ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

করোনাভাইরাস, ইসলাম কী বলে?

মোহাম্মদ নঈমুদ্দীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৪৮, ৪ মে ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
করোনাভাইরাস, ইসলাম কী বলে?

প্রাণঘাতি মহামারি করোনাভাইরাসের থাবা ক্রমান্বয়ে বিস্তৃত হচ্ছে বাংলাদেশে। এই মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকেই করোনাভাইরাস সম্পর্কে কিছু আলেম-ওলামা ইসলামের নামে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করছেন।

করোনাভাইরাসের মতো প্রাণঘাতি জীবাণুর অস্তিত্ব বলতে কিছু আছে কিনা, এর প্রতিকার ও প্রতিরোধ নিয়ে ইসলাম কী বলে? এমন সব প্রশ্নের উত্তর জানতে চান ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। মহামারি হলে এসময়ে জীবন-জীবিকা, নামাজ, জামাত, মুসাফাহা, মেহমানদারি, চিকিৎসা কীভাবে হবে? এমন সব প্রশ্নের জবাব নিয়ে কোরআন ও হাদিসের আলোকে একটি গবেষণাধর্মী বই লিখেছেন ইসলামী গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের প্রফেসর ড. সাইয়েদ আব্দুল্লাহ আল মারুফ। তিনি ওআইসি আন্তর্জাতিক ইসলামী ফিকহ একাডেমির (বাংলাদেশ) স্থায়ী প্রতিনিধি এবং বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার (বিএমআরসি) এর সদস্য।

প্রাণঘাতি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ইসলামের নির্দেশনা তুলে ধরে গবেষণাধর্মী বইটিতে বলা হয়েছে, মহামারিকে আররিতে বলা হয় তা‘উন। ভাইরাস কিংবা জীবাণু বলতে যে কিছু আছে সেটা আমাদের মহানবী (সা.) নিজেই বলে গেছেন। এক্ষেত্রে কী করতে হবে সেই ব্যবস্থাপনার একটি রূপরেখাও দিয়েছে গেছেন তিনি।

“উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা(রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি মহানবী (সা.)-কে মহামারি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তখন তিনি আমাকে জানালেন, এ হচ্ছে একটি শাস্তি, আল্লাহ যাকে চান তার উপর নিপতিত করেন, তখন মু’মিনদের জন্য এটিকে অনুগ্রহ সাব্যস্ত করেন। এ সময় কোনো ব্যক্তি যদি মহামারি আক্রান্ত হয়ে নিজ ঘরে ধৈর্য ধরে সওয়াবের প্রত্যাশা করে, নিজেকে সঙ্গনিরোধভাবে ঘরে স্বেচ্ছাবন্দি থেকে এই দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করে যে, আল্লাহ যা ভাগ্যে লিখে রেখেছেন তার বাইরে কোনো কিছু স্পর্শ করবে না, এমন ব্যক্তি শহীদের সমতুল্য সাওয়াবের অধিকারী হবেন।” (সহিহ আল বুখারি, হাদিস নং-৩৪৭৪, নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা, হাদিস নং-৭৫২৭, মুসনাদ আহমাদ হাদিস নং-৩৬১৩৯)।

এ হাদিস দ্বারা বুঝা যায়, মহামারি ভাইরাস অন্যের জন্য আযাব হলেও মু’মিন যদি সবুর করে তাহলে সেটি তার জন্য রহমত হিসেবে সাব্যস্ত হয়।

আমিরুল মুমেনিন খলিফা উমর (রা.)-এর আমলে একবার প্লেগ রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। অকুস্থল ছিল ফিলিস্তিনে অবস্থিত এক জেহাদের ময়দান। কমান্ডার ইন চিফ ছিলেন উবায়দাহ ইবনুল জাররাহ (রা.)। তিনি নিজে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবার আগেই মু‘আয ইবনে জাবাল (রা.)-কে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করে যান। তিনিও মাত্র ৪৮ বছর বয়সে মহামারিতে মারা যান। এ সময় হজরত উমর (রা.) খলীফা, তিনি যুদ্ধের ময়দানের অবস্থা নিজে দেখার জন্য যখন আল্-কুদ্‌সের নিকট ওই অঞ্চলের প্রধান ফটকে উপনীত হন, তখন তাকে জানানো হলো যে, এ অঞ্চলে মহামারির প্রকোপ চলছে। তখন তিনি তার সাথে সেনাদলকে নির্দেশ দেন যেন এ রাতটি ঘোড়ার পিঠেই সবাই অবস্থান করে। সকালে তিনি ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন কেউ একজন বললেন, আমীরুল মু’মিনীন! আপনি কি আল্লাহর তাকদির থেকে পালাচ্ছেন? তিনি (ওমর) উত্তরে বললেন, আমি তো আল্লাহর এক তাকদির থেকে অপর তাকদিরের দিকেই যাচ্ছি।

এক্ষেত্রে খলিফা উমর (রা.), মহানবী (সা.)-এর নির্দেশনাই অনুসরণ করেছেন। মহানবী (সা.) বলে গেছেন, ‘যদি তোমরা শোন যে কোনো এলাকায় মহামারি চলছে তবে সেখানে প্রবেশ করবে না। আর যদি তোমরা যেখানে আছ সেখানে মাহামারি দেখা দেয় তাহলে সেখান থেকে বের হবে না।” দ্বিতীয়ত: খলিফা উমর (রা.) মহানবী (সা.)-এর আরেকটি হাদীসের উপর আমল করে ঘোড়ায় অবস্থান করেছেন,  মহানবী (সা.) বলে গেছেন “সংক্রমিতকে সুস্থের মাঝে রাখা যাবে না।”  এটি যদিও সংক্রমিত উটের প্রসঙ্গে বলেছিলেন বলে কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন তবে বিষয়টি জীবাণু (ভাইরাস) প্রসঙ্গে আসাতে মানুষ, পশু-পাখি সবার ক্ষেত্রেই সমভাবে প্রযোজ্য।

এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, তিনি দুর্গত সেনাদের রেখে চলে গেলেন কেন? এর উত্তরে বলব, এটাও শরীয়তের মূলনীতি সঙ্গত হয়েছে। শরীয়তে দুটি অনিবার্য ক্ষতি থেকে একটি গ্রহণ করতে হলে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতির অপশনটি বেছে নিতে হবে। মহামারিতে খালি হাতে, অষুধ-পথ্য ছাড়া বা ডাক্তার নার্স না হয়ে প্রবেশ করা, আত্মহননের শামিল। কাজেই এ ক্ষেত্রে তিনি কম ক্ষতির অপশন বেছে নিয়ে নিরাপদে ফিরে আসেন।

মহামারি কবলিত এলাকায় যাওয়া তো নিজ হাতে নিজেকে মৃত্যুকূপে নিক্ষেপ করা। পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্ট নির্দেশ আছে : “তোমরা নিজেদেরকে নিজ হাতে ধ্বংসের দিকে নিক্ষেপ করো না, বরং উত্তমভাবে ব্যবস্থা নাও, নিজেরাই। আল্লাহ্ উত্তমকাজ উত্তমভাবে সম্পাদনকারীকে পছন্দ করেন।”

জীবাণু বা অণুজীব যে রোগের জন্য দায়ী, তা আবিষ্কৃত হয় মাত্র ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে। এটাকে অনুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া দেখা যায় না। এ যন্ত্রটিও বেশিদিন আগে আবিষ্কৃত হয়নি। মহানবী (সা.) যদি ‘অণুজীব’ বলতেন তখন কাফেররা বলতো, দেখান তো? তাই তিনি বিজ্ঞানের কথা তাদের না বলে যা করতে হবে সেই সঙ্গ-নিরোধের কথা বলেছেন। যা উমর (রা.) আমল করেছেন।

বাংলাদেশের কিছু অসচেতন আবেগপ্রবণ লোকের মনোভাব হচ্ছে, ‘‘ ভাইরাস হলেও আমার কিছু হবে না।  মুসলমানরা বলে, আল্লাহ ভরসা, আমাদের কিছু হবে না। আমরা তো বারবার অযু-গোসল করি। কিছু লোক যারা ওয়ায-নসিহত শুনে নামাজ, রোযা করে নিজেদের ধার্মিক লোক মনে করে এবং শ্রোতার কাতার থেকে এখন বিজ্ঞ পরামর্শকের স্থানে নিজেকে বসিয়ে নিজেরাও বিভ্রান্ত হয়, অন্যদেরকেও বিভ্রান্ত করে বলে থাকে : জীবাণু বলে কিছুই নেই”  আল্লাহর হুকুম হলে করোনা ধরবে, না হলে ধরবে না। সতর্ক হয়ে লাভ কি? আল্লাহ কি নামাজিদের মারবে? এ ধরনের অতি আত্মবিশ্বাস, অতি আবেগ তাদেরকে বাস্তবতা থেকে দূরে রাখছে। সম্প্রতি দিল্লীর নিজামুদ্দীনের ঘটনা এর জ্বলন্ত প্রমাণ। একজন ক্ষতিগ্রস্ত হলে অন্যরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেহেতু সে জীবাণুর বাহক। পবিত্র কুরআনে আছে : যে আল্লাহর উপর ভরসা করে তিনিই তার জন্য যথেষ্ট।”

কোরআনের আরো আয়াত ও মহানবীর (সা.) এর হাদীস আছে যেখানে ব্যক্তির নিজের দায়িত্ব পালনের কথা বলা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন : আল্লাহ কোনো জাতি, সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা তাদের মধ্যকার অবস্থার মধ্যে পরিবর্তন আনে।” জীবাণু প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং গুনাহর পথ ছেড়ে তাওবা করাই হচ্ছে প্রধান পরিবর্তন।

মূলত পৃথিবীতে যা কিছু হয় সব আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়। যেমন বন্যা এলে মসজিদও ডুবে যায়, ঘরে আগুন লাগলে ধর্মগ্রন্থের পাতাও পুড়ে যায়। এ জন্যই মহামারি হলে নিরপরাধ লোক মারা পড়ে। বনে দাবানল হলে বেগুনাহ পশুপাখিও মারা পড়ে। ভূমিকম্প, সুনামী এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে ওই অঞ্চলের সকলেরই একদশা হয়। তবে মাঝে মাঝে কিছু অলৌকিক ঘটনাও ঘটে। তা হচ্ছে আল্লাহর ব্যতিক্রমী সুপার পাওয়ার। এ জন্যই মাঝে মাঝেই কিছু মহামারি, যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি মানুষের অসহায়ত্বকে খুবই স্পষ্ট করে প্রকাশ করে যায়। ইতালির প্রধানমন্ত্রী তাই বলেছেন, “এখন আকাশের দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার নেই।” অবশেষে তাই আল্লাহর ক্রোধ থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর কাছেই বিনয়াবনত হয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করি। এ জন্যই মহান আল্লাহ ভরসা দিয়ে বলেছেন : “আর যে আল্লাহর উপর ভরসা করবে, তিনিই তার জন্য যথেষ্ট।’’ আল্লাহর দিকেই সব বিষয় ঘুরেফিরে যায়।”


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ