ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

আদম পাহাড়: নেশার ঘোরে নামছিলাম

উদয় হাকিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০৭, ১০ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আদম পাহাড়: নেশার ঘোরে নামছিলাম

অ‌্যাডামস পিকে কখন কবে উঠেছিলাম সেটাই যেন ভুলে গিয়েছিলাম। রাতের বেলা বেহুঁশের মতো উঠেছি। দিনের বেলা বেখেয়ালে নেমেছি। খেয়াল করতে গেলে শরীরে কুলুবে না। আদম পাহাড় নামের মধ্যেই কেমন যেন মাদকতা আছে। সেই নেশায় বুঁদ হয়ে যেমন উঠেছিলাম, নেশার ঘোরেই নামছিলাম।

আদম পাহাড় থেকে নামার পথে, জাপানিজ টেম্পলের ঠিক পরেই মালভূমির মতো জায়গাটা খুব সুন্দর। সূর্যের আলো ছিল খুবই প্রখর। একেবারে ঝলমলে মেঘমুক্ত রোদ। ছবি তোলার আদর্শ আবহাওয়া। পারফেক্ট পরিবেশ। ফিরোজ আর মিলটন ছবি তুলছিলেন। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম রোদের মধ্যে। কড়া রোদে গা পুড়ে যাচ্ছিল। ওদিকে নুনা ঘামে ভিজে যাচ্ছিল সাদা টি শার্ট। তীর তীর করে চোরা ঘাম মেরুদণ্ডের  নালা বেয়ে নিচে ধাবিত হচ্ছিল। টি শার্টের নিম্নাংশ দিয়ে একটা ঘষা দিলাম। আর তখনই ফোন বেজে উঠলো।

জিন্সের প্যান্ট পরে ছিলাম। মোবাইল ফোন পকেটেই ছিল। সাংবাদিক ইমনের ফোন। ভাই কোথায় আছেন?- কি বলি? জায়গার নাম তো জানা নেই। নেই কোনো সাইনবোর্ড। বললাম, ওই যে জাপানিজ টেম্পল দেখেছিলেন, যেখান থেকে আপনি ফিরে গিয়েছিলেন; ঠিক তার ঢালে। ওই যে মালভূমির মতো সমতল জায়গা। ইমনের পাল্টা প্রশ্ন- ভাই মালভূমি কি? বুঝলাম না।

বুঝতে হবে না। হাঁটতে থাকেন। একটু পরই পেয়ে যাবেন। তা এই অসময়ে আপনি আবার উপরে উঠছে কেন? ইমন বললো, ভাই আমি অ‌্যাডামস পিকে যাব।

 

 

কীভাবে যাবেন? পাগল? আপনার পক্ষে সম্ভব না। রাতের বেলায় পারলেন না, এখন কেমনে পারবেন? আরে ভাই পারব- ইমনের উত্তর। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম, ওকে পারলে তো ভালো। আপাতত আমরা যেখানে আছি সেই পর্যন্ত আসেন।

ইমন বললো, ভাই- একজন আমাকে বলেছে, আর একটু গেলে নাকি আমি চূড়ায় উঠে যেতাম।

আমি তো বাস্তবতা জানি। নিজ চোখে দেখে এসেছি। ওটা যে ইমনের পক্ষে সম্ভব না তা জানি। কিন্তু কি দরকার নিরুৎসাহিত করার? ওকে, আসেন, আপনি পারবেন নিশ্চয়।

জি ভাই, আসতেছি, ইমনের উত্তর।

পাশেই ঝোপের মধ্যে ফুটে ছিল ফুল। ঝুরি সাদা ফুলের একটা গাছ দেখলাম। আমাদের দেশে ওরকম গাছ দেখেছি বলে মনে পড়ছিল না। ছবি নিলাম। এরপর পিঙ্ক এবং বেগুনি পিঙ্ক কালারের আরেকটা ফুল দেখলাম। অনেকটা আমাদের কলমি ফুলের মতো দেখতে।

উত্তরে তাকাতেই চোখ আটকে গেলে পাহাড়ের মাথায়। বিপরীত দিক থেকে পড়া সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করছিল বরফগলা রূপালী জল। পাহাড়ের মাথা ফেটে বেরোচ্ছিল ঝরনার পানি। লোভ সামলোতে পারলাম না। প্রথমে সেলফি নিলাম। তারপর মিলটনের হাতে মোবাইল ফোন দিয়ে বললাম ছবি তোলো। পেছনে যেন ওই পাহাড় থাকে। পরে চেক করে দেখলাম, ওই বিশাল পাহাড়ের দেয়াল, ঝরনা বাস্তবে যতটা সুন্দর দেখাচ্ছিল; ছবিতে তার ছিটেফোঁটাও এলো না।  

 

 

ছবি তোলা শেষে আবার হাঁটছিলাম। বুঝে গিয়েছিলাম, আস্তানা বেশি দূরে নেই। তাই খুব একটা তাড়া ছিল না। শরীর মনে ক্লান্ত ছিলাম এই যা। তবে ওরকম একটা আরাধ্য বিষয় জয় করার পর স্বস্তির মাত্রাই বেশি ছিল।

নিচু থেকে আবার কিছুটা উঁচুতে উঠতে হচ্ছিল। সামনে একটা পাহাড়। বা পাশ (উত্তর দিক) দিয়ে ওটাকে অতিক্রম করছিলাম। উপরে উঠা শেষ। আবার নামতে হচ্ছিল। বা পাশে খাড়া ঢালু। ডান পাশে উঁচু পাহাড়। মাঝখান দিয়ে লালচে মাটির পথ। গাছের ছায়ায় ছায়ায় যাচ্ছিলাম। ঠিক সেই সময় দেখলাম দূর থেকে ইমন আসছিলেন। তার হাতে একটি গো-প্রো ক্যামেরা। লম্বা ডান্ডা লাগানো, সেলফি স্টিক। ইমন আসছিলেন আর কিছু একটা বলছিলেন। বুঝতে বাকি রইল না। ইমন আসলে ইউটিউবের জন্য কনটেন্ট বানাচ্ছিলেন। কিছুদিন আগে বলছিলেন, তার বন্ধু বাতেন বিপ্লব একটা ইউটিউব চ্যানেল করেছেন। সেখানে অনেক সাবসক্রাইবার। ভালোই ইনকাম নাকি তার। ইমন তাকে ফলো করার চেষ্টা করছিলেন। যেখানেই যাচ্ছিলেন, সেখান থেকেই ভিডিও কনটেন্ট বানাচ্ছিলেন।

কাছে আসতেই ইমন জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কি সত্যি সত্যিই অ‌্যাডামস পিকে  গিয়েছিলেন। বললাম- হ্যাঁ। সত্যিই? মিলটন পাল্লা প্রশ্ন করলেন, কেন সন্দেহ আছে কোনো? প্রমাণ লাগবে? ইমন লাজুক হাসি দিয়ে বললেন, কেমনে গেলেন ভাই! কনগ্রাচুলেশন।

জায়গাটা ছবি তোলার জন্য সেরকম ছিল। লোভ সামলাতে পারলাম না। প্রথমে আমরা তিনজন, পরে ইমনকে নিয়ে ছবি তুললাম। বিদেশি এক পর্যটক হাসিমুখে ছবি তোলে দিলেন। ইমন এমনভাবে পোঁজ দিলেন, দেখে মনে হচ্ছিল- এই প্রথম কোনো বাঙালি অ‌্যাডামস পিক জয় করলো। আর সেই বাঙালি হলেন ইমরুল কাওসার ইমন।

বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটছিলাম। ইমন হাঁটছিলেন উল্টো দিকে! কেন? ইমন? কি হয়েছে? কই যাচ্ছেন? ভাই- আপনারা হোটেলে যান। আমি আসছি। কোথায় যাবেন?– আমি অ‌্যাডামস পিকে যাব, ইমনের উত্তর। হাঁসব না কাঁদব বুঝতে পারছিলাম না। পাগলটা বলে কি? এখন? পারবেন না।

না ভাই চেষ্টা করে দেখি। আপনারা যান, আমি আসছি। পাগলটা বলে কি? একটু পরেই হোটেলের ব্যাগেজ লাগেজ নিয়ে রওনা হতে হবে কলম্বো। এখন কীভাবে সে অ‌্যাডামস পিকে যাবে! অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম। ইমন নাছোড়বান্দা। অনুমান করছিলাম, ইউটিউবে অ‌্যাডামস পিকের ভিডিও দেখেছে। সেটা দেখে তার মনে হয়েছে খুব সহজ ব্যাপার। তাই রাতে ফিরে গেলেও দিনের বেলা উঠতে চাইছে। বাট সে পারবে না। সময়ও নেই হাতে। তার জন্য সবার দেরি হবে।

বোঝাতে পারলাম না। ইমন আমাদের বিপরীত দিকে হাঁটল। সে দ্বিতীয় বারের মতো উঠার চেষ্টা করছিল। আমরা তিন জন নামছিলাম। শেষে বললাম, ইউটিউবের জন্য কিছু ফুটেজ নিয়ে চলে আসেন। দেরি করা যাবে না। ওকে ভাই, বলে ইমন কোন মৌয়ের লোভে মৌমাছির মতো হারিয়ে গেল।

 

 

বা পাশের খাদটা হঠাৎ ঢালু হয়ে আসছিল। সুষম ঢালুর ওই জায়গায় কিছু গবাদি পুশ ঘাস খাচ্ছিল। রাস্তার ধারে ছিল কয়েকটা দোকান। আর ওই দোকানের পাশ দিয়েই কিছু পোকা গান গাইছিল। শব্দটা কানে যেতেই বুঝতে পেরেছিলাম, এই গান তো মৌমাছি ছাড়া আর কারো নয়। দোকানগুলোর পরই দেখলাম বিশাল বিশাল কিছু কড়ই গাছ। ইংরেজিতে যাকে টেইন ট্রি বলা হয়। গ্রাম দেশে সোজা রেন্টি বলে। প্রত্যেকটা গাছের ডালে ডালে অসংখ্য মৌচাক। একটা গাছে এতগুলো মৌচাক কখনো দেখিনি। গুনে দেখলাম ২৪ থেকে ৩০ টা চাক একেক গাছে। মৌমাছির অভয়ারণ্য বলা চলে ওই এলাকাকে। এর আগের দিন দেখেছিলাম বুদ্ধ মূর্তির শরীরের অসংখ্য মৌচাক। খাঁটি মধুর ভান্ডার।

রাতে একটা পাহাড়ের কাছে গিয়ে আমরা থমকে গিয়েছিলাম। দুটো পথ ছিল। কোন পথ নেব বুঝতে পারছিলাম না। সোজা পাহাড়ে উঠে যাব, নাকি ডানে। উপরে ওঠার রাস্তাও পাকা ছিল। আর ডান পাশেরটা ছিল পাতা এবং শ্যাওলা ছাওয়া। পাতায় মোড়ানো রাস্তায় গিয়েই ভালো করেছিলাম। তখনই অনুমান ছিল ওটা হয়তো চা বাগান। দিনের বেলা সে অনুমান সত্যি হলো। ওই পাহাড়জুড়ে চা বাগান। টিলার উপরে বাগানের বাংলো, মেশিন ঘর, গুদাম। ওই পাহাড়ের কোণে একটা ছোট্ট মন্দির। সেখানে বাতি জ্বালিয়ে ভিক্ষার জন্য বসে ছিলেন পুরোহিত। নামার সময় কাউকে দেখলাম না। সেদিন ইনকাম ভালো হয়নি নিশ্চিত করে বলতে পারি।

আরো কিছুটা পথ পেরোতেই দেখলাম বিশাল একটা গেট। আশপাশে অনেকগুলো বসার জায়গা। সিমেন্টের ভাঙা বেঞ্চ, কাঠের গুঁড়ি, গাছের মোটা শিকড়।

গেটের ঠিক পরেই একটা নিচু মন্দির। বুদ্ধ শেখানে শুয়ে আছেন। পেছনে পাথুরে পাহাড়ের কারুকাজ। এরকম গেট, মন্দির আর বুদ্ধ মূর্তি কখন শেষ হবে? হাঁটতে হাঁটতে কম্ম সারা।
 



শ্রীলঙ্কা/উদয় হাকিম/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়