ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

ধানের চেয়ে খড়ের প্রয়োজনীয়তা কম নয়

প্রদীপ অধিকারী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১৮ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
ধানের চেয়ে খড়ের প্রয়োজনীয়তা কম নয়

খড় বলতে প্রধানত ধান গাছের পাতাসমেত শুকনো কাণ্ডকে বোঝানো হয় যা গবাদিপশুর খাদ্য। অঞ্চলভেদে এটি খের, খড়, বিচোলি, বিচালি ইত্যাদি নামে পরিচিত।

গ্রাম পর্যায়ে পতিত জমি হ্রাস, কলাই-ছোলা ইত্যাদি দানা জাতীয় শস্যের চাষ হ্রাস, চারণ ভূমির অভাব, কাঁচা ঘাসের দুষ্প্রাপ্যতা, খরা-বন্যা, জ্বালানী হিসেবে খড়ের ব্যবহার, গম-ভুট্টার চাষ অত্যন্ত সীমিত, ইত্যাদি নানা কারণে গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবে খড়ই মূখ্য। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রধান খাদ্য যেমন ভাত, তেমনি প্রায় ৫ কোটি গবাদিপশুর প্রধান খাদ্য খড়।

২০১৮ সালের প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, দেশে গরুর সংখ্যা ২ কোটি ৩৯ লাখ এবং মহিষের সংখ্যা ৭ লাখ ১৮ হাজার। এদের বেঁচে থাকার জন্য বছরে খড়ের প্রয়োজন ২ কোটি ৭০ লাখ টন। এর সঙ্গে রয়েছে ২ কোটি ৫৯ লাখ ছাগল এবং ৮ লাখ ৯২ হাজার ভেড়া। প্রতিদিন গড়ে ন্যূনতম ৫০০ গ্রাম হিসেবে ছাগল-ভেড়ার জন্য বছরে খড়ের প্রয়োজন ৪৮ লাখ ৮৯ হাজার টন। শিল্পকারখানাসহ নানাবিধ ক্ষেত্রে খড়ের ব্যবহার বাদে, শুধু গবাদিপশুর খাদ্য বাবদ মোট খড়ের প্রয়োজন বছরে ৩ কোটি ১৭ লাখ টন। অথচ দেশে খড়ের উৎপাদন ১.৮ কোটি থেকে ২ কোটি টন। আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বক্তব্যটি যথাযথ নয়। মনুষ্য খাদ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও, গবাদিপশুর খাদ্যে আমাদের ঘাটতি ১ কোটি ১৭ লাখ টন।

অনুভবের আগ্রহ নিয়ে কান পাতলে আমরা নির্বাক পশুগুলোর অভুক্ত উদরের আর্তনাদ শুনতে পাবো। অপুষ্টিতে ভোগা অস্থিচর্মসার দেহের দিকে অভিভাবকের দৃষ্টিতে তাকালে বক্তব্যের সত্যতার প্রমাণ মিলবে। বাস্তবতা বিশ্লেষণ না করে, ধান কাটায় কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার নামক ধার করা প্রযুক্তির খড় ধ্বংসকারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করলে গবাদিপশুর ক্ষুধার জ্বালা আরো বেড়ে যাবে। ধান চাষে ক্ষতিগ্রস্থ  কৃষকদের জীবিকার শেষ অবলম্বন গাভী পালন করে দুধ বিক্রি করা, ক্ষেত্রবিশেষে ষাঁড় পালন। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন খড়। ধান কাটায় খড় ধ্বংসকারী যন্ত্রের ব্যবহার আমাদের গবাদিপশুর ক্ষুধার জ্বালা হবে প্রকট। ধান চাষীদের জীবন-জীবিকা হবে সংকটাপন্ন।

সাদামাটা হিসাবে বর্তমান মৌসুমে যন্ত্রের সাহায্যে ১ শতক জমির ধান কাটতে ৭০ টাকা থেকে ৯০ টাকা খরচ হয়। গড়ে ৮০ টাকা হিসাব করে যন্ত্র বাবদ ১ একরে খরচ হয় ৮ হাজার টাকা। ধানের বস্তা বাড়ি আনা, ধান শুকানো বাবদ ২ হাজার  টাকা। শ্রমিক দিয়ে কাটলে, ২০ থেকে ২২ জন শ্রমিকের মজুরি বাবদ ধান-খড় সংরক্ষণসহ খরচ হয় প্রায় ১৮ হাজার  টাকা। কিন্তু ১ একর জমির খড়ের মূল্য প্রায় ৯ হাজার টাকা। ধান কাটায় খড়বিধ্বংসী  যন্ত্র ব্যবহার করলে প্রতি একরে ক্ষতি হয় প্রায় এক হাজার টাকা। প্রতিকূলতা, সময় বা শ্রমিক-দুষ্প্রাপ্যতার কারণে ক্ষতিটা আমরা মেনে নেই। কিন্তু গো-খাদ্যের দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে নষ্ট হয় ১ টন থেকে ১.৫ টন খড়, যা একটা গরুর এক বছরের খোরাক। এটি একটি নিষ্ঠুর অপচয়। অনেকে হয়তো বলবেন খড় পঁচে জৈব সার হয়। ধানের গোড়ার ২ ইঞ্চি থেকে ৩ ইঞ্চি থেকেই যায়। তা ছাড়া আমাদের জমিতে বর্ষা মৌসুমে যে ন্যাড়া বা আগাছা জন্মায় সেগুলোকে সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় পঁচিয়ে ফেললে আনেক জৈব সার পাওয়া সম্ভব।     

আমরা একটু দায়িত্বশীল হলেই গবাদিপশুর এই খাদ্য ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে পারি। প্রতি বছর আমাদের অসচেতনতা, অবহেলাসহ নানা প্রতিকূলতার কারণে ৮০ লাখ টন খড় নষ্ট হয়। চাষী এবং কৃষি-শ্রমিকগণ, বিশেষত চাষীদের মধ্যে যারা গবাদিপশু পালন করেন না, তারা একটু দায়িত্বশীল হলে এই বিশাল পরিমাণ গো-খাদ্যের অপচয় রোধ করা সম্ভব। মাটি থেকে ৮/৯ ইঞ্চি উপরে ধান না কেটে সর্বোচ্চ ২ ইঞ্চির মধ্যে ধান কাটতে হবে, এতে একর প্রতি প্রায় দশমিক ৫ টন খড়ের উৎপাদন বাড়বে।

প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশে খড় সংরক্ষণের লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং ব্যবহারও জরুরি। ধান কাটায়, ধার করা প্রযুক্তির খড়বিধ্বংসী যন্ত্র ব্যবহারের পরিবর্তে নিজস্ব প্রয়োজন এবং পরিবেশসম্মত গবেষণালব্ধ যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে। উচ্চফলনশীল ধান নির্বাচনের ক্ষেত্রে খড়কে প্রাধান্য দিতে হবে। রবিশস্যসহ অন্যান্য ফসলের খড়ও গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার বাড়াতে হবে। গৃহপালিত বাকশক্তিহীন গবাদিপশুর প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধ পরিশীলিত করতে হবে।

সর্বোপরী গবাদিপশুগুলো আমাদের পরিবারের সদস্য, আমাদের প্রতি ওরা যেমন দায়িত্বশীল তেমনি ওদের রয়েছে আমাদের প্রতি অধিকার। ওদের অধিকার সংরক্ষণে রাষ্ট্রীয়ভাবে পশু অধিকার সংরক্ষণ আইন এখন সময়ের দাবি।

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়