ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

মানবতা, করোনা ও চালচোর সমাচার

মাহফুজা হিলালী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ২৮ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মানবতা, করোনা ও চালচোর সমাচার

করোনায় বিশ্বে মৃতের সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছে। দেশে মৃতের সংখ্যা ১৫২ জন, আক্রান্ত মোট ৫৯১৩ জন। ধারণা করা হচ্ছে, আরও পরীক্ষা করলে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারতো। কারণ পরীক্ষাই তো কম করা হচ্ছে। তাছাড়া জ্বর-সর্দি-কাশিতে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে কয়েকজন। সব মিলিয়ে দেশের অবস্থা আশঙ্কাজনক!

রোগ যেন ছড়িয়ে না পড়ে সে লক্ষ্যে সরকার গত এক মাস ধরে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে রেখেছে। আরও ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। ছুটি বাড়ানো হচ্ছে মানুষের কথা চিন্তা করেই। মানুষের মৃত্যু বন্ধ করতে গিয়ে বন্ধ হয়ে আছে কল-কারখানা, পরিবহণসহ অন্যান্য খাত (কারণ জীবন বাঁচানোই এখন একমাত্র কাজ হিসেবে বিবেচ্য)। কল-কারখানা, গার্মেন্টস, অফিস বন্ধ হওয়ার কারণে বেশির ভাগ শ্রমিক মার্চ মাসের বেতন পাননি। দিনমজুরদের কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অনেক মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও চাকরি হারিয়েছেন। দেশের এই পরিস্থিতিতে গত ২৪ মার্চ ২০২০ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সারা দেশে ত্রাণ বিতরণের কাজ শুরু হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে জেলা পর্যায়ে, জেলা থেকে  উপজেলা পর্যায়ে এবং উপজেলা থেকে গ্রাম পর্যায়ে যাচ্ছে ত্রাণ। সপ্তাহে দু’বার অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে।

তিনভাবে ত্রাণ যাচ্ছে দুস্থ মানুষের কাছে: খাদ্য সহায়তা, শিশুখাদ্য সহায়তা এবং অর্থ সহায়তা। এছাড়া সারা দেশের মানুষের কাছে কম মূল্যে খাদ্য পৌঁছানোর জন্য শুরু হয়েছে টিসিবি’র পক্ষ থেকে কম মূল্যে খাদ্যদ্রব্য বিক্রির কাজ। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে করা এ কাজগুলো খুবই প্রশংসনীয়। এগুলো আশা জাগানিয়া উদ্যোগও বটে। শুধু রাষ্ট্রই নয়, অনেক ব্যক্তি এবং সংস্থাও দুস্থদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন। অন্তত ব্র্যাক-এর উদ্যোগ তো খুবই প্রশংসনীয়। এভাবে করোনাকালে দুস্থদের পাশে দাঁড়িয়েছে সরকার, বিভিন্ন সংস্থা এবং সাধারণ মানুষ। শুধু ত্রাণ দিয়েই নয় ডাক্তার, পুলিশ, সরকারি অফিসার, সেনাবাহিনীÑ সবাই সেবা দিয়ে সাহায্য করছেন এই করোনাকালে। এভাবেই যুগে যুগে মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছে। এই করোনাকালেও তা হচ্ছে।

বর্তমানে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ লকডাউন। সমস্ত পৃথিবী উৎপাদন বন্ধ করে মৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়ছে। জাতিসংঘ বলছে বিশ্বে শত কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষে পড়বে। বাংলাদেশ সরকার তিন বছরের দুর্ভিক্ষ মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সরকারিভাবে ধারণা করা হচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগ ৪০ শতাংশ কমবে। সুতরাং বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সময় খুব সুখকর নয় মানুষের জন্য। তবে বর্তমানে মানুষ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা চিন্তা করার চেয়ে মরণঘাতী করোনার হাত থেকে অর্থাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচবে কিনা তা নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় মৃত্যুপুরীর এই দুঃসময়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে সরকারি চাল, ডাল, তেল চুরির খবর আসছে। যা গরিব-দুঃখী মানুষের জন্য বরাদ্দ।

গত ৫ এপ্রিল নড়াইলের রূপগঞ্জ থেকে ৬৭ লিটার সয়াবিন তেল উদ্ধার করেছে পুলিশ। অনলাইন নিউজপোর্টাল ‘রাইজিংবিডি.কম’ থেকে জানা গেছে নড়াইলে চিত্রানদী থেকে মাঝিরা উদ্ধার করেছেন টিসিবি’র সয়াবিন তেলের শতাধিক খালি বোতল! এখানে ২ লিটার ও ৫ লিটারের বোতল রয়েছে। জাতীয় দৈনিক ‘প্রথম আলো’ থেকে জানা যায় ১৮ এপ্রিল রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে আলাল উদ্দিন স্বপনের বাড়ি থেকে ৬৭ বস্তা চাল উদ্ধার করা হয়। এবং তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ‘যুগান্তর’-এর অনলাইন সংস্করণ থেকে জানা যায় ২১ এপ্রিল চাল চুরির অপরাধে বাগেরহাটের ডিলার তরিকুল ইসলাম তারেকের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। ২২ তারিখ ‘সময় সংবাদ’-এ প্রচার করা হয় নওগাঁয় ৩৫ বস্তা, বগুড়ায় ৬২ বস্তা, নেত্রকোণায় ২৭ বস্তা, কিশোরগঞ্জে ২৫ বস্তা চাল উদ্ধার করেছে প্রশাসন। শুধু এগুলোই নয়, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এ রকম চুরির খবর পাওয়া যাচ্ছে পত্রিকা বা টেলিশিনের সংবাদে। এই সংবাদগুলো সত্যিই দুঃখজনক।

মানুষ যখন জীবন-মৃত্যুর লড়াই করছে। প্রতিটি মুহূর্তে ভাবছে পরদিন সে বেঁচে থাকবে কি-না, সর্তক থেকেও আতঙ্ক কমাতে পারছে না, তখন অনাহারী মানুষের মুখের আহার কেড়ে নিচ্ছে কিছু মানুষ। এই মানুষগুলোর মানবিকতা কোথায় নেমে গিয়েছে! এদের মধ্যে কেউ কেউ রাজনৈতিক নামধারীও রয়েছে। অথচ একটা সময় তাঁরাই রাজনীতি করতেন, যাঁরা দেশকে টাকা দিতে পারতেন। স্বাধীনতার আগে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত বারো আনা পয়সা দিয়ে ছাত্রলীগ-এর সদস্যপদ নিতে হতো। তাঁরা দেশের সেবা করার জন্য রাজনীতি করতেন, ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে ছুটে যেতেন, বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতেন, প্রবল খরা বা বন্যায় ফসল নষ্ট হলে পাশে দাঁড়াতেন। অথচ আজ কোথাও কোথাও তার উল্টো চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। এই চোরেরা সারা জীবন চুরির মতলবে থেকেছে। এবং চুরি করেছে। এটা এদের কাছে সাধারণ এবং নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার। করোনার আগে মানুষ এতোটা নিঃস্ব ছিলো না। তাদের রোজগার ছিলো, খাদ্য ছিলো, অনাহারে থাকতে হতো না। তাই চোরদের প্রতি দৃষ্টি সবার কম ছিলো। কিন্তু এখন প্রেক্ষাপট আলাদা। মানুষ অভাবে পড়েছে। তাদের খাদ্য দরকার। এবার তাই চোরদের প্রতি নজর দেওয়ার সময় এসেছে।

আশ্চর্যের ব্যপার হলো, চোরগুলোর মৃত্যু ভয় নেই! চালের বস্তার সাথে করোনা নিয়ে ঘরে ঢোকাচ্ছে কি-না, সে দিকেও খেয়াল নেই! অর্থাৎ চুরিতে এরা অন্ধ। চুরি-ই এদের জীবন। চোরদের কোনো দল নেই, শ্রেণি নেই, পেশা নেই। তারা যে শ্রেণি-পেশায় থাকুক না কেন তারা চোর। আশার কথা হলো এই চোরেরা ধরা পড়ছে। আইনের আওতায় আসছে। বিচার করে সরকার চোরদের সমূলে নির্মূল করবেন বলে বিশ্বাস করি। বিশ্বাস করি বাংলাদেশ চোরমুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ মানবিক দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে।

লেখক: নাট্যকার ও গবেষক


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়