ) এর বিশালাকার তরবারি। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এখানে তাঁর তরবারি আসবে কেন? আরব দেশে তো থাকার কথা! তরবারিটি লম্বায় আমার সমান আর চওড়ায় হবে প্রায় পাঁচ ইঞ্চি।

পরের শোকেসে লম্বালম্বিভাবে রাখা আছে হযরত মূসা (আঃ) এর লাঠি। এই সেই লাঠি যা দিয়ে তিনি লোহিত সাগরকে দুই ভাগ করে দিয়েছিলেন, আর এই লাঠির আঘাতেই মরুভূমির পাথর ফেটে বয়েছে ঝরনা ধারা। আমি অবাক বিস্ময়ে দেখতে লাগলাম। ছবি তোলা নিষেধ, হাত নিশপিশ করছে কিন্তু উপায় নেই, আমি তো নিয়ম ভঙ্গ করি না। পরের কাচের বাক্সে এক সারিতে রাখা আছে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) রান্না করার পাত্র (পাত্রটি চারকোনা আকারের), হযরত ইউসুফ (আঃ) এর পাগড়ি (সাদা রঙের কাপড়ের পাগড়িটি অন্যান্য পাগড়ির চেয়ে আকারে বড়),  হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) (যিনি রাজা ছিলেন) এর সোনার তৈরী বাক্স এবং সোনার তৈরী হাতে পরার গ্লাভস।

আমার বিস্ময় যেন কাটেই না! পরের কাচের বাক্সে যা দেখলাম তাতে যে কোনো মানুষই আবেগ ধরে রাখতে পারবে না, হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর পায়ের ছাপ, যা পাথরের ওপর নেয়া হয়েছে এবং একটি সোনার বাক্সে তা রাখা আছে। আমি ঘুরে ঘুরে একই কাচের বাক্সের সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম আর এসব মহামূল্যবান জিনিসের ছবি মনে গেঁথে নেবার চেষ্টা করছিলাম। সেই কক্ষের সিকিউরিটি গার্ড শুধু আমাকে পাহাড়া দেবার মতো করে তাকিয়ে ছিলেন, যেন আমার কাছে কাচ কাটার লেজার ডিভাইস আছে, চোখের আড়াল হলেই কোনো একটা অঘটন ঘটাবোই। আর এরকম ভাববেই-বা না কেন? আমার চেয়ে বেশি সময় কোনো দর্শনার্থী সে কক্ষে ঘোরাঘুরি করছিলো না। খুবই সন্দেহজনক আচরণ! 

একই ভবনের আরেকটি কক্ষে ঢোকার আগে রাখা আছে প্রাসাদের কয়েকটি দরজা, যার বয়স প্রায় চারশ। মাদার অফ পার্ল দিয়ে খোদাই করা।

দ্বিতীয় কক্ষে ঢোকার মুখে কাচের বাক্সে রাখা আছে মহানবীর সাহাবাদের তিনটি তরবারি। পাশের কাচের বাক্সের ভেতরে আরেকটি সোনা-রুপার বাক্সের ভেতরে পরম যত্নে রাখা আছে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) পোশাক। বাক্সের ভেতরে রাখার কারণে পোশাকের ছিটেফোঁটাও দেখতে পারলাম না।

তোপকাপি প্যালেসে সুলতানের ব্যক্তিগত কক্ষ বা প্রাইভেট চেম্বার

 

পরের বিশাল কাচের শোকেসে সোনা ও বিভিন্ন হীরে জহরতে তৈরী ছোট ছোট বাক্সে ক্রমানুসারে রাখা আছে নবীজির চুল, দাড়ি ও দাঁত মোবারক। দাড়ির একাংশ ছাড়া কিছুই দেখা গেলো না। কারণ সব বাক্সের ভেতরে ছিল। সে শোকেসের সামনে ছিল সবচেয়ে বেশি ভীড়। পরের শোকেসে লম্বালম্বিভাবে শোভা পাচ্ছে ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবুবকর (রঃ) এবং দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রঃ) এর তরবারি।                    

পরের শোকেসে আড়াআড়িভাবে তিনটি তরবারি রাখা আছে। উপরেরটি ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবুবকর (রঃ) , নিচেরটি ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রঃ), এবং মাঝখানেরটি হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর। বাকি দুটি সরু লম্বা তরবারি খোলা অবস্থায় রাখা থাকলেও নবীজির তরবারিটি সোনার খাপে আবদ্ধ। তরবারিটি দেখতে কেমন ছিল জানা হলো না। পরের শোকেসে লম্বালম্বিভাবে রাখা আছে ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান (রঃ) ও ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রঃ) এর তরবারি। প্রত্যেকটি তরবারির হাতল সোনা দিয়ে বাঁধানো হয়েছে সুলতানের আমলে। তরবারিগুলোর মধ্যে হযরত আলী (রঃ) এর তরবারিটি সবচেয়ে লম্বা এবং চওড়া। একরাশ মিশ্রিত অনুভূতি নিয়ে সে কক্ষ থেকে পরের কক্ষে গেলাম। সেখানে নবীজির পানি পানের পাত্র রাখা আছে। সাধারণ ইস্পাতের পাত্রে আরবী খোদাই করা,  আকারে আমাদের দেশের মাঝারি সাইজের তরকারির বাটির মতো, গ্লাসের আকার নয়।

পরবর্তী বিস্ময় ইসলামের প্রথম লিপিবদ্ধ কোরআন শরিফ হযরত ওসমান (রহঃ) এর আমলের। হাতে লেখা এই কোরআন শরীফের একটি শব্দেরও পাঠোদ্ধার করতে পারলাম না। কারণ তা লেখা ছিল যবর যের পেশ ছাড়া। পরের শোকেসে রাখা আছে হযরত ফাতিমা (রহঃ) এর পোশাক। ফুলহাতা আলখাল্লা ধরনের পোশাকের রঙ ঘিয়ে, আকারে বৃহৎ। সে আমলে মানুষজন আমাদের চেয়ে লম্বা ছিলেন। পরের শোকেসে আছে হযরত ফাতিমা আঃ এর পুত্র হযরত হোসেন (রহঃ) এর পোশাক। সে পোশাকটিও আলখাল্লা ধরনের, হাফহাতা, রঙ ফিকে হয়ে যাওয়া সাদা। এ সবই অটোম্যান আমলে আরব দেশসমূহ যখন সুলতানদের অধীনে ছিল তখন সেসব দেশ থেকে সংগ্রহ করা।

তোপকাপি প্যালেস দেখা প্রায় শেষ। এবার চতুর্থ প্রাঙ্গন দেখার পালা। এই প্রাঙ্গনে সুলতানের ব্যক্তিগত ভবন আছে যাতে সকল সুযোগ সুবিধা উপলব্ধ। সুলতান এখানে আরো নির্জনতায় থাকতে পারতেন। তার পাশেই রমজান মাসে সকলে মিলে ইফতার করার জন্য নির্মিত ভবন। ভবনটির ছাদ ও জানালার গ্রিলে সোনার গিল্ড করা। পাশের ভবনটির ছাদ থেকে বসফরাস সোজাসুজি দেখা যায়, সুলতানের অবকাশ যাপনের ঠিকানা। তোপকাপি প্যালেস দেখা শেষ হতে হতে বাজলো বেলা তিনটে। ভোজন বেরসিক বলে যে না খেয়ে থাকব তা তো নয়। প্যালেসে ঢুকেছি যে পথ দিয়ে, বেরও হতে হবে সেই একই পথ দিয়ে। ফেরার পথে সবগুলো ভবন আবার দেখতে দেখতে বের হলাম।

সুলতান আহমেদ স্কয়ার হলো এ স্থানের প্রাণকেন্দ্র। তোপকাপি প্যালেস, আয়া সোফিয়া, ব্যাসিলিকা সিস্টার্ন, সুলতান আহমেদ মসজিদ সবই পাশাপাশি অবস্থিত সুলতান আহমেদ স্কয়ারে। এ স্থানে কয়েকজন সুলতানের সমাধিও রয়েছে।  এত কাছেই যখন, তখন সমাধি দেখে তারপর অন্যদিকে যাই। আর যে কোনো দেশে যে কারো সমাধি দর্শনে আমার অগাধ আগ্রহ। সমাধি ভবনের মধ্যমণি হয়ে রয়েছে সুলতান আহমেদ (১) (১৫৯০-১৬১৭)। ক্ষণজন্মা এ সুলতান ছিলেন ইসলামের ২৭তম খলিফা। বিরল প্রতিভার এ সুলতান ছিলেন কবি, চিত্রশিল্পী, সমাজ পরিবর্তক। অল্প বয়স থেকেই তার কবিতা লেখা, বিভিন্ন ভাষা রপ্ত করা, ছবি আকার ঝোঁক ছিল। তবে ইসলামে যেহেতু প্রাণীর ছবি আঁকা নিষেধ তাই তার পিতা বেশ অসন্তুষ্ট ছিলেন এতে। সুলতানের জীবনে এসেছে নানা মোড়। পিতা শাহজাদা মেহমেত সানজাক প্রদেশের গভর্নর ছিলেন। দাদা সুলতান মুরাদ (৩) এর মৃত্যুর পর বাবা মেহমেত ক্ষমতা দখল করেন সুলতান মেহমেত (৩) হিসেবে। ক্ষমতা দখল ও টিকে থাকার জন্য বাবা হত্যা করেন তার উনিশ জন ভাই ও সৎ ভাইকে। ক্ষমতা লাভের জন্য রক্তের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। কয়েক মাস পর সুলতান মেহমেত (৩) নিহত হন, তখন সুলতান আহমেতের বয়স মাত্র তের।  দাদী শেফিয়া সুলতানের ব্যক্তিগত ইচ্ছা ও প্রভাবে তেরো বছর বয়সে আহমেতকে নির্বাচিত করা হয় অটোম্যান সাম্রাজ্যের পরবর্তী সুলতান হিসেবে। সুলতান আহমেতের যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল অটোম্যান সাম্রাজ্যে হানাহানির ক্ষমতা দখল বন্ধ করা এবং তিনি তা করেও দেখিয়েছিলেন তার আমলে। তবে তার মৃত্যুর পর তার পুত্ররা ক্ষমতা দখল করেন একে অপরকে হত্যা করে। নিজের সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য পার্শ্ববর্তী রাজ্যের সাথে যুদ্ধবিগ্রহে অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দেন তিনি।

তোপকাপি প্যালেসের মিউজিয়াম

 

উদার মানসিকতা ও অসাধারণ প্রতিভাবান এই সুলতান নির্মাণ করেছেন সুলতান আহমেদ মসজিদ। আর মাত্র ২৭ বছর বয়সে তার মৃত্যু ঘটেছিল টাইফাস জ্বরে। মৃত্যুকালে তিনি দু'জন স্ত্রী, নয়জন পুত্র ও ছয়জন কন্যা রেখে গিয়েছেন। তার স্ত্রী, পুত্র ও কন্যাদের কবর একই ভবনে রয়েছে। অল্প কয়েকজনের সমাধি অবশ্য আয়া সোফিয়াতে আছে। তার তিনজন পুত্র ওসমান (২), মুরাদ (৪) ও ইব্রাহীম ক্রমানুসারে পরবর্তী সুলতান নির্বাচিত হয়েছিলেন। সমাধি ভবনের মাঝখানে আকারে সবচেয়ে উঁচু কবরটি সুলতান আহমেত (১) এর। তার দুপাশে স্ত্রী পুত্রদের সমাধি। পেছনে সারিবদ্ধভাবে বাকি পুত্র, কন্যা ও নাতি নাতনিদের সমাধি। কয়েকটা ছোট আকারের সমাধিও দেখলাম, বাচ্চাদের। সমাধি ভবনটির ভেতরের ছাদ সুলতান আহমেদ মসজিদের মতই কারুকাজ খচিত ও দেয়াল একই টাইলস দিয়ে আবৃত। সমাধিভবনের ভেতরে নারীদের পা এবং মাথা ঢেকে প্রবেশ করতে হয়। সাথে বাড়তি কাপড় না থাকলে প্রবেশদ্বারে তার ব্যবস্থা আছে।

বেলা বাজে সাড়ে চারটা, এখন রেস্তোরাঁয় না ঢুকলেই নয়। রাস্তা পার হলে হরেক খাবারের দোকান। যে কোনো দেশে আমি স্থানীয় খাবারের ভক্ত সে কাঁচা বা অদ্ভুত মসলাদার খাবার হোক না কেন। আগে চেখে দেখা যাক জিনিসটা কি, পরে যা হবার হবে। রেস্তোরাঁর সবচেয়ে সোজাসাপটা খাবার অর্ডার করলাম পিলাও বা আমাদের দেশের পোলাও। খেতে একেবারেই ভিন্ন, এরা যে চাল ব্যবহার করে তাও ভিন্ন। মোটা শক্ত চাল আর তাতে বাটার/ মাখন ঝরে ঝরে পরছে। সাথে নিয়েছিলাম চিকেন কারি। চিকেন কারি খেতে সুস্বাদু। আমাদের কাছাকাছি মসলার ব্যবহার, তবে অল্প মসলা ব্যবহার হয় আমাদের তুলনায়। চিকেন কারিতে আলুর সাথে গাজর, টমেটো দেয়া আছে। রেটিং করলে দশে আট দেয়া যায়। পোলাও এর রেটিং না করাই ভালো। কারণ এ দেশে এই খাবারের স্বাদ বোধহয় এমনই। (চলবে)


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়