অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ঋণনির্ভর বাজেট কতটা সফল হবে
সৈয়দ আতিকুর রব, আয়ারল্যান্ড থেকে || রাইজিংবিডি.কম
বিশ্বস্বাস্থ্য ঝুঁকি ও চরম অর্থনৈতিক মন্দার মতো কঠিন এই সংকটকালে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের বাজেট ঘোষণা করেছেন। সময়ের প্রেক্ষাপটে নিঃসন্দেহে এটি একটি কঠিন কাজ। বাজেট বক্তৃতার সময় অর্থমন্ত্রী এই ঝুঁকির কথা স্বীকার করলেও সামান্য আয়ের বৃহৎ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে তুষ্ট করতে তিনি হেঁটেছেন সেই গতানুগতিক পরিসংখ্যানের পথে।
অর্থমন্ত্রী হিসেবে এটি তাঁর দ্বিতীয় বাজেট। তিনি গত ১১ জুন ৫ লক্ষ ৬৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন জাতীয় সংসদে। বাজেটের শিরোনাম: ‘অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ পথ পরিক্রমা’। বলা হয়েছে এটি হবে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং মানুষের জীবন রক্ষার বাজেট। করোনায় তছনছ বৈশ্বিক মন্দার এই সময় ঋণনির্ভর এই বাজেট অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে কতখানি সফলতা পাবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ, আর বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে জিডিপির প্রায় ৬ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেট এবং প্রবৃদ্ধির হারের সঙ্গে বাস্তবতার মিল অনেকটা কল্পনানির্ভর। বড় বাজেট দেওয়া অর্থনীতির জন্য নতুন কিছু নয়। তবে এর ভিত্তি হচ্ছে রাজস্ব আয়। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রভাবে অর্থনৈতিক আয়ে বড় ধরনের যে ধাক্কা লেগেছে তার সঙ্গে ব্যায়ের সামঞ্জস্য না থাকায় প্রস্তাবিত বাজেটে আয়-ব্যায়ের যে বিস্তর ফারাক তৈরি হয়েছে সেটা কতখানি পূরণ হবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
প্রস্তাবিত বাজেটে মোট এডিপি ধরা হয়েছে ২ লক্ষ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। রাজস্ব খাত থেকে আয় ধরা হয়েছে ৩ লক্ষ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণ ধরা হয়েছে ৭৬ হাজার ৪ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থ বছরে সরকার অভ্যন্তরীণ খাত থেকে এক লাখ ৯ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঋণ নেবে। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি, সঞ্চয়পত্র থেকে ২০ হাজার কোটি এবং অন্যান্য ঋণ নেবে আরও ৫ হাজার কোটি টাকা। আগামী বছরে বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ৭৬ হাজার ৪ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ৫২ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারের এই ব্যাংক ঋণ দাঁড়াবে গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের এই বাজেটের প্রায় এক তৃতীয়াংশ ঋণনির্ভর। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ঋণের সুদ কীভাবে পরিশোধ করবে সরকার?
বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৪১ হাজার ২৭ কেটি টাকা। যা বাজেটের ৭.২ শতাংশ। গোটা জাতি যখন অপর্যাপ্ত চিকিৎসা উপকরণ, দুর্নীতি ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত, তখন এ খাতে প্রস্তাবিত বরাদ্দ মোটেই যথেষ্ট নয়। করোনাভাইরাসকে সঠিকভাবে মোকাবিলা এবং এর অর্থনৈতিক প্রভাব দৃঢ়তার সঙ্গে কাটিয়ে ওঠার স্বার্থে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাজেটের ১০ শতাংশ হওয়া প্রয়োজন।
অর্থনীতি উত্তরণে দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সামাজিক নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলার জন্য প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে তা বাস্তবায়নের কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তুলে ধরা হয়নি। কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি এবং গ্রামীণ উন্নয়নের অন্যতম স্তম্ভ। বাজেটে কৃষিখাতে ভর্তুকির পরিমাণ ধরা হয়েছে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু উৎপাদনের উপকরণের মূল্য হ্রাস না করে কিছু ক্ষেত্রে উপকরণের মূল্য বাড়ানো হয়েছে।
করোনাভাইরাসের কারণে বিপুলসংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশী কর্মহীন হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করেছেন। রেমিট্যান্স যোদ্ধা হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। প্রবাসীদের মধ্যে যারা কর্মহারা হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করছেন তাদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে বাজেটে যথাযথ দিক নির্দেশনা থাকা উচিত ছিল। একইসঙ্গে মনে করি, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি ও বাস্তবতার নিরীখে করমুক্ত ব্যক্তি শ্রেণীর আয়ের সীমা আরও বাড়ানো উচিত ছিল। করোনাভাইরাসের কারণে দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা। বাজেটে তাদের আয় ও কর্মসংস্থানের সুস্পষ্ট দিকনিদের্শনা থাকা উচিত ছিল। একইসঙ্গে বলব, জাকাতের টাকা করমুক্ত করা খুব প্রয়োজন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শ্রমিকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য বাজেটে কোনো বরাদ্দের কথা বলা হয়নি। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, আবাসন ও স্বাস্থ্যবীমার বিষয়ে বাজেটে পরিকল্পনা থাকা দরকার ছিল।
করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য অর্থমন্ত্রীর অর্থনীতি উত্তরণের পরিকল্পনার পাশপাশি কার্যকর সুশাসন ব্যবস্থা, আর্থিক খাতগুলোতে সচ্ছতা নিশ্চিতকরণ এবং সকল স্তরে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা না গেলে সাফল্য পাওয়া যাবে না। এবারের বাজেট নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন আগ্রহ নেই। জিডিপি'র পরিসংখ্যান নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না। কেননা, নিজের জীবন ও জীবিকাকে বাঁচানো নিয়ে সবাই ব্যস্ত। তবে অর্থ ব্যয় কিংবা বড় বাজেট নয়- ব্যয় করা অর্থ দেশের মানুষের কতটুকু কাজে লাগল সেটা যদি নিশ্চিত করা যায় তাহলে এই বজেটের মাধ্যমে চরম অর্থনৈতিক এই সংকটেও সাধারণ মানুষ উপকার পাবে।
ঢাকা/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন