ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

করোনার এপিঠ-ওপিঠ

নাজমুল হুদা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৫৯, ২৮ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
করোনার এপিঠ-ওপিঠ

কার্টুন: কাওছার মাহমুদ

করোনার কারণে মানুষ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বাধ্য হওয়ায় পারিবারিক দূরত্ব কমে আসছে; পারস্পরিক বন্ধন দৃঢ় হচ্ছে! শহুরে কর্মজীবী মানুষের যেখানে বাসায় আসতে রাতের প্রথমাংশ পেরিয়ে যেত, এখন তারা অনেকে ঘরের কোণে ‘হোম কোয়ারেন্টাইনে’।

‘কোয়ারেন্টাইন’ নামক এই ‘দাতভাঙা’ শব্দটি বেশিরভাগ মানুষের কাছেই নতুন; দুর্বোধ্য। এরকম ঘরবন্দি সময় কাটানো অনেকের জন্য বেশ অস্বস্তিকর, অনভ্যাসেরও বটে।

অনেকে হয়তো মনে মনে আকুতি করছেন ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে’। বাঙালিকে ‘ঘরের কোণে’ আটকে রাখা যে কত কঠিন তা বিগত একমাসে দেখতে পেয়েছি। বিশেষত বাঙালি পুরুষের মন বাইরে যাওয়ার জন্য আনচান করতে থাকে। তারপরও যেহেতু বাধ্যতামূলক ঘরে থাকতেই হচ্ছে, তাই পরিবারের অন্যদের সঙ্গে নানা গল্প-স্বল্প করা, নিজের শখের কিছু করা, বইপড়া, সিনেমা দেখা, অনলাইনে ঘুরে আসা আর খুব বেশি হলে বাসার ছাদে পায়চারি- আমাদের দৌড় এখন এ পর্যন্তই। এই সীমাবদ্ধ গন্ডিতে বদ্ধ হয়ে অনেকেই আবার বাড়তি সময়টুকু বেশ বৈচিত্র্যময় করে তুলছে; বিভিন্নভাবে উপভোগ করছে।

সেদিন বিকেলে পাশের বাসার ছাদে দেখলাম বাবা ছেলে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। আরেক ছাদে দেখলাম পাটি বিছিয়ে পরিবারের সবাই লুডু খেলছে। করোনাকালে ছাদের গাছের পরিচর্যা বেড়ে গেছে বহুগুন। তাছাড়া, বাইরে মানুষের পদচারণা কমে যাওয়ায় প্রকৃতিও সজিব, সতেজ ও সুন্দর হয়ে উঠছে। এ যেন এক নতুন পৃথিবী!

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের অনেক নতুন শব্দের সঙ্গে পরিচয় ঘটছে, বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সেদিন এক ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘লকআপ’ ও ‘লকডাউন’ শব্দ দু’টির পার্থক্য কী? তিনি একগাল হেসে বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে জবাব দিলেন ‘ ওই তো লকডাউন না মানলে লকআপ-এ ঢোকানো হবে আর কি! আসলেই তো Lock এর আগে-পরে Up and down যুক্ত করে নতুন দু’টি শব্দ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ‘লকআপ’ শব্দটি বাঙালির কাছে কিছুটা পুরনো ও পরিচিত। তবে ‘লকডাউন’ অনেকটাই অভিনব; নয়া অভিজ্ঞতা। আভিধানিক ধারণা পরিষ্কার করতে ক্যামব্রিজ ইংলিশ ডিকশনারি অনুুসন্ধান করে দেখলাম লকডাউন বলতে এমন একটি জরুরি পরিস্থিতি বা সময় বোঝানো হয়েছে যখন যে কেউ নিজের ঘর বা নির্দিষ্ট এলাকায় প্রবেশ বা সেখান থেকে বের হতে পারবে না। আর ‘লকআপ’ বলতে সরাসরি জেল বা বন্দিদশা বোঝানো হয়েছে।

কিন্তু অনেকের মন যে ‘থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে’ বলে প্রতিনিয়ত বিদ্রোহ করছে তা বাইরের কিছু চিত্র দেখলেই বোঝা যায়। কয়েকদিন আগে মোড়ের মাথায় একটি দোকনে দেখলাম কয়েকজন লোক এক বেঞ্চে বসে সযতনে মাস্ক হাতে নিয়ে অন্য হাত দিয়ে সিগারেট ফুকছে। কযেকজনকে দেখলাম মুখ থেকে মাস্ক গলায় নামিয়ে অনুরূপ কর্মে লিপ্ত। গলিতে পুলিশের গাড়ি ঢুকতেই তারা কেউ কেউ গলির ভিতরে উধাও হয়ে গেল। মনে হচ্ছে, করোনার ভয়ে নয়, পুলিশের ভয়ে মাস্ক পরেছেন তারা। তার চেয়েও ভয়ঙ্কর চিত্র তরুণদের মধ্যে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ। শপিং মলের সিঁড়িতে পাশাপাশি বসে যে যার মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। মনে হচ্ছে আসলেই তারা ‘আইসোলেটেড’; ভার্চুয়াল ভাইরাসে আক্রান্ত!

আরেক শ্রেণীর মানুষের কাছে ‘লকডাউন’ ‘শাটডাউন’ ‘কোয়ারেন্টাইন’ বলে  কিছু নেই। তাদের সরল যুুক্তি ‘পথে না বের হলে খাবার জুটবে কীভাবে?’ এখন অবশ্য অনেক সংস্থা বা ব্যক্তি নিম্ন আয়ের মানুষদের খাবার দিচ্ছেন। যদিও কোথাও কোথাও ফটোসেশন সর্বস্ব ‘অনুদান অনুষ্ঠানে’ গণজমায়েত দেখা যাচ্ছে। যেন উৎসব মুখর পরিবেশে ‘করোনা প্রতিরোধ’ উদযাপিত হচ্ছে। এতে আক্রান্ত হওয়ার প্রবনতা বা সংক্রমণের আশঙ্কা থেকে যায়। করোনার এ ক্রান্তিকালে নিজেকে নিরাপদ রাখার দায়িত্ব নিজেরই। নিজেরা যদি সচেতন হই, সতর্ক থাকি এবং বাধ্য হয়েও যদি আমাদের কিছু সাস্থ্যসম্মত অভ্যাস তৈরি হয় তাহলে করোনা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে, দীর্ঘমেয়াদী সুস্থ্য জীবন যাপন করা সহজ হবে। আসুন কিছুদিন ধৈর্য্য ধরি, ঘরে থাকি।

লেখক: প্রাবন্ধিক, গবেষক ও উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক


ঢাকা/তারা/নাসিম

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়