ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

মেঘের দেশে ক্লান্তি শেষে: দ্বিতীয় পর্ব

আঁখি সিদ্দিকা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১৫, ৯ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মেঘের দেশে ক্লান্তি শেষে: দ্বিতীয় পর্ব

আমাদের গাড়ি ছেড়েছিল সাড়ে দশটায়। আমরা শিলং পৌঁছলাম দেড়টার একটু পরে। শিলং শহরের প্রাণকেন্দ্র বলা যেতে পারে পুলিশবাজার- এখানে প্রচুর হোটেল আছে।  ব্যাংক, বাজার, ট্রাডিশনাল বাড়ি, সব ধরনের খাবারের হোটেল এমনকি একটু পরপর বার, হ্যান্ডক্রাফটের বিশাল সমাহার।  পুলিশ বাজার নয় কেবল, শিলংয়ের সবচেয়ে যে বড় বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ল তা হলো- সব দোকান, ব্যবসা-বাণিজ্য এমনকি তেলের পাম্পগুলি চালাচ্ছে নারীরা। দলবেঁধে হাতে হাত ধরে তারা চলেন পাহাড়ি পথে।  তাদের সহযোগিতা করেন পুরুষ বন্ধুরা।

চেরাপুঞ্জী: বৃষ্টিখ্যাত চেরাপুঞ্জীর নাম তো ছোটবেলায় পড়েছি।  এই প্রথম তার সৌর্ন্দয্যে মুগ্ধ হতে এসেছি।  নিরাশ তো করেইনি বরং মন ভরিয়ে দিল চেরাপুঞ্জী।  শিলং থেকে যে রোড ডাউকির দিকে চলে এসেছে সেই রোড ধরে চেরাপুঞ্জী আসতে হয়।  চেরার দিকে আসার পথে একটা স্টপ অভার-চেরা ব্রিজে আমাদের গাড়ি থামানো হলো- দৃষ্টিনন্দন উপত্যকা! নিচে বড় খাঁদের মতো জায়গার দু’কুলজুড়ে উঁচু হয়ে ওঠা সবুজ।  স্যার বললেন, তোমরা নামো, আমি আর আঁখি এখানেই থাকি।  নামা হয়তো সহজ হবে, ওঠা নয়। দাঁড়িয়ে পড়লাম, কিন্তু মন উসখুশ করছে।  স্যার অন্যদিকে তাকাতেই নেমে পড়লাম। মাঝ বরাবর নামতেই স্যার দেখে বললেন- কি হে! আমি ইশারায় স্যারকেও নামতে বললাম।  সবাই ছবিতে বন্দী হচ্ছে।  আমি এক কর্নারে দাঁড়াতেই দেখতে পেলাম, দু’কুলের সবুজ উচুঁ হয়ে মিলেছে একই প্রান্তে।  চোখ ফেটে জল এলো- এতো সুন্দর হয় প্রকৃতি! সবুজ এতো সবুজ হয়! সবাই ভেবেছিল আমার কষ্ট হয়েছে নামতে তাই কাঁদছি। স্যার বললেন ওকে কাঁদতে দাও।  ও শুদ্ধতা লাভ করছে।  শুধু মনে হচ্ছিল- কত পূণ‌্য আমার, আমি এর সৌর্ন্দয্যের কাছে কত নগন্য! ফেরার পথে চেরার এই ব্রিজের পাড়ে দাঁড়িয়ে বর্ষায় ভেজা যেন ছিল বাড়তি পাওনা।

মাওক্ডক্ভ্যালি: এখানে পাহাড়ের গা বেয়ে সিঁড়ি বেয়ে বেশ কিছুটা নামতে হয়। নিচে নেমে রেলিং দিয়ে ঘেরা একটা চওড়া প্ল্যাটফর্ম আছে।  সেখান থেকে দু'পাশের পাহাড়ের মাঝের জায়গাটা খুব সুন্দর! এছাড়া সিঁড়ি  দিয়ে নামার সময় একটা ছোট্ট পাহাড়ি নদী দেখতে পাওয়া যায়।  পুরোটা নামতে প্রায় পঞ্চাশটির মতো সিঁড়ি ভাঙতে হলেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সেটা পুষিয়ে দেয়।

ইকো পার্ক: টিকিট এখানে মাথাপিছু ১০ রুপি।  ক্যামেরা চাইলে আরো বাড়তি গুনতে হবে ১৫ রুপি।  এখানেও কিছুটা সিঁড়ি দিয়ে নামতে হয়, তবে সিঁড়ির ধাপ বড়জোর ১৫টি।  নিচে নেমে একটা বিরাট সমতল জায়গা, সেখান দিয়ে একটা জলের ধারা গড়িয়ে পাহাড় থেকে বহু নিচে পড়ছে। জায়গাটি মেঘ ছিল- দৃশ্য খুবই সুন্দর! ভালো করে দেখতে গেলে এই জায়গাটা কিছুতেই কম সময়ে দেখে ফেলা সম্ভব নয়। 

মাওস্মাই কেভ: চেরাপুঞ্জির সাইট সিয়িং-এর সবচেয়ে সুন্দর আর আকর্ষণীয় জায়গা! যদি শরীর আর মনের জোর থাকে, তাহলে এই জায়গাটা দেখা অবশ্যকর্তব্য।  পাহাড়ের মধ্যে একটা অসাধারণ সুন্দর প্রাকৃতিক গুহা যার ভেতরে স্ট্যালাকটাইট আর স্ট্যালাগমাইট। ভেতরে পুরোটাই বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করা আছে। কাজেই অন্ধকারে হাতড়ানোর কোনো ব্যাপার নেই।  ভেতরের পথ কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু, কোথাও মাথা সোজা করে হাঁটতে হয়, কোথাও মাথা নিচু করে, আবার কোথাও একেবারে হামাগুড়ি দিয়ে। একটা বিশেষ জায়গা আছে যেখান দিয়ে গলার পথটা এতটাই ছোট যে, মনে হয় স্বাস্থ‌্য ভালো হলে আটকে যাবেন। কিন্তু শরীর ভাঁজ করে, মাথা আর পা আগুপিছু করে ঠিক গলে যাওয়া যায়।  ভেতরে জুতো খুলে যাওয়াই ভালো। কারণ অনেক জায়গাতেই গোড়ালিডোবা জল আছে। তাছাড়া জুতো পরে ভিজে পাথরের মধ্যে হাঁটতে গেলে পা হড়কানোর আশঙ্কাও থাকবে।  গুহাটা সব মিলিয়ে ১৫০ মিটারের মতো লম্বা। পাথরের ওপর পা ফেলে, মাথায় পাথরের গুঁতো খেয়ে আর ভেতরের অসাধারণ দৃশ্য দেখতে দেখতে এই পথ চলাটা- লাইফ টাইম্ এক্সপেরিয়েন্স!

সেভেন সিস্টার ফল্স্‌: এখানে টিকিট লাগে না। পাহাড়ের ধারে একটা রেলিং দিয়ে ঘেরা জায়গা। যেখান থেকে অন্য একটা পাহাড়ের গায়ের পাশাপাশি সাতটা ঝরনা দেখতে পাওয়া যায়। গুনলে সাতের বেশি হবে।  আর কোন সাতটা একই মায়ের সন্তান বোঝার উপায় নেই।  অপূর্ব ঝরনাধারা।

মাও ট্রপ্: বাংলাদেশ! আরে এখান থেকে আমার দেশ দেখা যায়। এটা চেরাপুঞ্জির আরেকটা আকর্ষণীয় জায়গা। এখানে পাহাড়ের ওপরে একটা রেলিংঘেরা জায়গা থেকে নিচে বাংলাদেশ দেখা যায়।  দৃশ্যটা যে খুব স্পষ্ট তা নয়, কারণ জায়গাটা কিছুটা মেঘাচ্ছন্ন, আর সোজাসুজি দেখা গেলেও দূরত্ব কম নয়। আমরা পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে আছি। নিচে যতদূর চোখ যায় নদীনালা ঘেরা সমতলভূমি- বাংলাদেশ।

থাঙ্খারাং পার্ক: এটা একটা বোটানিক্যাল গার্ডেন। অনেকরকম গাছ আছে, তবে ফুলের সংখ্যাই বেশি।  এখান থেকে অন্য একটা পাহাড়ের গায়ে একটা ঝরনা দেখতে পাওয়া যায়।  তার সঙ্গে দেখা যায়- বাংলাদেশ।

রামকৃষ্ণ মিশন: রামকৃষ্ণ মিশনের ভেতরে একটা মিউজিয়াম আছে। যেখানে মেঘালয়ের মানুষের জীবনযাত্রা, তাদের উৎসব-অনুষ্ঠানের কিছু মডেল রাখা আছে। এছাড়া এখানকার পাহাড়ি অধিবাসী গারো, খাসী, জয়ন্তিয়াদের ব্যবহৃত জিনিসপত্রের একটা সংগ্রহশালাও আছে।

মেঘে ঢাকা নোহকালিকাই ফল্স্‌: এক কথায় অপূর্ব।  উচ্চতায় পৃথিবীর ৪র্থ।  ভারতে দ্বিতীয়।  বর্ষাকালে এর জলরাশি ১৮০০ ফুট খাদে গিয়ে নামে।  এখানে গিয়ে বিস্মিত হয়ে ছিলাম অনেক সময়।

স্প্রেড ঈগল ফলস: এর নাম দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আগের নাম নোহকালিয়ার ফলস। লীয়ার নামে এক কুমারী পা পিছলে পড়ে যাওয়ায় এর নাম হয়েছিল এমনটা।  ঈগলের মতো ডানা মেলা প্রপাতের নাম এখন স্প্রেড ঈগল ফলস।

লেডী হায়দারি পার্ক: রোডোডেড্রনগুচ্ছের দেখা পেলাম।  রবির ক্যামেলিয়া যেন হাসছে চারপাশজুড়ে।  নানান জাতের হাজারও ফুল- অর্কিড, ফার্ন, দিগন্তজুড়ে গোলাপ।  শিলংয়ের বুঝি এই সবচেয়ে রোমান্টিক জায়গা! একটি পূর্ণাঙ্গ বাগানের পাশে মিনি চিড়িয়াখানা। চিড়িয়াখানার জলাশয়ে প্যালিক্যান ভেসে বেড়াচ্ছে।

ক্যাথিড্রাল চার্চ: চার্চের বৈশিষ্ট্য হলো এটা শিলংয়ের সবচেয়ে বড় চার্চ।  চার্চটা রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা উপরে- একটা অর্ধ-চন্দ্রাকার সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরের প্রার্থনাগৃহে যেতে হয়।  (চলবে)

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়