ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ভারতীয় টিভি চ্যানেল: নেপালের সিদ্ধান্ত আমাদের শিক্ষা

এম এ কবীর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫৯, ১৩ জুলাই ২০২০   আপডেট: ০৫:৩৯, ২৯ আগস্ট ২০২০
ভারতীয় টিভি চ্যানেল: নেপালের সিদ্ধান্ত আমাদের শিক্ষা

প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলিকে অসম্মান করে দেশটির জাতীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা হয়েছে এমন অভিযোগে নেপালে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার। যদিও নেপাল সরকার বলছে, তারা এ ধরনের কোনো নির্দেশনা দেয়নি। দেশটির ক্যাবল অপারেটররা স্বপ্রণোদিত হয়ে কাজটি করেছে। কাঠমাণ্ডু পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি ভারতীয় নিউজ চ্যানেল ‘জি নিউজ’-এ নেপালের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেশটিতে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত হৌ ইয়ানকির সম্পর্কের বিষয়ে চাঞ্চল্যকর খবর প্রচার করা হয়েছে। চ্যানেলটি কোনো ধরনের প্রমাণ উপস্থাপন ছাড়াই ১৫ মিনিটের বেশি সময় ধরে নানা ভিত্তিহীন অভিযোগ প্রচার করেছে।

এদিকে নেপালের ক্যাবল টিভি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দিনেশ সুবেদি গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘দেশপ্রেমের তাগিদে আমরা বেশ কিছু ভারতীয় চ্যানেলের প্রচার বন্ধ করে দিয়েছি। শুধু ‘দূরদর্শন’ সম্প্রচার বন্ধ করা হয়নি। এ জন্য সরকার নির্দেশনা দেয়নি। ক্যাবল অপারেটরদের স্বাধীন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এসব চ্যানেল বন্ধ করা হয়েছে।’

বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশনের কর্মীরা ‘ব্রডকাস্টার নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশ’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছেন। ‘সুরক্ষিত করা হোক বেসরকারি টেলিভিশন খাত’ শিরোনামে তাদের প্রচারপত্রে বলা হয়েছে: ‘বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় বেসরকারি টেলিভিশন খাতের প্রধান হুমকি হচ্ছে ভারতীয় স্যাটেলাইট টেলিভিশনের আগ্রাসন।’ তাদের মতে দিনরাত ভারতীয় টিভির অনুষ্ঠান দেখে আমাদের সমাজে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তাই দেশে ভারতীয় চ্যানেল প্রদর্শন সীমিত হওয়া উচিত। তাদের এই বক্তব্যের পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি রয়েছে। শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি গণমাধ্যম পৃথিবীর কোথাও সীমানা মানেনি। একসময় কথা উঠেছিল, ভারতীয় বই বাজারে থাকলে বাংলাদেশের বই বিক্রি হবে না। বাস্তবে তা হয়নি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস বাজারে থাকা সত্ত্বেও সৈয়দ শামসুল হক, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হকের বই পাঠক আগ্রহ নিয়ে কিনেছেন, পড়েছেন। কলকাতার জনপ্রিয় লেখকেরা বই বিক্রিতে বাধা হননি। কারণ বাংলাদেশের বইগুলো ভালো বলেই বিক্রি হয়েছে। কাজেই ভালো হওয়াটাই আসল কথা।

বাংলাদেশের সিনেমাকে এভাবে প্রটেকশন দিতে গিয়ে সিনেমার কী দুরবস্থা হয়েছে দর্শক ভালো করেই জানেন। পাকিস্তান আমলের উর্দু ছবি, মুম্বাইয়ের হিন্দি ছবি, কলকাতার সূচিত্রা-উত্তমের বাংলা হিট ছবির পাশাপাশি ঢাকার বাংলা সিনেমা প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হয়েছিল। কোনো সমস্যা হয়নি। কারণ ছিলো এ দেশের সিনেমার মান।

এখন হয়তো আমাদের টিভি অনুষ্ঠান ভারতীয় টিভির তুলনায় নিষ্প্রভ মনে হতে পারে। যদি আমরা প্রতিভার সঠিক মূল্যায়ন করি, যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য পদে স্থান দেই, অনুষ্ঠান নিয়ে গবেষণা করি, পরিকল্পনা করে এগিয়ে যাই তাহলে হয়তো আমরাও ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারব। এ জন্য সবার আগে আমাদের টিভি চ্যানেলে কী কী দুর্বলতা রয়েছে, কোথায় অব্যবস্থাপনা রয়েছে খুঁজে বের করা দরকার। যারা টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স পেয়েছেন, তারা ব্যবসা পরিচালনার জন্য যোগ্য কিনা তাও দেখা দরকার।

বাংলাদেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেলে মানসম্পন্ন অনুষ্ঠানের সংখ্যা কম। প্রতিটি টিভি চ্যানেলে একটা কোটাভিত্তিক শিল্পীগোষ্ঠী রয়েছে। পর্দায় সারাক্ষণ তাদেরই দেখা যায়। মনে হয় দেশে যেন আর শিল্পী নেই! এ রকম অসংখ্য দুর্বলতা আমাদের চ্যানেলে রয়েছে। গুটিকয়েক ভালো অনুষ্ঠান দিয়ে ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া যাবে না। অথচ খুব বেশি আগের কথা নয়, আশির দশকের শেষদিকে বিটিভির জনপ্রিয়তা এই পর্যায়ের ছিল যে, বিটিভি সম্প্রচারিত হওয়া শুরু হলে ভারতীয় চ্যানেল পশ্চিমবঙ্গে বড় একটা কেউ দেখত না। তখন পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এক ডাকে চিনতো ‘খালামণি’ ওরফে ফেরদৌসী রহমানের নাম। বাংলাদেশের টিভি নাটকের জনপ্রিয়তায় ঢাকা পড়ে গিয়েছিল কলকাতায় তৈরি বাংলা সিনেমা। উপায় না দেখে কলকাতা দূরদর্শন শনিবারে চালাতো উত্তম-সুচিত্রা সেনের সিনেমা।  

সময় পাল্টে গেছে। এখন আর আমাদের চ্যানেলের সেই সুদিন নেই। এ নিয়ে বাংলাদেশের অনেক দর্শকের মনে সৃষ্টি হয়েছে ক্ষোভ। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন- ভারতে যখন বাংলাদেশের চ্যানেল দেখানো হচ্ছে না, তখন বাংলাদেশে কেন ভারতীয় চ্যানেল দেখানো হবে? বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহিন আরা লাইলী ২০১৪ সালের ৭ আগস্ট আদালতে বাংলাদেশে ভারতীয় চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধে উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপ চেয়ে একটি রিট করেন। বলা হয়, ভারতীয় বিভিন্ন চ্যানেল বাংলাদেশে দেখানো হলেও ভারতে বাংলাদেশের কোনো চ্যানেল দেখানো হয় না। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ভারতীয় চ্যানেলের ‘অবাধ সম্প্রচারের’ কারণে দেশের টিভি চ্যানেলগুলো দর্শক হারাচ্ছে। এই রিট প্রসঙ্গে মহামান্য বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও জে বি এম হাসানকে নিয়ে গঠিত বেঞ্চ রায় দেন- এ ধরনের কোনো নিষেধাজ্ঞা এই চ্যানেলগুলোর ওপর আরোপ করা হবে না।

ওদিকে ভারত সরকারের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান ভারতে দেখানোর ক্ষেত্রে কোনো আইনি বাধা নেই। ২০১১ সালের ৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত ভারত সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসরণ করে যে কেউ ভারতে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেল ডাউনলিংক করতে পারবে।’ বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, ‘ভারতীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ও ভারতে কোনো বাংলাদেশি চ্যানেল ডাউনলিংকের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করেনি। কোনো কোম্পানি যদি বাংলাদেশি চ্যানেল ডাউনলিংক করতে চায়, তা হলে ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় নীতিমালা অনুযায়ী সর্বতোভাবে সহায়তা করতে প্রস্তুত। তবে আবেদনকারী কোম্পানিকে প্রথম টেলিভিশন চ্যানেল ডাউনলিংকের জন্য ৫ কোটি ভারতীয় রুপি এবং পরবর্তী পর্যায়ে প্রতিটি অতিরিক্ত চ্যানেল ডাউনলিংকের জন্য ২ কোটি ৫০ লাখ ভারতীয় রুপি নেট মূল্য পরিশোধ করতে হবে। এই মূল্য ছাড়াও ডাউনলিংকের অনুমতি মঞ্জুরের সময় ১০ লাখ ভারতীয় রুপি ফি দিতে হবে। এ ছাড়া বিদেশ থেকে আপলিংক করা প্রতিটি চ্যানেল ডাউনলিংকের জন্য বার্ষিক ফি হিসেবে ১৫ লাখ ভারতীয় রুপি দিতে হবে। ডাউনলিংকের নিবন্ধন ও অনুমতি ১০ বছর বহাল থাকবে।

এদিকে বাংলাদেশের ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভিনিউ বাংলাদেশের অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্সের সাথে এক বৈঠকের পরে স্থির করেছিল ভারতীয় চ্যানেলসহ সকল বিদেশি চ্যানেলের ওপরে কর বা ফি বসানো হবে। তখন ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভিনিউয়ের কর্তা ব্যক্তিরা বললেন, এখন ইন্টারনেটের যুগ। এতে ভারতীয় ডিশ সংযোগ বেড়ে যাবে বাংলাদেশে। ভিপিএন সিস্টেমে সবাই সবগুলো ভারতীয় চ্যানেল বাংলাদেশে বসেই দেখতে পাবে। তখন রেভিনিউ আর্নিং বা কর আদায়ের ক্ষেত্রে সমস্যা হবে। ফলে ব্যাপারটি আর এগোয়নি। 

তবে কথা আরো আছে। বাংলাদেশের মাত্র ২০০ কোটি টাকার বিজ্ঞাপনের বাজারে দেশিয় চ্যানেলগুলো চালাতে হিমশিম খেতে হয়। তার ওপর যদি ভারতে সম্প্রচারের জন্য টাকা দিতে হয় তাহলে বিপদে পড়তে হবে। এ ক্ষেত্রে আমি বলবো, বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোকে আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকতে গেলে সাবালক হতেই হবে। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর প্রথম বাস্তবসম্মত সম্প্রচার নীতিমালা তৈরি হয়েছে। কিন্তু এখনো সম্প্রচার আইন তৈরি হয়নি। আমরা এখনো সুরাহা করতে পারিনি আমাদের চ্যানেল ভারতে দেখানো হবে কিনা? আমরা এমন সিদ্ধান্তও নিতে পারিনি যে, ভারত আমাদের চ্যানেল না দেখালে আমরাও ভারতের টিভি চ্যানেল দেখাবো না। অথচ কত সহজেই নেপাল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, তারা আর ভারতীয় টিভি চ্যানেল দেশটিতে দেখাবে না। এখন আমাদের ভাবনার দিন এসেছে। সিদ্ধান্ত এখনই নিতে হবে- দেবে আর নেবে, মেলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে- সেটা আর হবে না।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়